বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘মেঘমল্লার’। এই গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট গল্প। ‘মেঘমল্লার’ একটি গল্প-সংকলন গ্রন্থও বটে। ১৯৩১ সালে বিভূতিভূষণের এই প্রথম গল্প গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
‘মেঘমল্লার’ গল্পটি একেবারেই কল্পিত। প্রাচীন বৌদ্ধযুগের শেষপাদের কাহিনীই এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। উত্তর ভারতের প্রাচীন বিখ্যাত জনপদের (বিদিশা, কৌশাম্বী, কাশী) কাছাকাছি অঞ্চলে এই কাহিনীর পটভূমিকার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।
বিভূতিভূষণ আদ্যন্ত একজন প্রকৃতিপ্রেমিক। তাঁর প্রত্যেকটি রচনায় প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে উপস্থিত থাকে। ‘পথের পাঁচালী’তে যেমন নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতি অসাধারণ প্রাজ্জ্বলতায় আমাদের সামনে ধরা দেয়, কিশোর অপুর মনেও তাদের গ্রামের সেই প্রকৃতি যেন মায়াঞ্জন সৃষ্টি করে। ‘আরণ্যক’-এ সত্যচরণের কাছে লবটুলিয়া-নলহাড়া-বইহার এর জঙ্গল সরস্বতী কুণ্ডীর অসাধারণ রূপ এক অপরূপ মোহময়তায় ধরা দেয়। আর অরণ্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করার জন্য বারবার নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকে। ‘পুইমাচা’ গল্পে পুঁইলতার বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তির বেড়ে ওঠাকে আশ্চর্যভাবে মিলিয়েছেন বিভূতিভূষণ।
প্রকৃতিপ্রেমিক যাঁরা হন তাঁদের অন্তরপ্রকৃতি অনেকটা শান্ত ও সমাহিত হয় এটা বলাই যায়। বিভূতিভূষণ সেই ধরনেরই মানুষ ছিলেন। তাঁর লেখার প্রকৃতিও আমাদের চোখে শান্ত ও স্থির। সেই প্রকৃতি একটু যেন নির্জন। ‘মেঘমল্লার’ গল্পে বর্ণিত বৌদ্ধ বিহার এর আশপাশের প্রকৃতিও বিজন। কিশোর অপুর মত এই গল্পে তরুণ প্রদ্যুম্নও প্রকৃতিকে ভালোবাসে এবং সে নিজে সুরসাধক। যিনি শিল্পী মানুষ তিনি তো প্রকৃতিপ্রেমিক হবেনই।
‘মেঘমল্লার’ সঙ্গীতের এই রাগটি বর্ষাকালীন রাগ। এই গল্পের নায়ক চরিত্র প্রদ্যুম্ন ভাল বাঁশি বাজাতে পারে এবং সে এই রাগটি বাঁশিতে ভাল বাজাতে পারে। আমরা গল্পে দেখি আসন্ন বর্ষার প্রকৃতি খুব সুন্দরভাবে চিত্রিত।
গল্পটি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন প্রকৃতির কাঁধে ভর দিয়ে চলে। অসম্ভব সুন্দর একটি পরিবেশ। মন্দিরের ওপর দশপারমিতার মন্দির। জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি তিথিতে মন্দিরে উৎসব তাই ঐ অঞ্চলের মেয়ে পুরুষ সবাই ভিড় করেছে সেখানে। প্রদ্যুম্নও সেখানে গেছে ভাল বীণ বাজিয়ের সন্ধানে। মন্দির থেকে নেমে আসার সময় প্রদ্যুম্নর চোখে ভেসে ওঠে আসন্ন বর্ষা-র একটুকরো ছবি— “প্রদ্যুম্ন দেখলে দুরে নদীর ধারে মন্দিরটার চূড়া দেখা যাচ্ছে। চূড়ার মাথার উপরকার ছায়াছন্ন আকাশ বেয়ে ঝাপসা ঝাপ্সা পাখীর দল ডানা মেলে বাসায় ফিরছিল। আরও দূরে একখানা সাদা মেঘের প্রান্ত পশ্চিমদিকের পড়ন্ত রোদে সিঁদুরের মত রাঙা হয়ে আসছিল, চারিধারে তার শীতোজ্জ্বল মেঘের কাঁচুলি হালকা করে টানা।”
পূর্বেই বলেছি জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি তিথিতে দশপারমিতার পুজো সুতরাং প্রকৃতিচিত্র-র আভাসে বর্ষা যে আসন্ন সেটা ব্যক্ত হয়েছে অসাধারণ কবিত্বময় ভাষায়।
প্রদ্যুম্ন এরপরে যখন বিহারে ফিরে যাওয়ার জন্য পথ ধরে তখন ‘পূর্ণিমার শুভ্রোজ্জ্বল জ্যোৎস্না পথ ঘাট ধুইয়ে দেয় এবং প্রদ্যুম্নর প্রিয়া সুনন্দা যখন গাছের আড়াল থেকে তাকে ডাকে তখন ‘গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। চিকচিকে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে তার সর্বাঙ্গে আলো-আঁধারের জাল’ বোনে।
গল্পের নামকরণেই সঙ্গীতের মাধুর্য লেগে আছে, সুতরাং প্রকৃতি বর্ণনার সঙ্গীতময়তার বিচ্ছুরণ হওয়া স্বাভাবিক। প্রদ্যুম্নর বাঁশি বাজানোর মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে যে আলোড়ন ঘটে তাও মূর্ত হয়ে ওঠে গল্পকারের সহৃদয় বর্ণনায়— “লতাপাতা ফুলফলের মাঝখান বেয়ে উদার নীল আকাশ আর জ্যোৎস্না রাতের মর্ম ফেটে যে রসধারা বিশ্বে সব সময় ঝরে পড়ছে, তার বাঁশীর গানে সে রস যেন মূর্ত হয়ে উঠল।….”
