‘মুক্তধারা’ নাটকের প্রতিনায়ক কাকে বলা যেতে পারে তা আলোচনা করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তধারা’ নাটকের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র যন্ত্ররাজ বিস্তৃতির জীবন উত্তরকূটের চবুয়া গাঁয়ে ‘নেড়া বিভূতি’ পরিচয়ে সাধারণ আর পাঁচটা গ্রামবাসীর মতোই অতিবাহিত হচ্ছিল। পাঠশালাতে সে খুব একটা মেধাবী ছাত্র ছিল না। কৈলাস মাস্টারের কাছে কানমলা খেয়ে সে পড়ালেখা শিখছিল। নিতান্ত সাধারণ ছাত্রের মতোই অনুল্লেখযোগ্য শৈশব অতিবাহিত করে বেঙ্কটবর্মার কাছে স্থাপত্যবিদ্যা শিখে হঠাৎই সে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের চোখে। আজ সে রাজ-স্থপতি রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই দেখে স্বাভাবিক ভাবেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে তার স্বগ্রামবাসী। কিন্তু পরক্ষণেই তারা বিরক্ত হয়েছে বিভূতির আচরণে। তারা দেখেছে বিভূতি যেন তাদের সঙ্গে আগের মতো মিশছে না। দাম্ভিকতায় পূর্ণ নির্মম কাঠিন্যের আবরণে ঘিরে রেখেছে তার বাহ্যিক ব্যবহার – যার সঙ্গে গ্রামবাসীর সারল্য মেলে না।
বিভূতির এই স্বভাব বৈশিষ্ট্য থেকে তাকে নির্মম বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। কেন না, বিভূতি কর্তব্যে এবং কর্তব্যের খাতিরে অবিচল ও নির্মম। রাজাদেশে মুক্তধারা ঝর্নাকে বাঁধ দিয়ে বাঁধার জন্যে সে অনেক মায়ের কোল খালি করেছে। শিবতরাই অঞ্চলের প্রজাদের তৃষ্ণার ও সেচের জল বন্ধ করার জন্যে নিষ্ঠুরের মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কারো চোখের জলকে আমল দেয় নি। অনেক পুত্রহারা মায়ের অভিশাপ মাথায় নিয়ে সে অবিচল ভাবে মন্তব্য করেছে, ‘দৈবশক্তির সঙ্গে যার লড়াই, মানুষের অভিশাপকে সে গ্রাহ্য করে?’ সমস্ত অভিশাপ অবিচল ভাবে গ্রহণ করার এই মানসিকতা তার নির্ভিক ভাবে কর্তব্য-নিষ্ঠার ও কর্তব্যের কারণে নির্মমতারই প্রমাণ দান করে। কর্তব্যের কারণে নির্মমতার আর এক উদাহরণ হল, উত্তরকূটের মনুষ্যত্ব ও ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় করে তোলার পর সেখানকার লোকাভাবে চণ্ডপত্তন থেকে আঠারো বছরের ছেলেদের ধরে আনার ঘটনা। উত্তরকূটের শিশু কিশোর যেমন বাঁধ নির্মাণের কাজে এসে আর মায়ের কোলে ফেরে নি, তেমনি চণ্ডপত্তনের কিশোরদের অনেকেই তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারে নি।
রাজ-স্থপতি তথা যন্ত্ররাজ বিভূতি দাম্ভিক। দত্ত ভরে সে নিজ অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে, অভিজিৎকে উপলক্ষ্য করে, রাজা রণজিতের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘যেটা আপনারই বংশের অপকীর্তি তাতে আপনারও গোপন সম্মতি আছে।’ তার এই আচরণ, ভাবনা ও মন্তব্য শুধু দাম্ভিকতাই প্রমাণ করে না, সে যে যন্ত্রের জোরে, কর্মের জোরে রাজার ওপর শাসনের অধিকারও কায়েম করেছে তার সাক্ষ্যও দান করে। তাই বলেছে, ‘যন্ত্রের জোরে দেবতার পদ নিজেই নেব’। কথাকে বা মনের ভাবনাকে কাজে রূপায়ণের জন্যেই তার বাঁধের চূড়া ভৈরবের মন্দিরের চূড়ার বিপরীতে অবস্থিত। তার উদ্ধত মাথা অনন্ত নীল আকাশের দিকে এমন ভাবে তুলে দাঁড়িয়ে আছে যে, তাকে ‘বীভৎস চিৎকারের’ মতো দেখাচ্ছে। তার উদ্ধৃত মাথাটা দেখে রণজিৎত্ত মন্ত্রীর কাছে একান্তে জানান, ‘অতটা বেশি উঁচু করে তোলা ভালো হয় নি।’ বাঁধকে অতটা উঁচু করে তোলা দুটো অর্থ প্রতিপাদন করে। প্রথমত, উত্তরকূটের শোষণ পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যে মাথাচাড়া দিয়ে কতটা উঁচুতে উঠেছে, তারই ঔদ্ধত্বের প্রকাশ। আর দ্বিতীয়ত, যন্ত্ররাজের অভ্রভেদী অহংকারের অভিজ্ঞান। এই অহংকারই হয়েছিল যন্ত্ররাজ বিভূতির পরাজয়ের কারণ। অহংকারের উন্মত্ততায়, দত্তের মোহে অন্ধ হয়ে নিজের অধিকারের সীমারেখা ভুলে গিয়েছিল বিভূতি। তাই দেবতার আসন যেমন সে নিজে নিতে চেয়েছিল, তেমনি রাজার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপও নিজের অধিকারভুক্ত বলে মনে করেছিল। তাই রাজার অনুমতির অপেক্ষা না করেই নন্দিসংকটের ভাঙা দুর্গ গড়ে তোলবার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। রাজশক্তি বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। রাজ অনুমতি ছাড়াই রাজার প্রহরীদের নিযুক্ত করেছিল বাঁধ বাঁধার কাজে নির্বিচারে মানুষ ধরে আনার জন্যে। প্রহরীরাও কোনো রকম বাছবিচার না করে যন্ত্ররাজের আদেশে দেবমন্দিরের ঘণ্টাবাদক, যাত্রাদলের গায়ককেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল বাঁধ বাঁধার কাজে। এ ছাড়াও শিশু-কিশোরদের নির্বিচারে বাঁধের বেদীতে বলি চড়িয়ে উত্তরকূটকে করেছিল ভবিষ্যৎ শূন্য।
রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাস নাটকের চরিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে কোনো চরিত্রই নিরবিচ্ছিন্ন খারাপ নয়। অত্যন্ত মন্দ চরিত্রের মধ্যেও কোনো না কোনো ভালো গুণ বর্তমান। অর্থাৎ প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে রয়েছে ভালমন্দের মিশ্রণ। তাই চরিত্রগুলি বাস্তবতায় পূর্ণ। শুধু তাই নয় একই কারণে রচয়িতা কর্তৃক গুণারোপণের দায় থেকে চরিত্রগুলি মুক্ত। আলোচ্য নাটকের বিস্তৃতি চরিত্রটির মধ্যেও এই মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতার দন্তে দাম্ভিক বিভূতি তাই কর্তব্যনিষ্ঠ এবং অধিকার সচেতন। যদিও রাজার ক্ষমতার ওপরে সে অধিকার ফলাতে চায়। তবু দেখা যায়, পঁচিশ বছরের পরিশ্রমে যে বাঁধ সে নির্মাণ করেছে, তার নির্মাণ সমাপ্ত হলে তাকে রাজ্যবাসীর সম্পদ রূপেই সে বিবেচনা করে। তখন তাকে ভাঙার অধিকার যে তার নেই, সে কথা যুবরাজের দূতকে সে জানিয়ে দেয়। এই ন্যায় ভাবনা প্রশংসনীয়। এ তার চরিত্রের ভালো দিক। তার অন্যান্য ভালো দিকের মধ্যে আছে অধ্যবসায়। বিভূতি, যে কাজ হাতে নিয়েছে, তা ধৈর্য সহকারে শেষ করার চেষ্টা করেছে। মাঝে মাঝে বাধা বিঘ্ন এলেও হতাশ হয়ে কর্ম পরিত্যাগ করেনি বা তার কর্তব্য নিষ্ঠার বিচলন ঘটতে দেখা যায় নি। প্রায় পঁচিশ বছরের প্রচেষ্টায় বাঁধ নির্মাণ সমাপ্ত করার দৃষ্টান্ত তার অধ্যবসায়েরই প্রমাণ দান করে। রাজা রণজিতের ঈঙ্গীত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রজাশোষণ প্রক্রিয়ার সার্থক রূপকার রূপে বিভৃতি নিজেকে উপস্থাপন করেছে। তার কাজে রাজা নিশ্চিত হয়েছেন যে, তৃষ্ণার শূলে শিবতরাইকে বিদ্ধ করে তাকে তিনি (ভৈরব) উত্তরকূটের সিংহাসনের তলায় ফেলে দিয়ে যাবেন।’ বস্তুত, উত্তরকূটের নবরাষ্ট্রতন্ত্রের সার্থক রূপকার বলেই বিভূতি ‘যন্ত্ররাজ’ অভিধায় অভিহিত। এই প্রসঙ্গে সাহিত্য সমালোচকবসুমিত্র মজুমদার বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তধারা’ নাটকে বিভূতি ‘যন্ত্ররাজ’ নামে পরিচিত। বিভূতি উত্তরকূটের চবুয়া গাঁয়ের লোক। শৈশবে তিনি সাধারণ ছেলের মতো পড়াশোনার সময় গুরুমশায়ের হাতে কান মলা খেয়ে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু তার পর সকলের অলক্ষে কখন সে সকলকে ছাড়িয়ে বিশিষ্ট রাজ-স্থপতি হয়ে গেছেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের চেষ্টায় তিনি বাঁধ দিয়ে বেঁধেছেন মুক্তধারা ঝর্নার স্রোত। রাজশক্তিকে তিনি যন্ত্রশক্তির নির্ভরতা দিয়েছেন। তার ফলে উত্তরকূট ও শিবতরাইয়ে শোষণ শুরু হয়েছে যন্ত্রের মাধ্যমে। তৃষ্ণার জল, চাষের জল বন্ধ করার পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও বাঁধা-বুলি শেখানো শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রনীতি স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে তারই দৌলতে। তাই বিভূতি শুধু যন্ত্রবিদ বা রাজ-স্থপতি নন, তিনি যন্ত্ররাজ।”
রবীন্দ্রনাথ বিভূতিকে বলেছেন, ‘যন্ত্রী’ অর্থাৎ যন্ত্র নিয়স্তা। যন্ত্র দিয়ে সে রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে মুক্তধারা ঝর্নাকে বাঁধ দিয়ে বেঁধে শিবতরাই অঞ্চলের প্রজাদের তