ধনঞ্জয়ের গানে কি ভাবে তার আত্মপরিচয় বিধৃত হয়েছে আলোচনা করো।

রবীন্দ্র-নাটকের মধ্যে বিশেষ করে সাংকেতিক নাটকের মধ্যে গান হচ্ছে রহস্যের দ্বারোদঘাটনের চাবিকাঠি। তাই সাংকেতিক পর্যায়ের নাটকের মধ্যে গানের ভাব ও অর্থ নিরূপণ করা নিতান্ত জরুরী। আলোচ্য নাটকের মধ্যে গানগুলি নানা কারণে নানা ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো গানে যেমন নাটকের মর্মকথা ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি কোনো গান কোনো বিশেষ চরিত্রের আত্মপরিচয় জ্ঞাপক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।

‘মুক্তধারা’ নাটকে সর্বমোট গানের সংখ্যা একুশটি। এই একুশটি গানের মধ্যে একটি গান গেয়েছে বাউল, একটি গানকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে আটবার গেয়েছে ভৈরবপন্থী কীর্তনের দল, একটি গেয়েছে উত্তরকূটের নাগরিকবৃন্দ এবং অবশিষ্ট এগারোটি গান গেয়েছেন একা ধনঞ্জয় বৈরাগী। ধনঞ্জয়ের গানগুলির মধ্যে বিপ্লবের কথা, অহিংস অসহযোগের কথা, অধ্যাত্মভাবনার কথা যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি অভিব্যক্ত হয়েছে মুক্তধারার মর্মকথা ও ধনঞ্জয়ের আত্মপরিচয়।

আলোচ্য নাটকে বাউলের গানের মধ্যে দিয়ে নাট্য ঘটনার একটা আভাস রচিত হবার পরে মঞ্চে ধনঞ্জয় প্রবেশ করছেন। রাজা রণজিতের আদেশে ও কৌশলে যুবরাজ অভিজিৎ বন্দী হয়ে যাবার পর মঞ্চে ধনঞ্জয়ের আবির্ভাব। তার আগে পাঠক জানতে পেরেছে, অভিজিতের আন্দোলনের ইন্ধনদাতা রূপে ধনঞ্জয়ের পরিচিতি। আবির্ভূত হবার পর জানতে পারে তাঁর অহিংস পন্থা এবং উদ্দেশ্য। কিন্তু এই ধনঞ্জয়কে জানতে পারা যায় এবং ধনঞ্জয়ের শক্তির উৎসের প্রকৃত সন্ধান পাওয়া যায় তার গানের মধ্যে। সংলাপে যে কথা সম্পূর্ণ ব্যক্ত করা সম্ভব হয় নি গানের মূর্ছনায় তা সহজে ব্যক্ত হয়েছে। ধনঞ্জয়ের সেই আত্মবিজ্ঞাপক গানগুলি সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে সাহিত্য সমালোচক বসুমিত্র মজুমদার, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তধারা’ ” গ্রন্থে বলেছেন, “ধনঞ্জয়ের আত্মপরিচয় বিজ্ঞাপিত হয়েছে তার প্রথম ও দ্বিতীয় গানে। প্রথম গানে ধনঞ্জয় বলেছেন—

‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব

বিষম ঝড়ের বায়ে

আমার ভয় ভাঙা এই নায়ে।

অর্থাৎ যাবতীয় অত্যাচার অবিচারের স্রোতের মধ্যে দিয়ে অসমসাহসিকতায় নির্ভিক আত্মপ্রত্যয়ে তিনি এগিয়ে যেতে চান- মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে / ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে’— ‘ছঁড়া পাল’ বলতে সেই সমস্ত প্রজার দল— রাজার অত্যাচারে যাদের ভরসা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে। রক্তকরবীতে যাদের আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘রাজার এঁটো’ বলে, সেই দুর্বল ভীরু শোষিত প্রজাদের নিয়ে তিনি তাঁর তরী বেয়ে ‘ওই পারেতে’ নিয়ে যাবেন। তাঁর একমাত্র সম্বল হল ঈশ্বরের ওপর ভরসা। তাই অসঙ্কোচে বলেন—

‘আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী

এই শুধু মোর দায়’।

এবং তিনি নিশ্চিত যে—

‘দিন ফুরালে জানি জানি

পৌঁছে ঘাটে, দেব আনি

আমার দুঃখদিনের রক্তকমল 

তোমার করুণ পায়ে।

তাঁর এই আত্মপ্রত্যয়ের কথা পরের গানটির মধ্যেও পরিস্ফুট। সেখানে তিনি বলেছেন—

‘আরো আরো প্রভু, আরো আরো

এমনি করেই আমায় মারো।’

