শেক্সপিয়র তাঁর ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকে জুলিয়েটের মুখে সংলাপ হিসাবে মন্তব্য করেছিলেন, ‘what’s in a name ?? কিন্তু নাম পরিচয়ের গুরুত্ব ঐ মন্তব্য সত্ত্বেও কেউ অস্বীকার করেন না। ব্যক্তি নামের ক্ষেত্রে নাম-পরিচয়টি সর্বদা ব্যক্তিত্ব চিহ্নিত না হয়ে উঠলেও সাহিত্য বিশেষত কথাসাহিত্যে নামকরণটি বস্তুত বিষয়ের মর্মবস্তুর পরিচয়জ্ঞাপক বলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কথা সাহিত্যের নামকরণ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচিত হয়ে থাকে। প্রথমত, কথাবস্তুর কোনো প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামে গল্প উপন্যাসের নামকরণ বহু প্রচলিত। এছাড়া প্লট বা ঘটনাকে ইঙ্গিত করেও বহু সময় নামকরণ করা হয়ে থাকে। আবার কোনো সংকেত বা প্রতীকী শব্দ প্রয়োগেও সাহিত্যের নামকরণ হয় বিষয়ের মর্মগত সত্যটিকে উদ্ঘাটনের জন্য।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘মেঘমল্লার’। এই গল্প-গ্রন্থেরই শীর্ষক গল্প এটি। ধূসর রোমান্টিকচেতনা, ইতিহাসচেতনা, কল্পনার মেদুরতা, সমাজচিত্রণে এবং এক তরুণ প্রাণের আত্মবলিদানই গল্পটির প্রধান ভিত্তি।

গল্পটির প্রধান চরিত্র প্রদ্যুম্ন। তাকে কেন্দ্র করেই গল্পটি আবর্তিত। তার শিল্পীসত্তা, বিস্ময়, হতাশা, প্রেম, রোমান্টিক চেতনা ও বন্দিনীদেবীর বন্ধনদশা কাটাতে নিজের জীবনকে আত্মবিসর্জনের দিকে নিয়ে যাওয়া এই গুলিই মূল বিষয় হয়ে উঠেছে গল্পটির। সুতরাং গল্পটির নাম ‘প্রদ্যুম্ন’ রাখলেও চলত। বিভূতিভূষণেরই আর একটি গল্প যেমন ‘লোকনাথ’। কিন্তু বিভূতিভূষণ বাংলা সাহিত্যের একজন দক্ষ শিল্পী। তাই এই অসাধারণ গল্পটির নাম। ‘প্রদ্যুম্ন’ রেখে গল্পের নামকরণের সুমধুর ব্যঞ্জনাকে লঘু করতে চাননি।

গল্পটির নাম ‘মেঘমল্লার’। আমরা জানি সঙ্গীতশাস্ত্রে বর্ষাকালীন রাগকে ‘মেঘমল্লার’ নাম দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতে বহু রাগের নাম পাওয়া যায় তাঁর মধ্যে উল্লেখ্য—ভৈরব, মালব, সারঙ্গ, হিন্দোল, দীপক, মেঘমল্লার, ইমনকল্যাণ, মূলতান, ভীমপলশ্রী, মালকোষ তোড়ী, ললিত ইত্যাদি। প্রাচীনকাল থেকে ভারতে বিশিষ্ট মার্গ সঙ্গীতকারেরা বর্ষার সময় ‘মেঘমল্লার’ রাগেরই চর্চা করে আসছেন। তাল-তমাল বনে বৃষ্টিপতনের শব্দ, ময়ূরের আনন্দে পেখম তোলার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিত হতে থাকে মেঘমল্লারের ছটা।

