আমরা জানি, স্বপ্ন হল আমাদের অবচেতন মনের একটা প্রক্রিয়া। আমরা সারাদিন ধরে যা ভাবি তাই রাতে নিদ্রার অবচেতনে মনে রেখাপাত ঘটায়। আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব, হতাশা কিংবা না পাওয়ার বেদনা, পরাজয়ের গ্লানি স্বপ্নের মধ্যে জয়ের ব্যঞ্জনা এনে দেয়। রাতের নিদ্রাকে সুখানুভূতির স্পর্শ এনে দেয় স্বপ্ন। না পাওয়ার বাস্তবটা অলীকভাবে হাতের মুঠোয় এনে দেয় স্বপ্ন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে স্বপ্ন একটা অলীক কিংবা অবাস্তব ব্যাপার। আমাদের নৈরাশ্যের দিকটা কিংবা কোনো ভবিষ্যত আশা অবচেতন মনে স্বপ্নের রূপে নিদ্রার মধ্যে মননে জেগে ওঠে, আবার নিদ্রা ভেঙ্গে গেলে বাস্তবে ফিরে আসি আমরা।
সাহিত্যে এই স্বপ্নদৃশ্য বারবার এসেছে। উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের কাহিনীর ঘটনা সংস্থাপনে এই স্বপ্নদৃশ্য বারবার সহায়তা করেছে। এই অলীক অবাস্তব ব্যাপার কাহিনীর ঘটনাকে আরও জারিত করে তোলে। শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে যে স্বপ্নদৃশ্যের কথা আছে সেই দৃশ্য কিন্তু একদিন সত্যি হয় এবং ম্যাকবেথ-এর পতন ডেকে আনে। এছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে কুন্দনন্দিনী স্বপ্নদৃশ্যে তার মা তাকে যে সমস্ত ব্যক্তিদের হাত থেকে (নগেন্দ্র, হীরা দেবেন্দ্র) দূরে সরে থাকতে বলেছিলেন সেই সমস্ত ব্যক্তিরাই পরে কিন্তু কুন্দর সর্বনাশের কারণ হয়। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাস্তব জীবনে স্বপ্ন যতই অলীক কিংবা অবাস্তব হোক না কেন সাহিত্যের ঘটনার গুরুত্বে স্বপ্নদৃশ্যের একটা ভূমিকা থাকেই।
বিভূতিভূষণের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘মেঘমল্লার’। এই গল্পের ঘটনার কেন্দ্রেও আছে দুটি স্বপ্নদৃশ্য। এই দৃশ্য দুটি ঘটনার সত্যতাকে চিহ্নিত করেছে। স্বপ্ন যতই অবাস্তব হোক না কেন বিভূতিভূষণ এই গল্পে স্বপ্নদৃশ্যকে সংযুক্ত করেছেন গল্পের স্বাথেই। স্বপ্নদৃশ্য দুটি খুব সুন্দরভাবে সত্য ঘটনার একটা রেশ আমাদের সামনে বয়ে আনে।
গল্পের নায়ক প্রদ্যুম্ন যখন সুরদাস ওরফে গুণাঢ্য-র সঙ্গে গিয়ে বাঁশিতে মেঘমল্লারের তান তুলে দেবী সরস্বতীকে মোহিত করে মর্তো নিয়ে আসে তখন ভদ্রাবতী নদীর আশপাশের অঞ্চল জ্যোৎস্নালোকিত হয়ে পড়ে দেবীর রূপে। এরপর সুরদাস প্রদ্যুম্নকে বিহারে ফিরে যেতে বলে। সুরদাস তান্ত্রিক মতে পূজাচনা করছিল তাই তার কথাও অসলংগ্ন লেগেছিল প্রদ্যুম্নর। সে বিহারে ফিরে আসার সময় পিপ্পল বনের মধ্যেও দিশাহারা দেবীর মূর্তিকে লক্ষ্য করে। এরপরে সে বিহারে ফিরে আসে। ভোর রাত্রে সে শয্যায় ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে— “ভদ্রাবতীর গভীর কালো জলের তলায় রাতের অন্ধকারে কে এক দেবী পথ হারিয়ে ফেলেছেন; তিনি যতই ওপরে ওঠবার চেষ্টা পাচ্ছেন, জলের ঢেউ তাঁকে ততই বাধা দিচ্ছে, নদীর জলে তাঁর অঙ্গের জ্যোতি ততই নিবে আসছে, অন্ধকার ততই তাঁর চারিপাশে গাঢ় হয়ে আসছে, নদীর মাছগুলো তাঁর কোমল পা দুখানি ঠুকরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে…. ব্যথিত দেহা, বিপন্না, বেপথুমতী দেবীর দুঃখ দেখে একটা বড় মাছ দাঁত বার করে হিংস্র হাসি হাসছে, মাছটার মুখ গায়ক সুরদাসের মত।”
প্রদ্যুম্ন সন্ধেবেলাতেই মেঘমল্লার রাগ বাজিয়ে দেবীকে মর্ত্যে আনয়ন করেছে, দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়েছে আবার পিপ্পল বনের মধ্যেও তাঁকে পথহারা অবস্থায় দেখেছে। এই অসম্ভব ঘটনার সাক্ষী থাকার জন্য নিদ্রার অবচেতনেও সরস্বতীর ভাবনা আসা স্বাভাবিক। কিন্তু আচার্য পূর্ণবর্ধনের কাছে যখন জানা যায় যে সুরদাস একজন তান্ত্রিক এবং তার আসল নাম গুণাঢ্য এবং সে তন্ত্র বলে দেবীকে বন্দিনী করার জন্যই প্রদ্যুম্নকে দিয়ে। বাঁশিতে মেঘমল্লারের সুর বাজিয়েছে তখন স্বপ্নদৃশ্যের অবাস্তবতাটা আর অলীক থাকে কী?
