অথবা, মেকিয়াভেলি কী কৌশল বিজ্ঞানী ছিলেন? ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ মেকিয়াভেলি ষােড়শ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি ১৪৬৯ সালে ইতালীর ফ্লোরেন্স নগরে জন্মগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে প্লেটো, এরিস্টটল, হবস, লক ও রুশের মতাে তারও রয়েছে বিশিষ্ট স্থান ও অবদান। সাধারণভাবে তাকে বলা হয় The first modern political thinker. রাষ্ট্রনীতি, শাসন পদ্ধতি ও কূটনীতির বিশাল ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয়। রাজনৈতিক চিন্তার যুগসন্ধিক্ষণে সমগ্র ইউরােপে বিশেষ করে ইতালীতে যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে তারই বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই মেকিয়াভেলীর রাষ্ট্রদর্শনে।
মেকিয়াভেলী কৌশল বিজ্ঞানীঃ মেকিয়াভেলীর রাজনৈতিক দর্শন ছিল বাস্তবভিত্তিক। তার চিন্তার বৈশিষ্ট্য রাজনীতি, রাষ্ট্রতত্ত্ব নয়। তিনি আরােহ পদ্ধতিতে রাজনীতি বিশ্লেষণ করেছেন। John Plantary-এর মতে, মেকিয়াভেলী বাস্তববাদী, আধুনিকত্ব, আরােহধর্মী, বিশ্লেষণ পদ্ধতির শ্রেষ্ঠতম পুরােধা। তাই ষােড়শ শতকের দার্শনিক হয়েও তিনি আধুনিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মেকিয়াভেলিবাদ কুখ্যাত ও ঘৃণিত মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এটা বর্তমানে বিশ্বের আন্তর্জাতিক কূটনীতির মূলভিত্তি। তার প্রণীত কৌশল রাষ্ট্র পরিচালনায় তথা শাসক ও শাসিতের কার্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার রাষ্ট্রদর্শনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলাে ও রাষ্ট্রের ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। মেকিয়াভেলীর রাষ্ট্রদর্শনের কৌশলগুলাে সম্পর্কে আলােচনা করা হলােঃ
শাসকের প্রতি উপদেশ/পরামর্শঃ মেকিয়াভেলী সুষ্ঠুরূপে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য শাসককে কতকগুলাে কৌশল অবলম্বন করার পরামর্শ ও উপদেশ দিয়েছেন। যথাঃ
(১) তেজস্বী ও সাহসিকতা সম্পন্নঃ মানুষকে ম্যাকিয়াভেলি অকৃতজ্ঞ, চঞ্চল, প্রতারক, কাপুরুষ এবং লােভী প্রকৃতির প্রাণী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ বৈশিষ্ট্যের মানুষকে কোনাে শক্তিশালী শাসকের অধীনে না আনলে রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। অর্থাৎ কোনাে শক্তির দ্বারা বাধ্য না হলে সে ভালাে কিছু করতে চায় না।
(২) শক্তিশালী আইন প্রণেতাঃ ম্যাকিয়াভেলির মতে, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের জন্য একজন শক্তিশালী আইন প্রণেতার প্রয়ােজন। কারণ একজন শক্তিশালী আইন প্রণেতাই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিষয়াদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে জনকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য শাসককে নৈতিকতাসম্পন্ন ও সদগুণের অধিকারী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
(৩) ধর্ম ও নৈতিকতা পরিহারঃ ম্যাকিয়াভেলি মনে করেন, একজন শাসক সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার লক্ষ্যে ধর্ম ও নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিতে পারে। দেশের শান্তি ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য তেমনটি করা কোনাে শাসকের পক্ষ্যে অপরাধের কিছু নয়।
(৪) সদগুণাবলি অর্জনঃ রাষ্ট্রনায়কের প্রতি ম্যাকিয়াভেলির পরামর্শ হলাে রাষ্ট্রনায়ককে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অবশ্য সদগুণাবলি অর্জন করতে হবে। তবে বাস্তবক্ষেত্রে সদগুণ অর্জন করা বা তার প্রয়ােগ সম্ভব না হলে, রাজা সদগুণের অধিকারী এমন একটা ভাব দেখাতে হবে।
