প্রশ্নঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তার মতাে বহুমুখী প্রতিভা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, উচ্চ আদর্শ ও বহুবিধ সদগুণের অধিকারী কোনাে শাসক ইতঃপূর্বে দিল্লীর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হননি। ড. ঈশ্বর প্রসাদের মতে- He was unquestionable the ablest man among the crowned heads of the middle ages.

মুহাম্মদ বিন তুঘলকের চরিত্রঃ

১. নিষ্ঠাবান মুসলিমঃ সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক ব্যক্তিগত জীবনে নীতিবােধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এবং পবিত্র কুরআন হাদীসে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ইবনে বতুতা, শিহাবুদ্দিন ও ঐতিহাসিক কাসেম ফিরিশতা তার নিষ্ঠার সাথে ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করার কথা উল্লেখ করেছেন।

২. ইসলামের একনিষ্ঠ সেবকঃ তুঘলক ছিলেন একজন পূর্ণ মুসলিম এবং ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক। তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন। সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে উৎসাহবােধ করতেন।

৩. প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্নঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক তৎকালীন দিল্লী সালতানাতের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন এবং পবিত্র কুরআন ও হাদীসের জ্ঞানে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। ঐতিহাসিক আগা মাহদী হােসাইন বলেন, “সুলতানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কেউই সাহস করতেন না। কারণ সুলতান ছিলেন এক জীবন্ত বিশ্বকোষ।”

৪. নিষ্কলুষ চরিত্রঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ব্যক্তিগত জীবন ছিল পবিত্র ও নিষ্কলষ। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল অপরিসীম। তিনি এক সুন্দর মনের অধিকারী ছিলেন। সাম্রাজ্যের মঙ্গলই ছিল তার একমাত্র কামনা।

৫. উদার ও বিনয়ীঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন অত্যন্ত উদার ও বিনয়ী। মহত্ত্বের দিক বিচারে তিনি তার সমসাময়িক শাসকবর্গকে ছাড়িয়ে গেছেন। ইবনে বততা তার ব্যক্তিগত পরিচয় থেকে সুলতানের চরিত্রের বর্ণনায় বলেছেন, তিনি ছিলেন দয়ার সাগর। তার চরিত্রের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য গুণ ছিল বদান্যতা, নম্রতা ও সৌজন্যবােধ।

৬. উচ্চাভিলাষীঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ। রাজধানী স্থানান্তর ও তাম্র মুদ্রা প্রচলন থেকে তা প্রমাণিত হয়।

৭. পরিমিতিবােধের অভাবঃ সদিচ্ছা ও অসাধারণ কল্পনাশক্তি থাকা সত্ত্বেও ভারসাম্য, ধৈর্য ও পরিমিতিবােধের অভাবে শাসক হিসেবে মুহাম্মদ বিন তুঘলক সফল হতে পারেননি। কোনটা সম্ভব, আর কোনটা সম্ভব নয় এ পরিমিত ও বাস্তব জ্ঞান বােধ, হয়ত তার ছিল না। এজন্যই তিনি সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হন। আর এ ব্যর্থতার গ্লানি সঙ্গে করেই সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

মুহাম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্বঃ

১. সুশাসকঃ দিল্লী সালতানাতের সুশাসক হিসেবে মুহাম্মদ বিন তুঘলক ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। প্রশাসনিক কাঠামাের সুষ্ঠু বিন্যাস দ্বারা সুলতান কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করেছিলেন। শাসনের সুবিধার জন্য তিনি সাম্রাজ্যকে ২৩টি প্রদেশে ভাগ করেন।

২. মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সুলতানঃ মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুহাম্মদ বিন তুঘলক সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ও শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন। জ্ঞান বুদ্ধি, মানসিক উৎকর্ষ, আদর্শ ও প্রতিভার দিক দিয়ে বিচার করলে মধ্যযুগে ভারতীয় শাসকদের মধ্যে তাকে সর্বাপেক্ষা গুণান্বিত ও প্রভাবশালী শাসক বলে স্বীকার করতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নে তিনি ছিলেন দুঃসাহসী। ড. ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, “নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় শাসক।”

