‘মুক্তধারা’ রূপক-সাংকেতিক নাটক বলেই এ নাটকে সংগীতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাট্য েগদ্য সংলাপের মাধ্যমে যখন তার বক্তব্য প্রকাশ সম্ভব হয় না, তখন নাট্যকারকে সংগীতের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। আলোচ্য নাটকে নাট্যকার বিশেষ বক্তব্য প্রকাশের কারণেই সংগীতের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এখানে গান অসামান্য চরিত্র দীপ্তি নিয়ে বহুল ব্যবহারে জড়ানো। এ নাটকের সংগীতের মূলে বাউলকে পাওয়া যায় এবং এখানে অভিনয় বা নৃত্য গানের সঙ্গে বিজড়িত। এ সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্য— “মুক্তধারায় এই সংগীত ব্যবহারের দ্বারা আমরা বুঝতে পারি এই নাটকে শিল্পরূপের এক অন্তর্বিরোধ, যার ফলে সমস্ত শক্তি সত্ত্বেও এ রচনার এক প্রচ্ছন্ন দুর্বলতা সবসময় পীড়াজনক লাগে। ধনঞ্জয়ের গানগুলির গান এই নাটকে তৈরি হয়েছে। দুই পৃথক তল, একটির সঙ্গে অন্যটি কিছু বা বিরোধী সম্পর্কে যুক্ত।”
‘মুক্তধারা’ নাটকের দৃশ্য উন্মোচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, ভৈরব মন্ত্রে দীক্ষিত সন্ন্যাসীগণ স্তবগান করে পরিভ্রমণরত। তাদের কাছে ধূপাধারে ধূপ, শঙ্খ এবং ঘণ্টা, আর কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘জয়ভৈরব, ‘জয়শংকর’। উত্তকূটের রাজা রণজিতের সভার যন্ত্ররাজ বিভূতি বহু বছরের চেষ্টায় লৌহযন্ত্রের বাঁধ তুলে মুক্তধারা ঝর্ণাকে বেঁধেছেন। তাঁর এই অসামান্য কীর্তিকে পুরস্কৃত করার উপলক্ষ্যে উত্তকূটের সমস্ত লোক ভৈরব মন্দির প্রাঙ্গণে উৎসব করতে চলেছে। এমনই এক পরিবেশে সন্ন্যাসী দলের কণ্ঠে স্তোত্রবন্দনা উচ্চারণ করিয়ে এমন এক আবহমণ্ডল রচনা করা হয়েছে যার মাধ্যমে মুক্তধারার মূল বক্তব্যটি স্বতঃই প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এই স্তোত্র সংগীতের এখানে সূচনামাত্র হয়েছে এবং এই স্তোত্র সংগীতটি নাটকে সতবার ঘুরে ফিরে এসেছে। তাই সাতটি পৃথক সংগীত না ধরে এদেরকে একই স্তোত্র সংগীতের পর্যায়মুখী প্রকাশ বলা চলে৷ এতে প্রকাশ পেয়েছে ভৈরবের ভয়ংকর মূর্তি।
পরবর্তী ‘নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র’ সংগীতটিও সমবেত কণ্ঠে গীত হয়েছে। এই সংগীতটিতে যন্ত্ররাজ বিভূতির জয় ঘোষিত হয়েছে। যন্ত্রশক্তিই যাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ও গৌরবের বস্তু তাদের মানসিকতা যেন এই সংগীতটিতে ব্যক্ত। সমালোচক অরুণ কুমার বসুর এই গানটি সম্পর্কে অভিমত—“এই গানের ঘনপিনদ্ধ বাক্সম্পদ, সমস্ত জটিল শব্দের কঠিন গুরুভার যান্ত্রিক সভ্যতার আরাধনে প্রযুক্ত অহংকৃত হৃদয়বৃত্তিহীন মানুষের নিষ্ঠুরতা ও দাম্ভিকতাকে পরোক্ষভাবে উদ্ঘাটিত করে দেয়।”
এর পরেই বাউল সুরে বাউল কণ্ঠে অন্য একটি সংগীত গীত হয়েছে। এই সংগীতটির মাধ্যমে অভিজিতের পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বন্ধনমুক্ত বাঁধে। মুক্তধারায় ভেসে যাওয়া অভিজিৎ যে আর প্রত্যাবর্তন করবে না তার প্রতি ইঙ্গিত করেছে। মুক্তপুরুষ অভিজিৎ মুক্ত আত্মার জন্য সংগ্রাম বিদীর্ণ বক্ষে প্রমত্ত ঝটিকা সংগ্রামে রত হয়েছে। অর্থাৎ ‘ও তোর আর ফিরবে না’—বাউল সংগীতে অভিজিতের জীবন-তাৎপর্য ব্যঞ্জিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য নাটকের মতো মুক্তধারাতেও বৈরাগী চরিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তার নাম ধনঞ্জয়। কণ্ঠে তার উদাত্ত সংগীত। অভিজিৎ প্রেমের আবেগে কর্মক্ষেত্রে নেমে যখন সেই আদর্শ অনুসরণে ব্যস্ত তখনই আঘাত নেমে এসেছে তার ওপরে, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নাটকে ধনঞ্জয়ের প্রবেশ, মুখে তার গান—“আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে।” তাঁর এই বিশ্বাসও আছে— “পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়।” পথ তিনি দেখিয়ে দিলেও তারজন্য মানুষের কর্তব্যও আছে; যে নিজের পথের দায়িত্ব গ্রহণ করে না, তাকে পথ দেখানোর দায়িত্বও কারুর থাকে না। তাই, “আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায়।”
