মোঙ্গল নীতি: উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সমস্যা
ভারতের চতুর্দিকে যে প্রাকৃতিক নিরাপত্তা রয়েছে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে তা খুবই দুর্বল। এই পথ দিয়ে প্রাচীনকালে শক্, হন প্রভৃতি জাতি ভারতে প্রবেশ করে রাজ্য স্থাপন করেছে। পরবর্তীকালে একই পথ ধরে ভারতে এসেছে তুর্কিরা। কিন্তু তারাও এদেশে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্বে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তদেশের বিবাদ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না এবং ওই পথ ধরে বহিঃশত্রুর আক্রমণ-সম্ভাবনা বিনষ্ট করার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেননি। তাই দুর্ধর্ষ মোঙ্গলজাতি সমগ্র মধ্য এশিয়া দখল করার পর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে। বাহরাম শাহ এবং নাসিরুদ্দিন মামুদের রাজত্বকালে চাহেলগানীর অন্যতম সদস্য এবং উচ্চপদাধিকারী হিসেবে বলবন মোঙ্গলদের আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলরা সিন্ধু ও মুলতানের একাংশ দখল করে নেয়। বলবন দ্রুত অগ্রসর হয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। কিন্তু ১২৪৭ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল-নেতা সালদি লাহোরের একাংশ দখল করে নেন। সুলতানের শাসনকর্তা শের খাঁ সম্ভবত মোঙ্গলদের সাথে একটা গোপন বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর নিজের স্বার্থে এই বোঝাপড়ার চেষ্টা সফল হয়নি; তবে বলবন তাঁর এই আত্মীয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। যাই হোক, এই সময় দিল্লির সীমানা ঝিলাম নদী থেকে বিপাশা নদী পর্যন্ত পিছিয়ে আসে।
বলবন সিংহাসনে বসার পর এক বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শক্তিগুলিকে দমন করার পর সীমান্তের সুরক্ষা সম্পর্কে ব্যবস্থাদি গ্রহণে উদ্যোগী হন। বলবনের আশঙ্কা ছিল যে, মোঙ্গলরা যে-কোনো মুহূর্তে বিপাশা নদী অতিক্রম করে দিল্লি আক্রমণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে দিল্লি-সুলতানির অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি নতুন রাজ্যজয়ের লোভ সংবরণ করেন। প্রধানত মোঙ্গলদের ভয়েই তিনি দিল্লি ছেড়ে বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করেন। তাঁর সেনাপতিরা মালব, গুজরাট ইত্যাদি রাজ্য দখল করার কথা বললে বলবন বলতেন যে, তিনি দিল্লির বাইরে গেলেই মোঙ্গলরা দিল্লি আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করবে।
শাসক হিসেবে বলবন ছিলেন খুবই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। তাই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে নিরাপদ করার জন্য তিনি শক্তিপ্রয়োগ ও কূটকৌশল—এই দ্বিবিধ নীতি অনুসরণ করেন। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে বলবন কয়েকটি রক্ষণাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাঁর আপাত লক্ষ্য ছিল মোঙ্গলদের বিপাশার তীরে আটকে রাখা। তাই তিনি সীমান্তবর্তী ভাতিন্দা, সামান ও সুমানার দুর্গগুলির সংস্কারসাধন করেন এবং ওইসব দুর্গের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন। মোঙ্গল আক্রমণকারীদের সম্ভাব্য যাতায়াতের পথে কয়েকটি সেনাঘাঁটি নির্মাণ করে নিরন্তর প্রহরার ব্যবস্থা করেন। সুলতান স্বয়ং দিল্লিতে সর্বদা উপস্থিত থেকে সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখার সিদ্ধান্ত নেন। বলবনের রাজত্বের গোড়ার দিকে শের খাঁ নামক তাঁর জনৈক আত্মীয় ভাতিন্দা, দীপালপুর ও লাহোরকে কেন্দ্র করে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বারাণী মনে করেন, শের খাঁ ছিলেন খুবই দক্ষ ও বিশ্বস্ত সেনাপতি। কিন্তু ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে শের খাঁর মৃত্যু হয়। অনেকে মনে করেন, বলবন বিষপ্রয়োগ করে শের খাঁকে হত্যা করেছিলেন। অধ্যাপক নিজামীর মতে, মোঙ্গলদের