(খ) মৌখিক সাক্ষ্য সকল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ হইবে এই নীতিটি বিশদ ব্যাখ্যা কর।
(গ) এই নীতিটির ব্যতিক্রম আছে কি?
(ক) সাক্ষ্য আইন প্রয়োগের প্রধান নীতি: সাক্ষ্য আইন অভিধানে যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সে মতে সাক্ষ্য হচ্ছে, আদালত কর্তৃক. কোন বিচার কার্য সম্পাদনের সময় পক্ষগণ কর্তৃক তাদের সাক্ষীর মাধ্যমে’ বা রেকর্ড, দলিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে আদালত বা জুরির মনে বিশ্বাস স্থাপনের প্রয়াসে আইন সঙ্গতভাবে উপস্থাপিত প্রমাণের কোন নমুনা।
‘সাক্ষ্যের’ ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘evidence’ ল্যাটিন শব্দ ‘evidens’ বা ‘evidere’ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে কোন কিছু প্রদর্শন করা বা দৃষ্টি গোচর করা বা সুস্পষ্টভাবে আবিষ্কার করা। অতএব বিচারাধীন কোন ঘটনা সম্পর্কে প্রমাণ বা অপ্রমাণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত কোন বক্তব্য বা বস্তু। যে ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করেন তাকে সাক্ষী বলে এবং সাক্ষ্য দ্বারা যে ঘটনা প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাকে প্রমাণিত বলে। সাক্ষ্যের শাখা বিশেষ বা অংশকে প্রমাণ বলে।
সাক্ষ্যের অগ্রাধিকার নির্ধারণ: প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য উৎকৃষ্ট মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই সকল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। মৌখিক সাক্ষ্য অবশ্য প্রত্যক্ষ হওয়া প্রয়োজন। তবে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের মূল্য নির্ভর করে সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতার উপর। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের অবর্তমানে অপ্রত্যক্ষ বা অবস্থাগত সাক্ষ্যের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থাগত সাক্ষ্য বিচার্য বিষয়ের সত্যতা বা অসত্যতা সম্পর্কে একটা অকাট্য ইঙ্গিত প্রদর্শন করে। তাই বলা হয় যে, সাক্ষী মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা মিথ্যা বলে না।
দালিলীক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাক্ষ্যের উপর. অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রাথমিক সাক্ষ্যের বর্তমানে গৌণ সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণযোগ্য হয় না। তবে বিচার্য বিষয়ে প্রাথমিক সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে অপারগ হলে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে গৌণ সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়৷
(খ ) মৌখিক সাক্ষ্য: ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে দু’ প্রকারের সাক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মৌখিক সাক্ষ্য ও দলিলী সাক্ষ্য। সাক্ষ্য আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, (১) আদালতে যে ঘটনার বিষয়ে বিচার বা তদন্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে সাক্ষীর যে সব মৌখিক বিবৃতি দেয়ার জন্য আদালত অনুমতি দেয় বা যে সকল বিবৃতি আদালতের প্রয়োজন হয় সে সকল বিবৃতিকে বলা হয় মৌখিক সাক্ষ্য। (২) যে সকল দলিল আদালত কর্তৃক পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা হয় সেগুলোকে বলা হয় দলিলী সাক্ষ্য।