‘মেঘমল্লার’ যেহেতু বর্ষার রাগ এবং বর্ষার আকাশ থেকে পতিত রসধারা তাই বিভূতিভূষণ এভাবে বর্ণনা করেছেন।
নববর্ষার আগমন বার্তাও গল্পকারের কলমে সজল মেঘের মতোই সজীব— “ভদ্রাবতী নদীর ধারে শাল-পিয়াল-তমাল বনে সেবার ঘনঘোর বর্ষা নামল। সারা আকাশজুড়ে কোন্ বিরহিনী পুরসুন্দরীর অযত্নবিন্যস্ত মেঘবরণ চুলের রাশ এলিয়ে দেওয়া, প্রাবৃট রজনীর ঘনাধকার তার প্রিয়হীন প্রাণের নিবিড় নির্জনতা, দূর বনের ঝোড়ো হাওয়ায় তার আকুল দীর্ঘশ্বাস, তারই প্রতীক্ষাশ্রান্ত আঁখি-দুটির অশ্রুভারে ঝরঝর অবিশ্রান্ত বারিবর্ষণ, মেঘমেদুর আকাশের বুকে বিদ্যুৎচমক তার হতাশ প্রাণে ক্ষণিক আশার মেঘদূত।”
বহুদিন পূর্বে প্রাচীনকালে মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের অভিশাপগ্রস্ত যক্ষ এবং তার বিরহক্লিষ্টা প্রিয়ার কথাই যেন চকিতে মনে পড়ে যায় এই অংশে।
প্রদ্যুম্ন যখন গুণাঢ্য ওরফে সুরদাসের সঙ্গে আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাতে মেঘমল্লার আলাপ করে দেবী সরস্বতীকে মুগ্ধ করার জন্য সাধনায় বসে তখন সেই রহস্যময় প্রকৃতির বর্ণনাও অসাধারণ ভাবে ফুটে ওঠে। দেবী সরস্বতী মর্ত্যে আবির্ভূত হওয়ার আগের এই বর্ণনা অত্যন্ত রহস্যাবৃত— “তখন আকাশ বাতাস নীরব। অন্ধকারে সামনের মাঠটায় কিছু দেখবার উপায় নেই। শালবনের ডালপালায় বাতাস লেগে একরকম অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। বড় মাঠের পারে শালবনের কাছে দিকচক্রবালের ধারে নৈশ প্রকৃতি পৃথিবীর বুকের অন্ধকার শল্পশয্যায় তার অঞ্চল বিছিয়েছে শুধু বিশ্রাম ছিল না ভদ্রাবতীর, সে কোন্ অনন্তের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেবার আকুল আগ্রহে একটানা বয়ে চলেছে, মৃদু গুঞ্জনে আনন্দসঙ্গীত গাইতে গাইতে, কূলে তাল দিতে দিতে। হঠাৎ সামনের মাঠটা থেকে সমস্ত অন্ধকার কেটে গিয়ে সারা মাঠটা তরল আলোকে প্লাবিত হয়ে গেল।”
প্রদ্যুম্নর বাঁশিতে ‘মেঘমল্লার’ এর সুর বাজানো কিংবা এটা শুনে দেবী সরস্বতীর মর্ত্যাবতরণ সবই গুণাঢ্য ওরফে সুরদাসের তান্ত্রিক শক্তি বলে। এই সমস্ত ঘটনা প্রদ্যুম্নর কাছে অত্যস্ত রহস্যময় ঠেকেছে, অসংলগ্ন ঠেকেছে সুরদাসের কথাও। ফলে সে যখন বিহারে ফিরছে তখনকার প্রকৃতিও যেন তার কাছে অত্যন্ত রহস্যময়— “পূর্ণিমার চাঁদকে তখন মেঘে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। একটু একটু জ্যোৎস্না যা আছে, তা কেমন হলদে রং এর; গ্রহণের সময় জ্যোৎস্নার এরকম রং সে কয়েকবার দেখেছে।”
বৌদ্ধ বিহারের আচার্য পূর্ণবর্ধন-এর কাছে সুরদাসের আসল পরিচয় ও তন্ত্রমতে দেবী সরস্বতীর বন্দিনী হবার কাহিনী শুনে দেবীর সন্ধানে বিহার পরিত্যাগ করে নানা দেশে ঘুরে শেষে ঊরুবিশ্ব গ্রামে এসে পৌঁছায় প্রদ্যুম্ন। এবং এখানেই ‘ঘটকক্ষে এক স্ত্রীলোক’ই যে দেবীর মানবী রূপ সেটা বুঝতে পারে। আসন্ন সন্ধ্যায় সেই স্ত্রীলোককে দেখে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে জল নিয়ে নেমে আসতে। গোধূলি বেলার সেই ছবিও চমৎকার ফুটে ওঠে— “সন্ধ্যা তখনও নামেনি, ঝিরঝিরে বাতাসে গাছের পাতাগুলো নাচছে, পাশে মাঠে পাকা শস্যের শীর্ষগুলো সোনার মত চিক্মিক্ করছে, একটু দূরে একটা ডোবার মত জলাশয়ে বিস্তর কুমুদ ফুল ফুটে আছে, অনেক বন্যহংস তার জলে খেলা করছে।”
