মোঙ্গল আক্রমণ ও মহম্মদ-বিন্-তুঘলক:
১৩২৬ থেকে ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো এক সময় চাঘতাই মোঙ্গল নেতা তরমাশিরিন খাঁ ভারতে এসেছিলেন। তরমাশিরিনের ভারতে আগমনের নির্দিষ্ট সময়, উদ্দেশ্য এবং পরিণতি সম্পর্কে সমকালীন ও পরবর্তী ঐতিহাসিকদের বিবরণে বহু অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। ইসামীর বিবরণ’ থেকে জানা যায় যে, সুলতান মুলতান থেকে আগত এক দূত মারফত জানতে পারেন যে, তরমাশিরিনের নেতৃত্বে বিশাল মোঙ্গলবাহিনী সিন্ধুদেশে প্রবেশ করে ব্যাপক লুঠতরাজ ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে দ্রুত ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। সংবাদ পাওয়ামাত্র মহম্মদ তুঘলক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন এবং দেশের নানাপ্রান্ত থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে প্রায় পাঁচ লক্ষ অশ্বারোহী যোদ্ধা প্রস্তুত করেন। তবে এই বাহিনীকে মোঙ্গলদের প্রতিরোধের জন্য অগ্রসর হবার কোনো নির্দেশ তখনও দেওয়া হয়নি। আবার খবর আসে যে, মোঙ্গলরা মিরাটে প্রবেশ করেছে এবং নাগরিকদের ওপর অকথ্য নিপীড়ন চালাচ্ছে। এই সময় সুলতান ইউসুফ বুঘরা খাঁকে দশ হাজার সৈন্যসহ মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। বুঘরা খাঁ অসম শক্তি নিয়ে বীরত্বের সাথে মোঙ্গলদের আক্রমণ করেন এবং প্রাথমিক বিপর্যয় সত্ত্বেও মোঙ্গলদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।
ইসামীর মতে, মহম্মদ-বিন্-তুঘলক এক্ষেত্রে চূড়ান্ত কাপুরুষতার পরিচয় দেন এবং পাঁচ লক্ষের বাহিনী প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও মাত্র দশ হাজার বাহিনীকে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করে ভীরুতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নগ্ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মোঙ্গলদের পরাজিত হবার সংবাদ পাওয়ার পর সুলতান দিল্লির বাইরে এসে কিছু সৈন্যকে তাদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দেন। ইয়াহিয়া-বিন-আহমদ-এর মতে, মোঙ্গল আক্রমণের সংবাদ পাওয়ার পর (১৩২৮ খ্রিঃ) মহম্মদ-বিন-তুঘলক সসৈন্যে কালানুর পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং সেখানকার অগ্রবর্তীবাহিনীর দায়িত্ব মালিক মুজিরুদ্দিনের হাতে ন্যস্ত করে দিল্লি ফিরে যান। মহম্মদ-বিন্-তুঘলক যে মোঙ্গলদের প্রতিহত না করে দিল্লির মধ্যে নিষ্ক্রিয়ভাবে বসেছিলেন, একথা ইয়াহিয়া তাঁর ‘তারিখ-ই-মুবারকশাহি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এমনকি তৈমুরের আত্মজীবনীতেও এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। বদাউনিও প্রায় একই কথা লিখেছেন। ফেরিস্তার বিবরণে কিছুটা নতুনত্ব আছে। ইসামী, ইয়াহিয়া-বিন্-আহমদ বা বদাউনির বিরোধিতা করে তিনি লিখেছেন : তরমাশিরিন ভারতে এসেছিলেন ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ মহম্মদ-বিন্-তুঘলক কর্তৃক দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের আগে। ফেরিস্তা লিখেছেনঃ দবা খাঁ’র পুত্র তরমাশিরিন সসৈন্যে ভারতে প্রবেশ করে মুলতান, লামাঘান-সহ দিল্লি পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল লুঠতরাজ করেন। ভীত সুলতান মহম্মদ তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে অর্থের বিনিময়ে শান্তি প্রার্থনা করেন। বিশাল অঙ্কের অর্থ নিয়ে তরমাশিরিন ভারত ত্যাগ করেন।
