মেহেরগড়বাসীর জীবিকা ছিল কৃষি, পশুপালন, ব্যাবসাবাণিজ্য ও বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম।

[1] পশুপালন: বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় যে, মেহেরগড়বাসীরা পশুপালনকে জীবিকা অবলম্বনের উপায় হিসেব গ্রহণ করেছিল। গৃহপালিত পশুদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল গােরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ, ষাঁড়, কুকুর প্রভৃতি।

[2] কৃষিকাজ: প্রথম থেকেই মেহেরগড়বাসীরা কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচিত ছিল। তাদের উৎপাদিত ফসল ছিল যব, গম, তুলাে, খেজুর প্রভৃতি। কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অশ্লে তারা ছােটো ছােটো জলাধার নির্মাণ করে জলসেচের ব্যবস্থা করেছিল। উৎপাদিত শস্য, মজুত রাখার জন্য তারা বড়াে বড়াে শস্যাগার নির্মাণ করতে শিখেছিল।

[3] শিকার: অনেক মেহেরগড়বাসী নিকটবর্তী নদী ও জলাশয় থেকে মাছ ও বনের জন্তুজানােয়ার শিকার করে জীবিকা চালাত।পাথর ও পশুর হাড়ের তৈরি হাতিয়ার দিয়ে তারা শিকার করত।

[4] ব্যাবসাবাণিজ্য: মেহেরগড়বাসী আন্তর্বাণিজ্যের পাশাপাশি বহির্বাণিজ্যেও লিপ্ত ছিল। আফগানিস্তান, মেসােপটেমিয়া ও ইরানের সঙ্গে তারা ব্যাবসাবাণিজ্য চালাত বলে অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন।

[5] শিল্প

  • মৃৎশিল্প: মেহেরগড়ের বাসিন্দারা বিভিন্ন মৃৎপাত্র তৈরি করতে শিখেছিল। এই সভ্যতায় টেরাকোটার হলুদ কালাে রঙের জ্যামিতিক নকশাবিশিষ্ট মাটির পাত্রের বহুল প্রচলন ঘটে। এসময়ে পােড়ামাটির তৈরি নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি নির্মাণ শুরু হয়।

  • ধাতুশিল্প: মেহেরগড়ের ধাতুশিল্পীরা তামা গলিয়ে তাকে ব্যবহারযােগ্য ধাতুতে পরিণত করার কৌশল জানত। তারা ব্যবহারের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র যেমন- পুঁতি, আংটি, ছুরি, বড়শি-সহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে।

  • অলংকার শিল্প: মেহেরগড়বাসী তুরপুন জাতীয় যন্ত্র দিয়ে পাথর কেটে অলংকার তৈরিতে দক্ষ ছিল। তুরপুন নামক যন্ত্র দিয়ে তারা বৈদূর্যমণি বা লাপিস লাজুলি, টার্কোয়াজ বা নীলকান্তমণি প্রভৃতি শক্ত পাথরের মালা এবং নদীর ঝিনুক দিয়ে হার, লকেট, বালা, আংটি ইত্যাদি তৈরি করত।

  • বয়নশিল্প: পশুর লােম এবং উল দিয়ে মেহেরগড়বাসী কাপড় বুনতে শিখেছিল। এ প্রসঙ্গে ইরফান হাবিব বলেছেন—“মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্বে আগুনে পােড়া তুলােবীজের নিদর্শন মেলে, যা প্রমাণ করে মেহেরগড়বাসী সুতিবস্ত্র বুনতে জানতা”

প্রাচীন সভ্যতা মেহেরগড়ের আনুমানিক তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালে বিভিন্ন কারণে পতন ঘটেছিল।

[1] জলবায়ুর পরিবর্তন: ঐতিহাসিকদের অনুমান মেহেরগড় অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় বৃষ্টিপাত কমে যায়। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির ফলে সমগ্র অঞ্চলটি ধীরে ধীরে মরুভূমির রূপ নেওয়া শুরু করলে মেহেরগড়বাসীরা অন্যত্র সরে যায়। ফলে অঞ্চলটি জনমানবশূন্য হয়ে় একসময় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

[2] প্রাকৃতিক বিপর্যয়: বন্যা বা ভূমিকম্প এই দুই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে কোনাে একটি মেহেরগড় সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন।

[3] বাসভূমির পরিবর্তন: পণ্ডিতদের অনুমান মেহেরগড়বাসী উন্নত জীবন যাপন ও নিশ্চিত খাদ্যসংস্থানের লক্ষ্যে হরপ্পা, মহেনজোদারাের দিকে সরে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল।

[4] বহিঃশত্রুর আক্রমণ: মেহেরগড়ের সঙ্গে ইরান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান-এর বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্র ধরে, বিদেশি শত্রুরা এখানে আসে ও অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এই সভ্যতাকে ধ্বংস করে বলে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন।

উপসংহার: মেহেরগড়বাসীরা অজানা কোনাে কারণে স্বভূমি পরিত্যাগ করে পাঞ্জাবের হাক্রা নদী উপত্যকা অঙ্কুলে এসে (আনুমানিক ২৫০০ খ্রি.পূ.) এক সভ্যতা গড়ে তােলে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা হরপ্পা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায় বলে অধিকাংশ গবেষক মত প্রকাশ করেছেন।