৩. অনন্য সাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্বঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন সমসাময়িককালের একজন অনন্য সাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, বৈজ্ঞানিক, কবি ও গণিত শাস্ত্রবিদ। তিনি গ্রিক দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ভেষজ বিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী বলেন, “তিনি ছিলেন সৃষ্টির এক অপূর্ব বিস্ময় এবং তার কর্মদক্ষতা প্লেটো ও এরিস্টটলের ন্যায় বিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও বিস্ময়াভিভূত করতে পারত।”

৪. দিগ্বিজয়ী শাসকঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক উচ্চাভিলাষী নরপতি ছিলেন। রাজত্বের প্রথম ভাগে তিনি মেবার, বরঙ্গল এবং দ্বারসমুদ্রের মতাে দূরবর্তী দেশগুলাে তার শাসনাধীনে এনেছিলেন।

৫. প্রজাবৎসল সুলতানঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন প্রজাবৎসল ও জনকল্যাণকামী সুলতান। প্রজাবর্গের দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধি করে তিনি আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন না। দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর, প্রতীকী তাম্র মুদ্রা প্রচলন জনগণের জন্য অকল্যাণকর বিবেচিত হওয়ায় তিনি তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাহার করেন।

৬. ডাক ব্যবস্থা প্রবর্তনঃ ইবনে বতুতার মতে, সুলতান ঘােড়ার ডাক এবং ডাক হরকরা নামক দুটি ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। ঘােড়ার ডাকের বেলায় প্রতি চার মাইল। অন্তর একটি এবং ডাক হরকরার বেলায় প্রতি মাইলে তিনটি ডাক ঘর ছিল। ডাক হরকরার সাথে ঘণ্টা থাকত এবং ঘণ্টা ধ্বনি দিয়েই তারা তাদের আগমনবার্তা প্রকাশ করত।

৭. কৃষি ব্যবস্থা সংস্কারঃ কৃষক ও কৃষি কার্যের উন্নতি বিধানকল্পে তিনি আমীরে কোহীর তত্ত্বাবধানে ‘দিওয়ানে কোহী’ নামক একটি স্বতন্ত্র কৃষি বিভাগ চালু করেন। এ বিভাগ চাষীদের তাকাভি ঋণদান এবং দুর্ভিক্ষের সময় দরিদ্রদের সাহায্যদানের ব্যবস্থা গ্রহণসহ পতিত ও অনাবাদী জমি চাষের অধীনে আনার জন্য কৃষকদের উৎসাহ প্রদান করত।

৮. বিদ্যোৎসাহীঃ সুলতান সবসময়ই বিদ্বান ব্যক্তিদের সমাদর করতেন। প্রখ্যাত ফিকহবিদ মাওলানা আবু হাফস সিরাজুদ্দিন, প্রখ্যাত মুফাসসির শিহাবুদ্দিন সৈয়দ আলী হামাদানী ইবনে তাজ মুলতানী, পর্যটক ইবনে বতুতা প্রমুখ মনীষী তার উদার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন।

৯. ন্যায়বিচারকঃ ন্যায়বিচারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার বিচারে বংশ মর্যাদার মানদণ্ড দোষী ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারত না। জনগণ ইচ্ছা করলে সুলতানের কাজের সমালােচনা করতে পারত। ইবনে বতুতার মতে, “সকল মানুষের মধ্যে তিনি সর্বাধিক ন্যায়বিচারপ্রিয় ছিলেন। অপরাধীদের তিনি কঠোর দণ্ড দিতেন। অমুসলিম প্রজাদের প্রতিও তিনি ইনসাফ করতেন।”

উপসংহারঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও রহস্যময় চরিত্রের অধিকারী, ছিলেন একজন মহান সংস্কারক, উদ্ভাবক। অভিনবত্ব ছিল তার শাসনকালের বৈশিষ্ট্য। এজন্যই তিনি যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন। ঐতিহাসিক লেনপল যথার্থই বলেছেন- With the best intentions, excellent ideas, but no balance, no patience no sense of proportion, Muhammad bin Tughlug was a transcendent failure.