মৌখিক সাক্ষ্য সম্পর্কে ৫৯ ও ৬০ ধারায় বিধান রয়েছে। ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, দলিলের বিষয়বস্তু ব্যতীত সকল বিষয়ে মৌখিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ করা যাবে। তবে মৌখিক সাক্ষ্য সম্পর্কে আদালতকে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। বলা হয় যে, সাক্ষী মিথ্যা বলতে পারে। কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা মিথ্যা বলে না। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে যে মৌখিক সাক্ষ্য খাপ খায় তা বিশ্বাসযোগ্য। গ্রামের সরল, নিরীহ ও নিরক্ষর ব্যক্তিদেরকে নানাভাবে প্রভাবিত করে টাউট শ্রেণীর লোকেরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে আদালতে নিয়ে আসে। ৬০ ধারায় বলা হয়েছে যে, মৌখিক সাক্ষ্য অবশ্যই প্রত্যক্ষ হতে হবে। তাই বিচার্য বিষয় বা প্রাসঙ্গিক বিষয় দেখার বস্তু হলে যিনি মৌখিক সাক্ষ্য দিচ্ছেন তিনি তা দেখেছেন, শুনিবার বিষয় হলে তিনি তা শুনে থাকবেন এবং স্পর্শ করার বিষয় হলে তিনি তা স্পর্শ করে থাকবেন। যা প্রত্যক্ষ নয় তা গ্রহণ করা যাবে না ।
উক্তনীতির ব্যতিক্রম সাক্ষ্য আইনের ৩২ ও ৩৩ ধারায় এরূপ নীতির ব্যতিক্রম করা হয়েছে।
সাক্ষ্য আইনের ৩২ ধারা মতে, কোন নিহত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে যদি তার মৃত্যুর কারণ, অবস্থা এবং পরিস্থিতি বর্ণনা করে কোন বিবৃতি বা জবানবন্দী প্রদান করে থাকেন তবে তাকে মৃত্যুকালীন ঘোষণা বলা হয়। ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোন মামলায় কোন মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উঠে তখন ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অথবা ‘যে অবস্থা এবং পরিস্থিতিতে তার মৃত্যু ঘটেছে সে সম্পর্কে যদি বিবৃতি প্রদান করে থাকে, তবে এরূপ বিবৃতি প্রদানের সময় বিবৃতি দানকারীর মৃত্যুর আশংকা উপস্থিত থাকুক বা না থাকুক এবং যে মামলায় তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠে তার প্রকৃতি যাই থাকুক না কেন, উক্ত বিবৃতি প্রাসঙ্গিক। এরূপ ঘোষণা লিখিত হতে পারে বা মৌখিক হতে পারে কিংবা ভাব ভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। ইহা ম্যাজিস্ট্রেট বা কোন বিশেষ ব্যক্তির নিকট ঘোষণা করতে হবে তার কোন বাধ্যবাধকতা বা বিধি-বিধান নেই। ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ অফিসার বা সাধারণ নাগরিকের নিকট এরূপ ঘোষণা বা বিবৃতি প্রদান করা যায়।
৩৩ ধারায় পূর্ববর্তী কোন মামলায় প্রদত্ত কোন সাক্ষীর প্রদত্ত বিবৃতি পরবর্তী মামলায় গ্রহণযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক করা হয়েছে। যখন কোন সাক্ষী মৃত অথবা নিখোঁজ বা সাক্ষ্য দিতে অক্ষম বা বিরুদ্ধপক্ষ কর্তৃক প্রতিরুদ্ধ, তখন মামলার বিচার্য বিষয় প্রমাণের জন্য আলোচ্য ধারা মতে, শর্তসাপেক্ষে গ্রহণীয়। এই শর্তগুলি হচ্ছে নিম্নরূপ-
(ক) পূর্ববর্তী মামলাটি বর্তমান মামলার পক্ষদ্বয়ের মধ্যেই বা তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে হয়েছিল; (খ) পূর্ববর্তী মামলায় সাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ বিরুদ্ধপক্ষের ছিল; (গ) পূর্ববর্তী মামলায় বিচার্য বিষয় পরবর্তী মামলার বিচার্য বিষয়ের অনুরূপ ছিল।
সাক্ষীকে হাজির করতে অযৌক্তিক দেরী ও অর্থ ব্যয় হবে বলে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হলেও উপরিউক্ত শর্ত সাপেক্ষে পূর্ববর্তী মামলার সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য পরবর্তী মামলায় গ্রহণীয় হবে।
Leave a comment