‘মেঘমল্লার’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই ‘মেঘ’ ও ‘মল্লার’ এই দুটি শব্দ। ‘মল্লার’ শব্দের অর্থ ‘রাগ’ বা স্বর বা ধ্বনি। সুতরাং শুধুমাত্র মার্গসঙ্গীতের একটিমাত্র ‘রাগ’ই শুধু নয়, বর্ষার ‘ধ্বনি’ বা ‘স্বর’ও বোঝানো যায়। বর্ষার সময়-ক্ষণই যেখানে প্রধান হয়ে ওঠে। নিদাঘের প্রচণ্ড দাবদাহের পর বর্ষার মেঘপুঞ্জ বা বর্ষার পদধ্বনি মর্ত্যভূমিকে, জীবকুলকে সতেজ করে। সেদিক দিয়ে বর্ষার আগমন পৃথিবীতে ঈশ্বরের’ আশীর্বাদ স্বরূপ। তাল-তমাল বনে বৃষ্টিপতনের শব্দ কত সৃষ্টিশীল মানুষকে উন্মুখ করে তোলে সৃষ্টিকর্মে। জীবকুলে প্রিয়তমর সঙ্গে প্রিয়ার মেলবন্ধন ঘটার কাল হিসেবেও বর্ষাকাল বিবেচ্য হয়ে আসছে।

‘মেঘমল্লার’ গল্পটিতে আমরা দেখি বর্ষাকাল প্রাধান্য পেয়েছে। শিল্পী মানুষের কাছে বসন্ত ও বর্ষা সর্বদাই চিরকালীন তাই গল্পকারের ক্ষেত্রেও এটির অন্যথা হয় নি।

দশপারমিতার মন্দিরে পুজোর উৎসবের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে যখন গল্পের সূচনার যবনিকা ওঠে তখন দিনটিও স্পষ্ট করে দেন লেখক। সেদিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি’। সুতরাং বুঝতে পারা যায় লেখকের গল্পের ঘটনা সংঘটিত হবে বর্ষাকালের হাত ধরেই। সারা গল্পটি অনুপুঙ্খভাবে পাঠ করলে এই বর্ষাকাল এবং বর্ষাপ্রকৃতির চিত্র। পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি, সুতরাং আকাশে বাতাসে বর্ষার পদধ্বনি স্পষ্ট। তাই গল্পের নায়ক প্রদ্যুম্ন যখন দশপারমিতার মন্দির থেকে বৌদ্ধ বিহারে ফিরে আসছিল তখন প্রকৃতিচিত্রের মধ্যে আসন্ন বর্ষার ইঙ্গিত অস্পষ্ট ভাবেও ধরা পড়ে— “প্রদ্যুম্ন দেখলে দূরে নদীর ধারে মন্দিরটার চূড়া দেখা যাচ্ছে। চূড়ার মাথার উপরকার ছায়াচ্ছন্ন আকাশ বেয়ে ঝাপসা ঝাপ্সা পাখীর দল ডানা মেলে বাসায় ফিরছিল। আরও দূরে একখানা সাদা মেঘের প্রান্ত পশ্চিমদিকের পড়ন্ত রোদে সিঁদুরের মত রাঙা হয়ে আসছিল, চারিধারে তার শীতোজ্জ্বল মেঘের কাঁচুলি হাল্কা করে টানা।”

‘ছায়াচ্ছন্ন আকাশ’, ‘সিঁদুরে মেঘ’, ‘শীতোজ্জ্বল মেঘের কাঁচুলি’ ইত্যাদি শব্দবন্ধে আসন্ন বর্ষাকালের আভাস পাওয়া যায়।

আবার প্রদ্যুম্ন ও সুরদাস যখন দেবী সরস্বতীকে বংশীধ্বনি শোনাতে ভদ্রাবতী নদীর দিকে যায় তখন ঘন ঘোর বর্ষাকাল। এই বর্ষার বর্ণনাও লেখক তুলে ধরেন অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত ভাষায়— “ভদ্রাবতী নদীর ধারে শাল পিয়াল-তমাল বনে সেবার ঘনঘোর বর্ষা নামল। সারা আকাশ জুড়ে কোন বিরহিনী পুরসুন্দরীর অযত্নবিন্যস্ত মেঘবরণ চুলের রাশ এলিয়ে দেওয়া, প্রাবৃট রজনীর ঘনান্ধকার তার প্রিয়হীন প্রাণের নিবিড় নির্জনতা, দূর বনের ঝোড়ো হাওয়ায় তার আকূল দীর্ঘশ্বাস, তারই প্রতীক্ষাভ্রান্ত আঁখি দুটির অশ্রুভারে ঝরঝর অবিশ্রান্ত বারিবর্ষণ, মেঘমেদুর আকাশের বুকে বিদ্যুৎ চমক তার হতাশ প্রাণে ক্ষণিক আশার মেঘদূত!”