এরপর দেবীর সঙ্গে প্রদ্যুম্নর পরিচয় হয়, মন্ত্রবলে দেবী আত্মবিস্মৃতা। গুণাঢ্যের সঙ্গে দেখা হলে প্রদ্যুম্ন নিজ জীবন বিপন্ন জেনেও দেবীর মুক্তির কথা ভাবেন। গুণাঢ্যের দেওয়া মন্ত্রপূত জল দেবীর গায়ে ছিটিয়ে দিলে তিনি হয়ত মুক্তি পাবেন কিন্তু প্রদ্যুম্ন জড়তাপ্রাপ্ত হবে। এইটা ভেবেও প্রদ্যুম্ন এ কাজে অগ্রসর হয়েছে কারণ নিজের জীবনের থেকেও বিদ্যা-সংস্কৃতির দেবীর মুক্তি তার কাছে বেশি প্রয়োজন। বেতস বনে ছায়া নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রদ্যুম্নর জীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটছে তা দেখিয়ে দেন বিভূতিভূষণ।
এদিকে প্রদ্যুম্নর প্রিয়া সুনন্দা প্রদ্যুম্নকে কাছে পাবার জন্য ‘কুমারশ্রেণীর বিহারে’ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে। প্রদ্যুম্ন যখন দেবীর সন্ধানে যায় তখন সে বলেছিল ফিরে আসবে। তাই সুনন্দা প্রতিদিনই অপেক্ষায় থাকে। সে তো জানে না তার প্রিয়তম পাষাণবৎ হয়ে উরুবিল্ব গ্রামে রয়েছে। সে আর কোনও দিনও ফিরবে না।
এই সময় সুনন্দা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত, যা গল্পের কাহিনী অনুযায়ী সত্য বলেই প্রতিভাত হয় আমাদের সামনে। এবং এই অংশেও প্রকৃতিচিত্রই প্রধান হয়ে ওঠে— “এক এক রাত্রে সে বড় অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। কোথাকার যেন কোন এক পাহাড়ের ঘন বেতের জঙ্গল আর বাঁশের বনের মধ্যে লুকানো এক অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি। নিঝুমরাতে সে পাহাড়ের বেতগাছ হাওয়ায় দুলছে, বাঁশবনে সিরসির শব্দ হচ্ছে, দীর্ঘ দীর্ঘ বেতডাটার ছায়ায় পাষাণমূর্তিটার মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। সে অন্ধকার অর্ধরাত্রে জনহীন পাহাড়টার বাঁশগুলোর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে কেবল বাজছে মেঘমল্লার…”
এই প্রকৃতিচিত্রণের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় প্রদ্যুম্ন আর জীবিত নেই। বেতের আর বাঁশের জঙ্গলের মাঝে ‘অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি’ যে প্রদ্যুম্নই সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতির এই বর্ণনায় আমাদের হৃদয়ও রসার্ত্র হয়ে ওঠে। যে মেঘমল্লার ধ্বনিত হত প্রদ্যুম্নর বাঁশিতে এবং তা তুফান তুলত সুনন্দার হৃদয়েও সেই রাগই ধ্বনিত হয়ে ফিরছে প্রদ্যুম্নর পাযাণমূর্তির কাছে। এই গল্পের ঘটনা সংস্থান ও চরিত্রের টানাপোড়েনও আন্দোলিত হয় বিভূতিভূষণের অসাধারণ প্রকৃতি বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে।
Leave a comment