বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ছোটগল্প ‘মেঘমল্লার’। ১৯৩১ সালে ‘মেঘমল্লার’ শীর্ষক এই গল্পসংকলনটি প্রকাশিত হয়। মোট দশটি গল্প রয়েছে এই সংকলনে, এর মধ্যে তৃতীয় গল্পটিই ‘মেঘমল্লার’। প্রাচীন ভারতের প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধযুগ ও তান্ত্রিক যুগের মধ্যবর্তী ‘কাল’কে আশ্রয় করেই এই গল্পের কাহিনী গড়ে উঠেছে।

বিভূতিভূষণের রচনায় নারী চরিত্রগুলির পৃথক একটি মর্যাদা রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্রগুলি যেমন অভিজাত-উচ্চবিত্ত পরিবারের বধূ কিংবা কন্যা, আপন ব্যক্তিত্বের মহিমায় তাঁরা উজ্জ্বল। সূর্যমুখী কুন্দনন্দিনী-ভ্রমর-রোহিনী-দেবী চৌধুরানী-বিনোদিনী-দামিনী-বিমলা-কুমুদিনী প্রভৃতি নারী চরিত্রগুলির দার্ঢ্য বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত। শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্রগুলির মধ্যে যেমন আছে বাঈজী, তেমনি আছে গ্রামের মর্যাদাসম্পন্ন গৃহবধূ (সুনন্দা), কমললতার মত বৈষুবী, সমাজের যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া জ্ঞানদা কিংবা অভাগী-র মত চরিত্র। আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন এবং ভালোবাসাপরায়ণা সাবিত্রীর মত পরিচারিকা। সমাজের সর্বস্তর থেকে উঠে আসা নারীরা শরৎচন্দ্রের রচনায় কথা বলে উঠেছে। ‘বুক ফেটে গেলেও যাঁদের ‘মুখ ফোটে’ না সেই সমস্ত নারীরা স্ব-মহিমায় হাজির তাঁর রচনায়।

কিন্তু বিভূতিভূষণ এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। তাঁর নারীরা স্বভাবতই কোমল এবং স্নেহশীলা। পল্লীবাংলার ‘বুক ভরা মধু বঙ্গের বধূ’দের তিনি যেন অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে তুলে এনেছেন। পরিবারের বধূস্থানীয়া নারীরা তাঁর কলমে তো এসেইছে তেমনি আবার কিশোরী নিষ্পাপ অপাপবিদ্ধা নারীরাও তাঁর লেখনীর আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সর্বজয়া অন্নপূর্ণার মত মায়েরা যেমন আছে তেমনি ক্ষেন্তি দুর্গা সুনন্দা প্রভৃতি কম বয়েসী কিশোরী মেয়েরাও উপস্থিত তাঁর রচনায়। প্রত্যেকটি নারী চরিত্র যেমনই হোক না কেন তাদের অন্তঃস্থলে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত মমত্ববোধ প্রবাহিত। দুর্গা তার ভাই অপুর প্রতি মমতাময়ী। সে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ‘নেবুর পাতায় করমচা/হে বৃষ্টি ধরে যা’ বলে ভাইকে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে গাছের তলায় বসেছে। ক্ষেস্তিও অন্যান্য বোনেদের প্রতি রসার্দ্র।

‘মেঘমল্লার’ গল্পে সুনন্দা চরিত্রটি বেশ কম। একেই এটি ছোটগল্প এবং তার উপর গল্পটি দেবী সরস্বতীর বন্দিনী অবস্থা এবং তা থেকে তাঁকে কিভাবে গল্পের নায়ক চরিত্র প্রদ্যুম্ন মুক্তি দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করলো সেটিই বেশি করে প্রাধান্য পেয়েছে। গল্পটি প্রদ্যুম্নকে কেন্দ্র করেই বেশি আবর্তিত হয়েছে। তবুও সুনন্দার চিত্র অত্যন্ত স্বল্প পরিসরেও সুন্দরভাবে ফুটিয়েছেন বিভূতিভূষণ।

গল্পের প্রথমেই দেখি, দশপারমিতার মন্দিরে উৎসব। ভদ্রাবতী নদী তীরস্থ এবং আশপাশের গ্রামের মেয়েরা সাপুড়ের খেলা দেখবার জন্য সেখানে উপস্থিত। সেখানে বৌদ্ধ বিহারের ছাত্র প্রদ্যুম্ন যেমন উপস্থিত তেমনি মেয়েদলের মধ্যে সুনন্দাও উপস্থিত। গল্পে তার প্রথম পরিচিতি ঘটে এভাবে— “সে কিশোরী, তার দোলন-চাঁপা রং-এর ছিপছিপে দেহটি বেড়ে’ নীল শাড়ী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরা। নতুন কেনা একছড়া ফুলের মালা তাঁর খোঁপাটিতে জড়ানো।”

সুনন্দা ধনী শ্রেষ্ঠী স্যমস্তদাসের কন্যা। তারা হিরণ্যনগরের অধিবাসী। বৌদ্ধযুগে শ্রেষ্ঠীদের প্রভাব প্রতিপত্তি খুব বেড়েছিল সুতরাং তাঁরা ধনবান। সুনন্দা আবার প্রদ্যুম্নকে ভালোবাসে। সদ্য যুবক প্রদ্যুম্ন এবং কিশোরী সুনন্দার নিষ্পাপ ভালোবাসা সুন্দরভাবে ফুটিয়েছেন গল্পকার। প্রদ্যুম্ন ভাল বাঁশি বাজাতে পারে এবং বাঁশিতে মেঘমল্লারের তান তুলতে সে সিদ্ধহস্ত। সুনন্দাও প্রদ্যুম্নর এই বাঁশির ধ্বনিতে মুগ্ধ, প্রদ্যুম্নর সঙ্গে দশপারমিতার মন্দির থেকে ফেরার সময়ও সুনন্দা বাঁশির সুর শুনতে চায়।

