প্রায় সব মৃত্তিকা গঠনে মৌলিক প্রক্রিয়াসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেও ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মৃত্তিকা গড়ে উঠতে দেখা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের পার্থক্যের ওপর নির্ভর করে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে মৃত্তিকা সৃষ্টির ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়। এদের বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বলা হয়। কেবলমাত্র বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশেই এই প্রক্রিয়াগুলি কার্যকরী হয়ে থাকে। এগুলি হল— [1] ল্যাটেরাইজেশন [2] পড়সলাইজেশন [3] গ্লেইজেশন [4] ক্যালশিফিকেশন [5] স্যালিনাইজেশন [6] অ্যালকালাইজেশন।
[1] ল্যাটেরাইজেশন : যে প্রক্রিয়ায় ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা গঠিত হয় তাকে ল্যাটেরাইজেশন বলে। অধিক উষ্ণতা (গড়ে 25 °সে.) ও অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত (200 থেকে 250 সেমি) অঞ্চলে এবং লােহা ও অ্যালুমিনিয়াম সমৃদ্ধ জনক শিলার ওপরে ল্যাটেরাইজেশন প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত হয়। ধৌত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতি ক্ষারকীয় দ্রবণীয় পদার্থ এবং সিলিকা (SiO২,) মৃত্তিকার ওপরের স্তর থেকে নীচে চলে যায়। ফলে মৃত্তিকার ওপরের অংশে লােহা ও অ্যালুমিনিয়ামের জারিত কণাগুলি সেসকুইক্সাইডরুপে থেকে যায়। একারণে মৃত্তিকা লাল রঙের ও কঠিন হয়ে যায় এবং ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা গড়ে ওঠে।
[2] পড়সলাইজেশন : পড়সল মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে পডসলাইজেশন বলা হয়। স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত শীতল নাতিশীতােয় জলবায়ু অঞ্চলে যেখানে বিস্তৃত সরলবর্গীয় অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে সেখানে এই ধরনের মৃত্তিকা গড়ে ওঠে। কম তাপমাত্রার জন্য বাষ্পীভবনের হার কম থাকে বলে মৃত্তিকা সারাবছর আর্দ্র থাকে এবং মৃত্তিকায় সারাবছরই অনুস্রবণ ও ধৌত প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে। ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, প্রভৃতি ধাতব ক্যাটায়নগুলি এবং লােহা ও অ্যালুমিনিয়ামের অক্সাইডগুলি ধৌত প্রক্রিয়ায় অপসারিত হয়ে নীচের স্তরে সঞ্চিত হয়। ফলে মৃত্তিকার ওপরের স্তরে সাদা ও ধূসর রঙের বালি থেকে যায়। এভাবে পড়ল মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।
[3] গ্লেইজেশন : জলমগ্ন অঞ্চল বা যেসব স্থানে জল জমে থাকে সেখানে মৃত্তিকায় অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। তাই মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের জারণ প্রক্রিয়ার বদলে বিজারণ প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। এর ফলে মৃত্তিকায় জৈব অম্ল উৎপন্ন হয় ও মৃত্তিকার স্বাভাবিক রং বাদামি হওয়ার পরিবর্তে ধূসর বা সবুজ বা নীলাভ হয়। মৃত্তিকা সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াটিকে গ্লেইজেশন বলে।
[4] ক্যালশিফিকেশন : মৃত্তিকার স্তরে চুনজাতীয় পদার্থ সঞ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ক্যালশিফিকেশন বলে। নাতিশীতােয় তৃণভূমি ও মরুপ্রায় অঞ্চলে যেখানে বৃষ্টিপাত কম সেখানে এই প্রক্রিয়া বিশেষভাবে কার্যকরী। আবহবিকার ও ক্ষয়ীভবনের ফলে শিলা থেকে নির্গত ক্যালশিয়াম কার্বন ডাইঅক্সাইডের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে ক্যালশিয়াম কার্বনেট সৃষ্টি করে। এই ক্যালশিয়াম কার্বনেট জলের মাধ্যমে বাহিত হয়ে মৃত্তিকা স্তরের মধ্যে অধঃক্ষিপ্ত ও সঞ্চিত হয়। ফলে চুনজাতীয় মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
[5] স্যালিনাইজেশন : যে প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা পরিলেখের মধ্যে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ও সােডিয়াম-এর লবণ সালফেট বা ক্লোরাইডরূপে সঞ্চিত হয় তাকে স্যালিনাইজেশন বলে। মরু, মরুপ্রায় অঞ্চল, সমুদ্রতীর ও বিভিন্ন শুষ্ক এলাকা প্রভৃতি স্থানে এই প্রক্রিয়া সক্রিয়। কৈশিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রবীভূত লবণ মৃত্তিকার ওপরের স্তরে উঠে আসে। জল বাষ্পীভূত হলে লবণ মৃত্তিকার ওপরের স্তরে সঞ্চিত হয়ে সাদা আস্তরণের সৃষ্টি করে এবং লবণাক্ত মৃত্তিকা গঠিত হয়। এ ছাড়া সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলেও জোয়ারের জল ঢুকে লবণাক্ত মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে পারে।
[6] অ্যালকালাইজেশন : মৃত্তিকার স্তরে ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদি আয়নের তুলনায় সােডিয়াম আয়ন অধিক সঞ্চিত হলে সেই প্রক্রিয়াকে অ্যালকালাইজেশন বলে। উয় মরুভূমি অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া অধিক কার্যকরী। এই প্রক্রিয়ায় তীব্র ক্ষারধর্মী মাটির সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকার pH-এর মান 8.5 এর বেশি হয়। এই প্রক্রিয়ায় কালাে ক্ষার মৃত্তিকা বা ব্ল্যাক অ্যালকালি বা সােলেনেজ মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
Leave a comment