এই অসাধারণ অংশটিতে বর্ষকালের সুন্দর রূপ তো চিত্রিতই–তাছাড়া বর্ষাকালের চিরন্তন বিরহগাথা ‘মেঘদূত’ও যেন নতুনভাবে চোখের সম্মুখে প্রতিভাত হয়। কালিদাসের অমর সৃষ্টি এই কাব্য বিভূতিভূষণের বর্ষাবর্ণনার মাঝে চিরকালীন হয়ে ওঠে।

আবার প্রদ্যুম্ন যখন দেবী সরস্বতীকে বাঁশি বাজিয়ে শোনায় সে দিনটিও ছিল ‘আষাঢ়ী পূর্ণিমার’ রাত্রি।

সুরদাস ওরফে গুণাঢ্যের তন্ত্রবলে দেবী যখন বন্দিনী হতে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময়কার আসন্ন বিপদের বর্ণনাও বর্ষাকালীন প্রকৃতিচিত্রর মধ্যে দিয়ে দেখান বিভূতিভূষণ— “পূর্ণিমার চাঁদকে তখন মেঘে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। একটু একটু জ্যোৎস্না যা আছে, তা কেমন হলদে রঙের গ্রহণের সময় জ্যোৎস্নার এরকম রং সে কয়েকবার দেখেছে।”

এইভাবেই বর্ষাকাল এবং তার প্রকৃতি গল্পে ধ্রুবপদের মত বারেবারেই ফিরে এসেছে। সুতরাং বর্ষার রাগ অর্থাৎ ‘স্বর’ বা ‘ধ্বনি’ অর্থাৎ বর্ষার পদধ্বনি গল্পে একটি বড় ভূমিকা নেয়। ফলে এদিক দিয়ে ‘মেঘমল্লার’ নামকরণটিও প্রাসঙ্গিক। কারণ গল্পে বর্ষাকালীন প্রকৃতি ও বর্ষার পদচারণাকে প্রধান করে তুলেছেন বিভূতিভূষণ সুতরাং নামকরণ সার্থক বলা যায়।

কিন্তু শুধুমাত্র বর্ষাকালকে কেন্দ্র করে নামকরণের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে ধরলে ভুল হবে। তাতে দৃষ্টিভঙ্গির অপূর্ণতা লক্ষণীয় হয়ে পড়বে। ‘মেঘমল্লার’ নামকরণটিকে অন্যদিক দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন গল্পকার।

পূর্বেই আমরা বলেছি গল্পের প্রধান চরিত্র প্রদ্যুম্ন। তাকে কেন্দ্র করেই গল্পটি আবর্তিত হয়েছে। সুতরাং ‘প্রদ্যুম্ন’ নামে গল্পের নামকরণ করাই যেত। কিন্তু তাহলে নামকরণের মাধুর্য নষ্ট হত।

গল্পের শুরুতে আমরা দেখি প্রদ্যুম্ন দশপারমিতার মন্দিরে পুজোর উৎসবে যোগ দিয়েছে ভাল বীণ বাজিয়ের সন্ধানে। গল্পটি আর একটু এগোনোর পর আমরা জানতে পারি প্রদ্যুম্ন ভালো বাঁশি বাজাতে পারে। একজন শিল্পী নিজের অধীত বিদ্যার বাইরেও অন্য বিদ্যা শিক্ষা করতে আগ্রহী হতেই পারে। যখন সেটা একই বিদ্যার আর এক ধাপ। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীরা যখন শুধুমাত্র প্রকৃতিচিত্র আঁকেন তখন তিনি চিত্রেরই আরও অন্যান্য ধাপ সম্পর্কে আগ্রহী হতেই পারেন।

