মুদালিয়র কমিশনের (১৯৫২-৫৩ খ্রি.) একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল বহুমুখী উদ্দেশ্যসাধক বিদ্যালয় বা Multipurpose school স্থাপন করা। এই বিদ্যালয় স্থাপনের পিছনে কতকগুলি উদ্দেশ্য ছিল। সেগুলি হল—
(১) রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী শিক্ষার সুযোগ: মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীদের সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তি শিক্ষা সম্পর্কিত অধিকতর সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য বহুমুখী উদ্দেশ্য সাধক বিদ্যালয়ের সুপারিশ করেছে কমিশন। পুরাতন শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের যে পুথিগত বিদ্যা গ্রহণ করত, তা ছিল বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন। যেখানে শিক্ষার্থীর রুচি, আগ্রহ, পছন্দ-অপছন্দ, সামর্থ্যের কোন মূল্য ছিল না। শিক্ষার্থীরা নিজের পছন্দমতো কোণে বিষয় সম্পর্কে জানা বা শেখার সুযোগ পেত না। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজের পছন্দ, আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়, তার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের বহুমুখী বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছে।
(২) সাধারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে ভিড় কমানো : বহুমুখী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সাধারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে থেকে ভিড় করবে এবং তার যেরূপ যোগ্যতা, সেই অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে বৃত্তি শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষার মতে মাধ্যমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হবে। বৃত্তি শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষের মনে যে অবজ্ঞার মনোভাব আছে তা দূর করা সম্ভব হবে। শিক্ষার্থীদের মনে হীনম্মন্যতার ভাব থাকবে না।
(৩) স্বতন্ত্র কারিগরি বিদ্যালয় পরিচালনা : বৃত্তি শিক্ষাকে উন্নত করার জন্য কমিশন স্বতন্ত্রভাবে অথবা বহুমুখী বিদ্যালয়গুলির সঙ্গে কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করেছে। এই উদ্দেশ্যে কমিশন একটি সর্বভারতীয় কারিগরি শিক্ষা পর্ষদ গঠন করার পরামর্শ দিয়েছে।
(৪) বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা : অনগ্রসর শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করার পরামর্শ দিয়েছে। এদের উপযুক্ত তত্ত্বাবধানের জন্য এই বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ।
(৫) শিক্ষার বিভিন্ন শাখার বিকাশ : বহুমুখী উদ্দেশ্য সাধক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ নিঃসন্দেহে কমিশনের দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। এই সুপারিশ করলে অনেক শিক্ষার্থী বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষার বিশেষ সুযোগ পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রদেশে এই ধরনের বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। মেয়েরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী গার্হস্থ্য বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ পাবে। বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখার ছেলেমেয়েদের সামনে ও ভবিষ্যৎ বৃত্তির পথ খুলে দেবে। কৃষিপ্রধান দেশের কথা চিন্তা করে এই বিষয়কে কমিশন গুরুত্ব দিয়েছে, যাতে কৃষি ও শিল্প শিক্ষায় দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে।
(৬) হাতে কলমে শিক্ষার প্রচলন : শিল্প কেন্দ্র গুলোতে শিক্ষার্থীরা যাতে ব্যবহারিক শিক্ষা অর্থাৎ হাতে কলমে শিখতে পারে তার জন্য প্রয়োজন হলে বাধ্যতামূলক আইন তৈরি করা।
(৭) কৃষিশিক্ষার বিকাশ : ভারতের সব রাজ্যে গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলিতে কৃষি শিক্ষার বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে এবং পশুপালন, কুটির শিল্প, ফল ফুলের উদ্যান রচনার বিষয় বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা।
বহুমুখী উদ্দেশ্য সাধক বিদ্যালয়ের সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারণে তা সফল হয়নি। কারণগুলি হল—
(১) ব্যক্তি বৈষম্য নীতি এর ব্যর্থতা : কমিশন ব্যক্তি বৈষম্যের নীতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য, যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন সুপারিশ করেছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যক্তি বৈষম্য অনুসারে পরামর্শদানের ব্যবস্থা করা অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সম্ভব হয়নি।
(২) আর্থিক অসংগতি : কমিশনের সুপারিশ মতে বহুমুখী পাঠক্রমের জন্য প্রয়োজন ছিল অধিক সংখ্যক বহুমুখী বিদ্যালয় স্থাপন করা। কিন্তু বাস্তবে পরিকাঠামো ও আর্থিক কারণে সমস্ত দশম শ্রেণি বিদ্যালয়কে বহুমুখী বিদ্যালয়ে পরিণত করা সম্ভব হয়নি।
(৩) সপ্তপ্রবাহ পাঠক্রমের অকার্যকারিতা : অধিকাংশ বহুমুখী বিদ্যালয় সাত ধরনের শিক্ষা প্রবাহের মধ্য থেকে কেবলমাত্র কলা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখার উপর পাঠদানের ব্যবস্থা হয়েছিল।
(৪) বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত : নবম শ্রেণি থেকে বিষয় নির্বাচনের যে সুপারিশ কমিশন করেছিল, তা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ এই বয়সে বিষয় নির্বাচন করার মতাে অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের থাকে না। ফলে তারা বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে অনেকসময় ভুল বিষয় নির্বাচনের ফলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
(৫) নির্দেশনা ও পরামর্শদানের পরিকল্পনার ব্যর্থতা : কমিশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নির্দেশনা ও পরামর্শদানের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সঠিক নির্দেশনা ও পরামর্শদানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবে এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভবপর হয়নি।
(৬) অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব : বহুমুখী পাঠক্রমের বহুমুখী শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে যে বিপুল সংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষক প্রয়োজন ছিল, তার জোগান বাস্তবে সম্ভব ছিল না।
এইসকল কারণে বহুমুখী বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা পরবর্তীকালে সফল হয়নি। উপরন্তু বহুমুখী শিক্ষার প্রতি পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের ও আগ্রহের অভাব লক্ষ করা যায়।
Leave a comment