এইসময়ই দুই কৈশোর প্রেমের স্ফূরণ দেখান বিভূতিভূষণ। বাঁশির সুরই এই প্রেমের যোগসূত্র ঘটায়। প্রদ্যুম্ন সুনন্দার সুগঠিত পুষ্পপেলব দক্ষিণ বাহুটি নিজের হাতের মধ্যে বেষ্টন করে নিয়ে প্রদ্যুম্ন বাঁশি বাজাতে প্রবৃত্ত হয়। যবে থেকে এই দুই প্রেমাস্পদের পরিচয় ঘটেছে তবে থেকেই ‘প্রদ্যুম্নর বাঁশীর অলস স্বপ্নময় সুরের মধ্যে দিয়ে কতদিন উভয়ের অজ্ঞাতে রোদ ভরা মধ্যাহ্ন গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। এর মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সুনন্দা সঙ্গীত ভালোবাসে। সঙ্গীতের সুরই তাদের প্রেমকে গাঢ়তা দেয়।

ভদ্রাবতী নদীর ধারে আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত্রে গুণাঢ্যের পরামর্শে প্রদ্যুম্ন দেবী সরস্বতীকে মর্ত্যে আনয়ন করে বাঁশিতে মেঘমল্লারের তান তুলে। এইসময়ে সুনন্দাকে আর আমরা দেখি না। গল্পে সুনন্দার প্রসঙ্গ আবার আসে গল্প শেষের মুহূর্তে।

প্রদ্যুম্ন সুরদাসের আসল পরিচয় এবং দেবী সরস্বতীর বন্দিনী হবার কাহিনী শুনে তার সন্ধানে বিহার পরিত্যাগ করে নানা দেশ পরিভ্রমণে বের হয়। সুনন্দাকে সে বলে যায় বিহারে সে ফিরে আসবে। সুনন্দা ও ধনবান পিতা স্যমস্তদাসের স্নেহচ্ছায়া ছেড়ে কুমারশ্রেণীর বিহারে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে প্রদ্যুম্নর সঙ্গে সঙ্গে থাকতে পারবে বলে। এতটাই তার প্রিয়তমের প্রতি প্রেম। ধনবান পিতার আশ্রয়, সুখশয্যা, বিবাহ সমস্ত পরিত্যাগ করে কিশোরী বয়সেই প্রব্রজ্যার মত কঠিন ব্রতকে গ্রহণ করে শুধুমাত্র প্রেমাস্পদকে কাছ থেকে দেখার বাসনায়। বিভূতিভূষণের লেখনীর আঁচড়ে এই কোমল সম্পর্ক এবং স্নিগ্ধনারী চরিত্রটি সুন্দর ফুটেছে।

আমরা রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কথা পড়েছি। বৈয়বপদকর্তাগণ বিরহিনী রাধার মূর্তি অসম্ভব সুন্দরভাবে এঁকেছিলেন। কৃষ্ণও মথুরায় যাবার সময় রাধাকে বলেছিল ফিরে আসবে বৃন্দাবনে, কিন্তু বহু যুগ কেটে গেছে বিরহিনী রাধার পথ চেয়ে থাকতে থাকতে কিন্তু কৃয় ফেরে নি। রাধার মন বৃন্দাবনে দুজনের মিলন হয়েছে কিন্তু বাস্তবে রাধা কৃষ্ণকে পায়নি। সুনন্দা ও প্রদ্যুম্নর প্রত্যাশী হয়ে যোগিনী সেজেছে জীবনের শুরুতেই কঠিনব্রতে নিজেকে সঁপেছে প্রদ্যুঙ্গকে কাছে পাবে বলে। কিন্তু সে জানে না প্রদ্যুম্ন আর ফিরবে না। দেবী সরস্বতীকে মুক্ত করতে গিয়ে সে চিরকালের জন্য প্রস্তর মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস সুনন্দার পথ চেয়ে থাকা বিফলে যায়।

সুনন্দা যেহেতু প্রদ্যুম্ন-র মনের কাছাকাছির বাসিন্দা। তাই স্বপ্নদৃশ্যে সে যে বেতবনে ‘অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি’ দেখে এবং বাঁশঝাড়গুলোর বাঁশের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে, যে মেঘমল্লার রাগের সৃষ্টি হয় তা প্রায় সত্যি। ঐ ‘অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি’ প্রদ্যুম্ন-রই এবং সে যে মেঘমল্লারে সিদ্ধ তা ঐ হাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত।

দুর্গা-ক্ষেত্তির মত সুনন্দাও বিভূতিভূষণের এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি। সে কোমলপ্রাণা সঙ্গীতপিপাসু এবং সর্বোপরি প্রেমিকা। গল্পের ছোট্ট পরিসরে চরিত্রের স্বল্পতার মধ্যেও বিভূতিভূষণ আশ্চর্য দক্ষতায় সুনন্দার প্রেমিকা সত্তাকে উদ্ঘাটিত করেন। বিভূতিভূষণের সাহিত্যে সুনন্দার স্থান হয়ত খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু আপন মাধুর্যে সে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যে।