প্রদ্যুম্নও এইভাবে সুরদাসের সাক্ষাৎ পায়। এরপর আমরা তাকে বৌদ্ধবিহারে ফিরতে দেখি। এইসময়ই তার প্রিয়া সুনন্দার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে এবং আমরা জানতে পারি—’প্রদ্যুম্নের বাঁশীর অলস স্বপ্নময় সুরের মধ্যে দিয়ে কতদিন উভয়ের অজ্ঞাতে রোদভরা মধ্যাহ্ন গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। অর্থাৎ সুনন্দাকে বাঁশিতে মেঘমল্লারের সুর তুলে আনন্মনা করে দিত প্রদ্যুম্ন। দুই প্রেমাস্পদের মিলনের সূত্রই ছিল বাঁশির সুর ও মেঘমল্লার রাগ।

আর একটি কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক। প্রদ্যুম্ন বৌদ্ধবিহারের ছাত্র। বৌদ্ধদর্শন, ধর্মের চর্চাকারীরা সাধারণত রুক্ষ ও মৌনব্রতী হন। কিন্তু প্রদ্যুম্নই একমাত্র ব্যতিক্রম, কারণ সে সঙ্গীতজ্ঞ পিতার (ইন্দ্রদ্যুম্ন) সন্তান। সে নিজেও -একজন ভালো বংশীবাদক। সুতরাং শিল্পীসত্তার অধিকারী হবার জন্য সে রোমান্টিক, প্রাণচঞ্চল, কৌতূকপ্রিয় এবং সর্বোপরি প্রদ্যুম্ন তরুণ ফলে তার মধ্যে এই সজীব সত্তা থাকাই তো বাঞ্ছনীয়। ধর্ম ও দর্শনের কঠোরতা তার শিল্পীসত্তার পেলবতাকে নষ্ট করে দিতে পারে নি। সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগই এর একমাত্র কারণ।

সুনন্দাকে যেমন সে মেঘমল্লারের আলাপ তুলে মুগ্ধ করে দিত। তেমনি ভাঙ্গা মন্দিরে সুরদাসকেও বাঁশিতে মেঘমল্লারের সুর শুনিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল— “তার আলাপ অতি মধুর হল। লতাপাতা ফুলফলের মাঝখান বেয়ে উদার নীল আকাশ তার জ্যোৎস্না রাতের মর্ম ফেটে যে রসধারা বিশ্বে সবসময় ঝরে পড়ছে, তার বাঁশীর গানে সে রস যেন মূর্ত হয়ে উঠল।”

সঙ্গীত যে স্বর্গীয় এক অনুভূতি এনে দেয় শ্রোতার মনে সেই ভাবই যেন কতকটা এখানে ধ্বনিত। বৃষ্টি ও জ্যোৎস্নার মধ্য দিয়ে উদার উন্মুক্ত আকাশের যে রসময়তা সর্বদা পৃথিবীতে পতিত হচ্ছে প্রদ্যুম্নর মেঘমল্লার রাগে সেই স্বর্গের অনুভূতি যেন বোধ হতে লাগল।

সুরদাসের কথামতো আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত্রে বাঁশিতে মেঘমল্লারের ধ্বনি তুলে স্বর্গের দেবী সরস্বতীকেও মর্ত্যভূমিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় প্রদ্যুম্ন। কল্পলোকের দেবীর আসনও টলে যায় মেঘমল্লারের অপূর্ব ধ্বনিতে। আবার দেবী যখন বন্দিদশায় তখন দেবী (যিনি সঙ্গীত বিদ্যা প্রভৃতি কলা অধিষ্ঠাত্রীর দেবী) কুটিরে গান করেন। সে গানেও পৃথিবীর বাইরে কোন এক কল্পলোকের সুরই ধ্বনিত হয়— “সে গান পৃথিবীর মানুষের গান নয়, সে গান প্রাণধারার আদিম ঝরণার গান, সৃষ্টিমুখী নীহারিকাদের গান, অনন্ত আকাশে দিক্‌হারা কোন পথিক তারার গান।”