আঘাতে আঘাতে অন্তরাত্মা জাগ্রত হয়। পরকে পরাভূত করতে গেলে তার সম্মুখীন হতে হবে–“আরো আরো প্রভু। আরো। এমনি করেই মারো মারো।” মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে বোঝাপড়ার, হারজিতের খেলায় নিজেকে বাজিয়ে না নিলে চলে না—“এবার যা করবার তা সারো সারো— আমিই হারি কিংবা তুমিই হারো।” বিশ্বলোকেশ্বরের বিশাল রাজত্বের অভ্যন্তরে প্রবেশ দুঃসাধ্য, সেখানে স্থান পেতে হলে কৃতাঞ্জলিপুটে অগ্রসর হতে হবে। কেননা—“দ্বারী মোদের চেনে না যে, বাধা দেয় পথের মাঝে।”
ধনঞ্জয় বৈরাগী পরম আদর্শের মুক্ত আত্মার প্রতীক। তাকে বাঁধনে বেঁধে ফেলা কারু পক্ষেই সহজসাধ্য নয়। যে মানুষ মানব মহিমার কর্মক্ষেত্রে আপনাকে উৎসৃষ্ট করে তাকে তো সাধারণ বাঁধনে বাঁধা যায় না—“আমারে যে বাঁধবে ধরে এই হবে যার সাধন, সেকি অমনি হবে ?” ধনঞ্জয় বৈরাগী পরম পুরুষের বাণী শুনেছে; অহংতন্ত্রের জাল মুক্ত হয়েছে। তাই সে পরম নির্ভয়ে গেয়ে ওঠে—“আমারে পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায় কোন্ খ্যাপা সে।”
রণজিৎ ধনঞ্জয় বৈরাগীকে আটকে রাখতে চাইলে প্রজাসাধারণ বাধা দেয়, কিন্তু সে বিশ্বাস করে–টেনে কিছুই রাখা যায় না। সে উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে—”রইল বলে, রাখলে কারে, হুকুম তোমার ফলবে কবে। টানাটানি টিকবে না ভাই, হবার যেটা সেটাই হবে।” ধনঞ্জয় বৈরাগীর ভেতরের মানুষ জেগে উঠেছে বলেই সে বিশ্বাস করে যে, রণজিৎ-এর শেকল তাকে বিকল করতে পারবে না। কারণ সে দুঃখ বরণের মূল্যে পরম সত্যের উপলদ্ধিতে জ্যোতিষ্মান— “তোমার শিকল আমায় বিকল করবে না। তোর মারে মরম মরবে না।
অভিজিৎ চির চঞ্চল, চির গতিশীল মানবাত্মা, জলের প্রবাহে তার জন্ম। তাই তাকে যন্ত্রজগতের বাঁধনে বাঁধলেও তার নিত্য মুক্ত শুদ্ধ আত্মাকে তো বাঁধা যায় না। অভিজিৎকে ধরে রাখার শক্তি কারুরই নেই–কিন্তু তবুও যদি সে পার্থির শক্তিদ্বারা অবরুদ্ধ হয় তবে তার অসমাপ্ত ব্রত সম ধানের দায়িত্ব গ্রহণে উন্মুক্ত হতে হবে— “শুধু কি তার বেঁধেই তোর কাজ ফুরোবে গুণী মোর ও গুণী।” অর্থাৎ বৈরাগীকে ফেলে রাখলেও সে পড়ে থাকে না, তাকে বার বার নবজীবনের জয়যাত্রার অভিযানে বার হতেই হয়।
নাটকে সংগীতের ব্যবহার আবহ নির্মাণে, যে কত শ্রেষ্ঠ হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত মুক্তধারা নাটক। সন্ন্যাসীদের ‘জয় ভৈরব, জয় ভৈরব’ গানের সঙ্গে সঙ্গে যে গুরুগম্ভীর আয়োজনের সূত্রপাত, পরবর্তী নাগরিকদের শঙ্কা স্পন্দিত কথামালার সঙ্গে জড়িত হয়ে তা এক অশুভ পরিবেশের দ্যোতনায় মুহূর্তমধ্যে নাট্যদেহকে ব্যাপ্ত করে নেয়। এরই কিছু পরে যন্ত্রবন্দনা এবং ভৈরব পন্থীদের ‘তিমিরহৃদ বিদারণ’ গান আমাদের এমন এক বোধে সরিয়ে আনে যেখান থেকে দেখলে কেবল বাউল কেন, দর্শকদেরও মনে হবে—ও তো আর ফিরবে না। মধ্যবর্তী ধনঞ্জয়ের গানগুলিকে বহুলতা মনে হলেও ‘আগুন আমার ভাই’ গানটি কিন্তু ঘটনাকে ধ্বনিময় করে তোলে ৷ এই ধ্বনিই আবার সহস্রতায় ঝংকৃত হয়ে ওঠে নাটকের শেষ গানে, — ‘বাজেরে ডমরু বাজে’। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বলতে হয়—গান যে নাটকের অঙ্গাঙ্গি বিষয় সেটা ‘মুক্তধারাতে’ তার প্রমাণ মেলে।
Leave a comment