প্রশ্নঃ মূল্যবােধের অবক্ষয় কী? বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণগুলাে আলােচনা কর।

অথবা, মূল্যবােধের অবক্ষয় কাকে বলে? বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণগুলাে বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ সমাজে মানুষের জীবনযাপনের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অবস্তুগত বিষয় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সামাজিক মূল্যবোধ এদের মধ্যে অন্যতম। সমাজে একটি বিষয় ভালাে বা মন্দ, ঠিক বা বেঠিক, কাক্ষিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত সে সম্পর্কে সমাজের মানুষের যে ধারণা তাকে সামাজিক মূল্যবােধ বলে। অর্থাৎ মূল্যবােধ হলাে ভালাে বা মন্দ সম্পর্কে সামাজিক ধারণা। কাক্ষিত বা অনাকাক্ষিত, উচিত বা অনুচিত সম্পর্কে সামাজিক ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে মূল্যবােধ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মূল্যবােধের অবক্ষয়ঃ সমাজে মানুষ যখন সামাজিক মূল্যবােধকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন কাজ করতে থাকে তখন তাকে মূল্যবােধের অবক্ষয় বলে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সকল অংশেই মূল্যবােধের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন কারণে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণগুলাে নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

বাংলাদেশে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণঃ বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে বর্তমানে ব্যাপকভাবে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ বহুকাল ধরে চলে আসা মূল্যবােধ ধরে রাখতে পারছে না। বাংলাদেশে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের প্রধান প্রধান কারণগুলাে হলাে-

(১) দারিদ্র্যঃ দারিদ্র বাংলাদেশে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ফলে জীবনের যাবতীয় প্রয়ােজন মেটাতে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় হচ্ছে।

(২) বেকারত্বঃ বেকারত্ব একটি সমাজের জন্য অভিশাপস্বরূপ। একটি সমাজে বেকারদেরকে বােঝা হিসেবে কল্পনা করা হয়। পর্যাপ্ত কাজের সুযােগ না থাকায় তারা অর্থোপার্জনের জন্য অসদুপায় ও বেআইনী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় হচ্ছে।

(৩) অর্থনৈতিক ব্যবস্থাঃ বাংলাদেশে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও অনেকাংশে দায়ী। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুঁজিবাদী নীতি এখনও বেশ প্রবল। উৎপাদন যন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত থাকায় যে যত পারছে সম্পদ সংগ্রহ করছে। ফলে অর্থ উপার্জনের প্রতিযােগিতায় নেমে অনেকে সামাজিক মূল্যবােধকে অতিক্রম করছে। ফলে মূল্যবােধের অবক্ষয় হচ্ছে।

(৪) অপরাধ প্রবণতাঃ দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধকে অনেকেই বড় কিছু মনে করছে না। ফলে সামগ্রিকভাবে সমাজে মূল্যবােধ হাস পাচ্ছে।

(৫) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিঃ বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি দিনদিন বেড়েই চলছে। ফলে মানুষ তাদের জীবনযাপনের জন্য বিভিন্ন প্রয়ােজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। কেউ কেউ অনৈতিক উপায়ে অর্থোপার্জনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবােধ হ্রাস পাচ্ছে।

(৬) বৈদেশিক অপসংস্কৃতির প্রবেশঃ যােগাযােগ প্রযুক্তিতে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হওয়ায় রেডিও, টেলিভিশন ইন্টারনেটসহ অন্যান্য মাধ্যমে বৈদেশিক অপসংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তরুণ-তরুণীরা এসব অপসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হচ্ছে। অনেকে এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবােধ ব্যাপকভাবে হাস পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবােধ অবক্ষয়ের এটাই অন্যতম কারণ।

(৭) রাজনৈতিক কারণঃ বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অনেকে অপরাধ করেও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে শাস্তি থেকে বেঁচে যাচ্ছে। ফলে অপরাধকে মানুষ আর গুরুতর বিষয় হিসেবে দেখছে না। ফলে মানুষের মনে অপরাধের প্রতি ঘৃণাবােধ কমে যাচ্ছে অর্থাৎ সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় হচ্ছে।

(৮) আইন-শৃঙ্খলার-অবনতিঃ বর্তমানে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থায় শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে মানুষ সহজেই অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবােধ হ্রাস পাচ্ছে।

পরিশেষঃ সামাজিক মূল্যবােধ সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান। বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে সামাজিক মূল্যবােধের অবক্ষয় হচ্ছে। বাংলাদেশে মূল্যবােধ অবক্ষয়ের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। কারণ সমাজের সামগ্রিক বিষয়ের ওপর সামাজিক মূল্যবোেধ নির্ভর করে। যা টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজে সামাজিক স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখতে হবে। বৈদেশিক অপসংস্কৃতির প্রবেশ রােধ করতে হবে। অপরাধ প্রবণতা কমানাের জন্য সামাজিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই মূল্যবােধের অবক্ষয় হাস পাবে।