গল্পের শেষে প্রদ্যুম্ন যখন দেবীর গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দেবীকে গুণাঢ্যের তন্ত্রবল শক্তি থেকে মুক্ত করে নিজেও প্রস্তরীভূত হয়ে যান তখন সুনন্দার প্রসঙ্গ আসে। সুনন্দা প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে প্রিয়তম প্রদ্যুম্নর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তখন সে রাত্রে মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে— “কোথাকার যেন কোন এক পাহাড়ের ঘন বেতের জঙ্গল আর বাঁশের বনের মধ্যে লুকানো এক অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি। নিঝুম রাতে সে পাহাড়ের বেতগাছ হাওয়ায় দুলছে, বাঁশবনে সিরসির শব্দ হচ্ছে, দীর্ঘ দীর্ঘ বেতডাটার ছায়ায় পাষাণমূর্তিটার মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। সে অন্ধকার অর্ধরাত্রে জনহীন পাহাড়টার বাঁশগুলোর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে কেবল বাজছে মেঘমল্লার…”

এই স্বপ্নদৃশ্য সত্য। সুনন্দা স্বপ্নে প্রদ্যুম্নর পরিণতিটিই যেন দেখতে পায়। যেহেতু প্রদ্যুম্ন বাঁশি বাজনোতে দক্ষ এবং মেঘমল্লার রাগ তার হাতে প্রাণ পায় তাই তার পাষাণমূর্তির কাছে মেঘমল্লারই ধ্বনিত হচ্ছে আপনা আপনিই। সুনন্দার প্রিয়তম তাকে মেঘমল্লার শুনিয়ে ধন্য করত তাই প্রেমাস্পদের স্বপ্নে মেঘমল্লার রাগটাও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।

এই সঙ্গীতের প্রেক্ষিতেই নামকরণটি সার্থক। প্রদ্যুম্ন একজন স্রষ্টা। তাই তার অবর্তমানেও এই ভূলোকে তার সৃষ্ট রাগরাগিনী থেকে যাবে এবং তা নিরন্তর ধ্বনিত হবে। তাই মেঘমল্লারের মধ্য দিয়ে শিল্পীর সৃষ্টির ব্যঞ্জনা যে কত মহৎ ও অমর তা বুঝিয়েছেন বিভূতিভূষণ।

আর গল্পের দুই নারী চরিত্র সুনন্দা এবং দেবী সরস্বতী দু’জনেই মুগ্ধ হয়েছেন প্রদ্যুম্নর বাঁশির এই মেঘমল্লার রাগেই। সুনন্দার ক্ষেত্রে প্রেমের বন্ধন এবং দেবী সরস্বতীর ক্ষেত্রে মর্ত্যভূমির প্রতি দেবতাদের চিরকালীন আকর্ষণকে রূপ দেয় এই প্রদ্যুম্নর বাঁশির ‘মেঘমল্লার’ রাগই। সুতরাং প্রেম ও পুণ্যের বন্ধন হিসেবেও এই রাগ উল্লেখ্য।

বর্ষাপ্রকৃতি, সঙ্গীতময়তা, একজন শিল্পীর অমর সৃষ্টি, প্রেম, পুণ্য, রোমান্স সবকিছুইকেই মূর্ত করে তোলে ‘মেঘমল্লার’। প্রদ্যুম্নর প্রাণচঞ্চল সত্তা, কৌতূকপ্রিয়তা, কৌতূহলী মানস, পরার্থে আত্মবিসর্জন সব কিছুর কেন্দ্রেই ‘মেঘমল্লার’ রাগের অনুরণন। বিভূতিভূষণের এই বিখ্যাত ছোটগল্পের নামকরণের মধ্য দিয়ে শিল্পীর সৃষ্টি ও একটুকরো সজল মেঘের স্নেহচ্ছায়া লক্ষণীয়।