কেন না, ভয় করে লুকিয়ে থাকলে তো চলবে না। সমস্ত কিছু সমর্পণ করতে না পাবলে নির্ভিক হওয়া যাবে না। মারের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ভয়কেও আঘাত করে মারনেওয়ালাই ভেঙে দেন। রবীন্দ্রনাথের ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতায় যেমন বলেছেন— ‘তোমার আঘাত সাথে নেমে এলে তুমি / যেথা মোর আপনার ভূমি’। তাই মার খেতে আপত্তি নেই ধনঞ্জয়ের। আর তারও চেয়ে বড় কারণ হল, ‘দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো’। ধনঞ্জয় তাঁর সংলাপে বলেছেন, ‘আমি মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চলেছি। মার আমার বাজে কি না তুমি নিজে বাজিয়ে নাও। যে ডরে কিম্বা ডর দেখায় তার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে এগোতে পারব না।”

এই পরিচয় জ্ঞাপনের পরেই ধনঞ্জয় গেয়েছেন, ‘ভুলে যাই থেকে থেকে / তোমার আসন- পরে বসাতে চাও নাম আমাদের হেঁকে হেঁকে’। এখানে ধনঞ্জয়ের মানসপটটি স্পষ্ট ভাবে অঙ্কিত হয়েছে। ধনঞ্জয় যে আধ্যাত্মবাদী এবং তার সাধনার মধ্যে, আন্দোলনের মধ্যে সত্যের প্রতি যে নিষ্ঠা ব্যক্ত, তার আভাস ফুটে উঠেছে এই গানে। আলোচ্য গানে তিনি বলতে চেয়েছে, যিনি আমাদের চালাচ্ছেন, আমাদের সকল কর্মের নিয়ত্তা, তাঁর আসনে আমরা নিজেদের বসিয়ে অহংকারে প্রমত্ত হই। কিন্তু স্বকপোলকল্পিত সে মান আমাদের প্রায়শই ধূলায় লুটায়। তাই সকলকেই স্মরণে রাখতে হবে, যতক্ষণ তাঁরই আসন বলে যতক্ষণ চেনা না যাবে ততক্ষণ সিংহাসনের দাবি থাকবে না। এ গান থেকে শুরু হয়েছে ধনঞ্জয়ের অধ্যাত্ম বিশ্বাসের পরিচয়। এবং ক্রমে ক্রমে পাঠক জানতে পারে ধনঞ্জয় এক গভীর বিশ্বাসের জগতে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সমস্ত জোর, সমস্ত প্রেরণা সেখান থেকেই লব্ধ। এ প্রসঙ্গে সাহিত্য সমালোচক বসুমিত্র মজুমদার বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে ধনঞ্জয় এক বিশ্বাসের জগতে প্রতিষ্ঠিত। তিনি জানেন, ‘যিনি সব দেন, তিনিই সব রাখেন।’ তাই রাজাকে নির্দ্বিধায় বলেন, ‘রাজা তুমি ভুল করছ এই যে, ভাবছ জগৎটাকে কেড়ে নিলেই জগৎ তোমার হল; ছেড়ে রাখলেই যাকে পাও মুঠোর মধ্যে, চাপতে গেলেই দেখবে সে ফসকে গেছে। ….এই গানের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক ভাবনার সংযুক্তি আছে। কিন্তু নাটকের খাতিরে সেই আধ্যাত্মিক ভাবনাকে দূরে রেখে বিপ্লববাদকে স্বীকার করাই সঙ্গত।”

তা সত্ত্বেও আমরা দেখি, এই বিশ্বাসের জগতে অধিষ্ঠিত হয়েই নাটকের শেষাংশে দেহী অভিজিতের দেহত্যাগের পর সে বলতে পারে, ‘চিরদিনের মতো পেয়ে গেলি রে। নয়ন ছেড়ে যে চলে যায় সে যে সকলের মধ্যে সহজে উপলব্ধ হয়। সীমাবদ্ধকে মৃত্যু যে পরিব্যাপ্তি দান করে— এ ভাবনা আলোচ্য নাটকে ধনঞ্জয়ের মধ্যেই ব্যক্ত হয়েছে। এবং তার কথাকে সমর্থন জানানোর জন্যেই সবশেষে ভৈরবপন্থীর দল গেয়েছে সম্পূর্ণ কীর্তনটি।