হিংস্র মাছ দাঁত বার করে দেবীর পা রক্তাক্ত করে দিচ্ছে এটাতে সাহিত্যিক কল্পনা থাকলেও সুরদাস বা গুণাঢ্যের তন্ত্রবলে দেবী যে বন্দিনী এবং ‘ব্যথিত দেহা’, ‘বিপন্ন’ এবং ‘বেপথুমতী’ তো বটেই। সেটা আমরা পরের ঘটনাক্রমেই লক্ষ্য করি। দেবী সরস্বতী যিনি অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের বিদ্যা-সংস্কৃতি-চারুকলার দেবী তাঁর অবস্থান হয় পর্ণকুটীরে, কায়ক্লেশে বিস্মৃতমনা হয়ে দিনযাপন। সারা দিনের জল আনার জন্য বহুদূরে পাহাড় অতিক্রম করে ‘ঘটকক্ষে’ যেতে হয়। আর তান্ত্রিক সুরদাস যে সত্যিই হিংস্র তার প্রমাণ তো আমরা পাই-ই। একে তো সে ছলে-বলে-কৌশলে দেবীকে বন্দিনী করে রেখেছে আবার ছলনার আশ্রয় নিয়ে প্রদ্যুম্নকেও ঠেলে দেয় মৃত্যুমুখে। গল্পে এই স্বপ্নদৃশ্যের সত্যিই সত্যতা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় স্বপ্নদৃশ্যটি গল্পের একেবারে শেষে ঘটে। এই স্বপ্নটি দেখে প্রদ্যুম্নর ভালোবাসার সাথী সুনন্দা। প্রদ্যুম্ন যখন দেবীর সন্ধানে নানা দেশ ঘুরতে যায় তখন সুনন্দাকে বলে যায় বিহারে ফিরে আসবে কিন্তু গল্পের ঘটনা অনুযায়ী আমরা জানি প্রদ্যুম্ন গুণাঢ্যের দেওয়া মন্ত্রপূত জল দেবীর গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে দেবীকে মুক্ত করে কিন্তু মন্ত্রগুণে নিজে জড়তাপ্রাপ্ত হয়। কোনওদিনও আর সে বিহারে ফিরতে পারবে না। এদিকে সুনন্দাও শ্রেষ্ঠী পিতার স্নেহাশ্রয় ছিন্ন করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে প্রিয়তম প্রদ্যুম্ন সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে পারবে বলে। কিন্তু প্রদ্যুম্ন আর আসে না সুনন্দার প্রতীক্ষা অন্তহীন হয়ে পড়ে। এইসময়ই এক এক রাত্রে সে প্রিয়র কথা ভেবে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখত। সারাদিনই সে প্রদ্যুম্নর প্রতীক্ষায় থাকত সুতরাং রাত্রে অবচেতনে সুনন্দার প্রদ্যুম্নর চিন্তা আসাই স্বাভাবিক কিন্তু সে যে স্বপ্নটা দেখত সেটা কিন্তু অনেকাংশে ঠিকই— “কোথাকার যেন কোন এক পাহাড়ের ঘন বেতের জঙ্গল, আর বাঁশের বনের মধ্যে লুকানো এক অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি। নিঝুম রাতে সে পাহাড়ের বেতগাছ হাওয়ায় দুলছে, বাঁশবনে সিরসির শব্দ হচ্ছে, দীর্ঘ দীর্ঘ বেতর্ডাটার ছায়ায় পাষাণমূর্তিটার মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। সে অন্ধকার অর্ধরাত্রে জনহীন পাহাড়টার বাঁশগুলোর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে কেবল বাজছে মেঘমল্লার…”
প্রদ্যুম্ন যেখানে দেবী সরস্বতীর সন্ধান পায় সেখানে ঘন বেতের জঙ্গল ছিলই আর প্রদ্যুম্ন গুণাঢ্যের মন্ত্রপূত জলে পাষাণমূর্তিতে পরিণত হয়েছে এগুলি একেবারেই সঠিক। বহুদূরে নিদ্রাভিভূত হয়ে সুনন্দা যা স্বপ্ন দেখে তা একেবারে সত্য হয়ে ওঠে গল্পে। আর প্রদ্যুম্ন বাঁশি বাজাতে পারষ্কাম ছিল। বাঁশিতে মেঘমল্লারের তান তুলে সে যেমন দেবী সরস্বতীকে মর্ত্যভূমিতে টেনে এনেছিল তেমনি কোনও কোনও দিন সুনন্দার হৃদয়েও তুফান তুলত, নিদ্রার অবচেতনে সুনন্দা দেখে ঐ পাযাণমূর্তিটির কাছে বাঁশে মেঘমল্লারের সুর ওঠে, সুনন্দা না জানলেও আমরা জানি ঐ পাষাণমূর্তি প্রদ্যুম্নর সুতরাং তার কাছে বাতাসের দোলা মেঘমল্লারের ধ্বনি তোলে এবং স্বপ্নের মাধ্যমে সুনন্দাকে জানান দিয়ে যায় বহুদূরে বেতবনে ‘অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি’ তার প্রিয়তমর। এই স্বপ্ন সত্যি তো বটেই আবার গল্পের শেষে এই স্বপ্নদৃশ্যের রেশ দুই প্রেমাস্পদের বিচ্ছেদ আমাদের মনে বিষাদের সুর এনে দেয়।
বঙ্কিমের উপন্যাসের মত বিভূতিভূষণের এই গল্পেও দুটি স্বপ্নদৃশ্য গল্পের ঘটনা সঙ্গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এটা বলাই যায়।
Leave a comment