(৫)জনগণের বন্ধুত্বঃ ম্যাকিয়াভেলির মতে, শাসককে সর্বক্ষণ জনগণের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে নিয়ােজিত থাকতে হবে। বিপদের দিনে জনগণই তার একমাত্র বন্ধু বা সহায়। তবে স্বার্থন্বেষী বা উচ্চাভিলাষী অভিজাত সম্প্রদায় সম্বন্ধে সর্বদা তাকে সজাগ থাকতে হবে। কেননা তারা সুযােগ পেলে রাজাকে উৎখাত করতে পারে।
(৬) দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধকরণঃ ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য শাসককে ন্যায়বােধ বা নৈতিকতার দোহাই দিয়ে জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে বলেছেন। তবে শাসককে অবশ্যই শিয়ালের ন্যায় ধূর্ততার পরিচয় দিতে হবে।
রাজনীতি সম্পর্কে মেকিয়াভেলীঃ নিম্নে রাজনীতি সম্পর্কে মেকিয়াভেলীর ধারণা দেয়া হলােঃ
(১) ইতালীর গৌরব বৃদ্ধিঃ মেকিয়াভেলী ইতালিকে স্বাধীন ও সার্বভৌমরূপে দেখতে চেয়েছিলেন। এজন্য ইতালীকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে মুক্ত ও রাজনৈতিক দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চেয়েছেন। ইতালীকে কিভাবে আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা যায় সেদিকেই তার রাজনৈতিক চিন্তা ধাবিত হয়।
(২) গীর্জাকে অস্বীকারঃ মেকিয়াভেলী গীর্জার শাসনকে অস্বীকার করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে গার্জার শ্রেষ্ঠত্বকে কমাতে চেয়েছেন। তিনি জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যবধানের ক্ষেত্রগুলােকে একত্র করে ঘােষণা করেন যে, রাজনীতি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।
(৩) রাষ্ট্রের ঐক্যঃ মেকিয়াভেলীর মতে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধারী রাজার পক্ষেই সম্ভবপর রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তিনি কৌশলে ক্ষমতা গ্রহণ ও প্রয়ােগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। রাষ্ট্রের মঙ্গল সাধনের জন্য তিনি রাজাকে যেকোনাে কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। প্রয়ােজনে তিনি দয়া, মানবিকতা, ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী হতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ধর্ম ও নৈতিকতার ধারণাঃ মেকিয়াভেলীই প্রথম চিন্তাবিদ যিনি ধর্ম ও নৈতিকতাকে অত্যন্ত নিমর্মভাবে রাজনীতি থেকে পৃথক করেছেন। তার মতে রাষ্ট্রই হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং তা অন্যকোন উচ্চতর ক্ষমতার অধীন হতে পারে না। মধ্যযুগে পার্থিব ক্ষমতা হিসেবে রাষ্ট্র ছিল ধর্ম, নৈতিকতা, ঐশ্বরিক আইনের উচ্চতর ক্ষমতার অধীন। কিন্তু মেকিয়াভেলি মনে করেন, ঐশ্বরিক আইন বলে কিছু নাই। তার মতে, শাসক রাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য প্রয়ােজনবােধে নৈতিকতাকে বিসর্জন কঠোর, নির্মম, বেআইনী ও অন্যায়ের পথে অগ্রসর হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। তবে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে নৈতিকতা বিবর্জিত ছিলেন না। মেকিয়াভেলি দুই ধরনের নৈতিকতার কথা বলেছেন। এগুলাে হলাে সরকারি নৈতিকতা এবং ব্যক্তিগত নৈতিকতা। মেকিয়াভেলির মতে, ধর্ম ও নৈতিকতার পথ অনুসরণ করে রাষ্ট্র যদি তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে তবে তা হবে উত্তম।
পরিশেষঃ এতক্ষণের আলােচনায় পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি শাসককে যে পরামর্শ দিয়েছেন তা সমালােচিত হলেও তা অত্যন্ত বাস্তবিক আধুনিক কুটনীতির মূল উপজীব্য। তিনি গতানুগতিক কল্পনাপ্রসূত চিন্তাধারাকে পরিহার করে সমকালীন রাজনৈতিক সমস্যাসমূহের সমাধানের পরিপ্রেক্ষিতে তার মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রাষ্ট্রশাসনে মেকিয়াভেলী প্রণীত অবদান তাকে কৌশল বিজ্ঞানীর উপাধি দিয়েছে।
Leave a comment