ড. আগা মেহদী হোসেন মনে করেন, ফেরিস্তার বিবরণের মধ্যে অন্তর্বিরোধিতার ছাপ স্পষ্ট। ফেরিস্তা এবং বারাণী উভয়েই স্বীকার করেছেন যে, রাজত্বের সূচনাপর্বে মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের শাসনব্যবস্থা এত দক্ষ ছিল যে, সমস্ত প্রকার বাধাবিপত্তি তিনি অতিক্রম করতে সক্ষম ছিলেন। সুতরাং, রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে তিনি ব্যর্থ হবেন, কিংবা অর্থের বিনিময়ে রাজ্যের নিরাপত্তা ভিক্ষা করবেন—একথা স্বীকার করা যায় না। ড. হোসেন লিখেছেন: এ ধরনের দুর্বলতা নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমির ও মালিকদের আনুগত্য পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ মহম্মদ তুঘলক এর পরেও প্রায় পঁচিশ বছর দাপটের সাথে রাজত্ব করেছিলেন। ইসামী, ইয়াহিয়া আহমদ, ফেরিস্তা প্রমুখ তরমাশিরিনের যাত্রাপথের যে বিবরণ দিয়েছেন, তাও পরস্পরবিরোধী। ইসামীর মতে, তরমাশিরিন সিন্ধু থেকে মুলতান হয়ে মিরাট পর্যন্ত আঁকাবাঁকা পথে অগ্রসর হয়েছেন। ইয়াহিয়া-বিন্ আমদের মতে, এই পথ ছিল পাঞ্জাব, সিরহিন্দ, লাহোর, সামানা, বদাউন হয়ে দিল্লির সন্নিকট পর্যন্ত। ফেরিস্তা লিখেছেন : মুলতান, লামঘান হয়ে দিল্লিতে মোঙ্গলরা উপস্থিত হয়েছিল। আবার হাজি দবির লিখেছেন যে, তরমাশিরিন ও তাঁর বাহিনী একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে নানা পথ ধরে দিল্লির দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। মোঙ্গলদের ভারত ছেড়ে যাবার বর্ণনা প্রসঙ্গেও এই বিরোধ লক্ষ্য করা যায়। ইসামীর মতে, সুলতান মহম্মদ থানেশ্বর পর্যন্ত মোঙ্গলদের পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন। ইয়াহিয়া-র মতে, সুলতান মোঙ্গলদের কালানুর পর্যন্ত তাড়া করেছিলেন। অন্যদিকে তৈমুরের চতুর্থ পুত্র উলুঘবেগ মির্জার উদ্যোগে রচিত ‘শাহজারাত-উল-আত্রক’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, দিল্লির সুলতান মহম্মদ মোঙ্গলদের আদৌ পশ্চাদ্ধাবন করেননি। তরমাশিরিন স্বেচ্ছায় দিল্লি থেকে গুজরাট হয়ে সোমনাথ ও সুরাট লুণ্ঠন করে স্বরাজ্যে ফিরে যান। ড. হোসেন লিখেছেন : “Here is a complex network of paths, not adjustable harmoniously on any atlas of physical and political geography.”
ইবন বতুতা’র বিবরণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাঁর বিবরণ থেকে অনুমিত হয়, তরমাশিরিন ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং দিল্লির সুলতান তথা মুসলমানদের সুহৃদ। পারিবারিক কিছু রীতি ভঙ্গ করার জন্য তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং সমরখন্দের কাছে নিহত হন। অন্য কোনো ব্যক্তি তরমাশিরিনের নাম ভাঁড়িয়ে মুলতানে প্রবেশ করেছিলেন। একথা জানতে পেরে মহম্মদ-বিন-তুঘলক তাঁকে তিরস্কৃত করেন এবং পাঁচ হাজার টঙ্কা অনুদান হিসেবে দান করে স্বদেশে পাঠিয়ে দেন। ড. মেহদী হোসেন মনে করেন, ইবন বতুতার বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা সারবত্তা আছে। তবে তরমাশিরিন ভারতে আসার আগেই নিহত হয়েছিলেন কিনা তা বলা সম্ভব নয়। সম্ভবত, ভাগ্যবিপর্যয়ের ফলে তিনি মিত্র-শাসক দিল্লির সুলতানের সাহায্যপ্রার্থী হন। অনুগত সেনাবাহিনী ও পাত্রমিত্রসহ তরমাশিরিন মুলতান, পাঞ্জাব হয়ে দিল্লির সন্নিকটে উপস্থিত হন। সুলতান তাঁকে পাঁচ হাজার দিনার সাহায্য হিসেবে দেন। অতঃপর মোঙ্গলনেতা ভারত ছেড়ে চলে যান। অবশ্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, ড. হোসেনের বক্তব্য বহুলাংশে অনুমানভিত্তিক এবং সমসাময়িক অন্যান্য তথ্য দ্বারা সমর্থিত নয়। ড. উলসী হেগ-এর মতে, তরমাশিরিন আক্রমণ অবশ্যই করেছিলেন, তবে সুলতান উৎকোচ প্রদান করে মোঙ্গল নেতাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন, একথা বিশ্বাস করা কঠিন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদও মনে করেন, ফেরিস্তার বিবরণ অন্যান্যদের তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্য। বিভিন্ন সূত্র বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মহম্মদ-বিন-তুঘলক ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তবে ইউসুফ বুঘরা মোঙ্গলদের পরাজিত ও বিতাড়িত করার ফলে মহম্মদ তুঘলক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ছাড়াই এই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
Leave a comment