সাথে শের খাঁর একটা অশুভ আঁতাত তৈরি হয়েছিল। তাই তিনি শের খাঁকে মুলতান থেকে দিল্লি প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন। কিন্তু শের খাঁ বলবনের আদেশ পালনে অযথা বিলম্ব করতে থাকেন। নানা অজুহাতে তিনি কয়েকটা বছর কাটিয়ে দেন। তাই বলবন এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন। যাই হোক, শের খাঁর মৃত্যুর ফলে উত্তর পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপারে একটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এই সময় বলবন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। মুলতান, সিন্ধু ও উচের দায়িত্ব দেন জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদের হাতে এবং সামান, সুমানা ও দীপালপুরের দায়িত্ব দেন তমর খাঁর হাতে। কিন্তু ইতিপূর্বে দুই তুর্কি-আমির কিশলু খাঁ এবং শের খাঁ গোপনে মোঙ্গলদের সাথে জোট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, এই ভয়ে অল্পদিনের মধ্যে তমর খাঁকে সরিয়ে ওই অঞ্চলের দায়িত্ব দেন কনিষ্ঠ পুত্র বুগরা খাঁর হাতে। বুগরা খাঁর বিশ্বস্ততা সম্পর্কে বলবন নিশ্চিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর সামরিক দক্ষতার অভাব ছিল। তাই গুপ্তচর মারফত সামান-সুমানা অঞ্চলের ওপর সুলতান সর্বদা নজর রাখতেন।
সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি বলবন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মোঙ্গলদের আক্রমণ সম্ভাবনা শিথিল করার চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি ইরানের মোঙ্গল শাসক হলাকুর দরবারে দ্রুত প্রেরণ করেন এবং হলাকু-প্রেরিত দূতকে সসম্মানে দিল্লির রাজসভায় গ্রহণ করেন। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র প্রমুখ বারাণীর এই বিবরণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অধ্যাপক নিজামীর মতে, বলবনের সিংহাসনারোহণের পূর্বেই হলাকুর মৃত্যু হয়েছিল। তাই এই ধরনের কোনো কূট সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনা অন্তত হলাকুর আমলে ছিল না। তবে মোঙ্গলদের ইলখান গোষ্ঠীর সাথে বলবনের একটি অলিখিত সমঝোতা স্থাপিত হয়েছিল বলে মনে হয়। যাতে পাঞ্জাবের ওপর মোঙ্গলদের কর্তৃত্ব বলবন স্বীকার করেছিলেন এবং মোঙ্গলরাও দিল্লি আক্রমণ না করার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এতদ্সত্ত্বেও মোঙ্গলরা প্রায়শই সীমান্তে হানা দিত এবং সুলতানি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ ঘটাত। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে এমনি একটি আক্রমণ মহম্মদ ও বুগরা খাঁর মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা হয়। অতঃপর বুগরা খাঁকে বলবন বাংলার গভর্নর নিযুক্ত করলে (১২৮১ খ্রিঃ) সমগ্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দায়িত্ব পড়ে মহম্মদের হাতে। ১২৮৫ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল নেতা তৈমুর খাঁ বিশাল বাহিনীসহ বিপাশা অতিক্রম করে দীপালপুর আক্রমণ করেন। মহম্মদ বীরত্বের সাথে মোঙ্গলদের প্রতিহত করেন। তবে এই যুদ্ধে তিনি নিহত হন। সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য তিনি ‘খান-ই-শহিদ’ উপাধিতে ভূষিত হন। তবে প্রিয় পুত্রের এহেন আকস্মিক মৃত্যু বলবনকে প্রচণ্ড আঘাত করে। সুলতানের শরীর দ্রুত ভেঙে পড়ে। কারণ মহম্মদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পার্থিব আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে যায়। কারণ বলবনের অন্য পুত্র বুগরা খাঁ সুলতানি সিংহাসন সম্পর্কে আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। তিনি লখনৌতির শাসক পদেই থাকার দৃঢ় ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এমতাবস্থায় বলবন মৃত মহম্মদের নাবালক পুত্র কাইখসরু’কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এর চারদিন পরেই তাঁর মৃত্যু হয় (১২৮৭ খ্রিঃ)।
Leave a comment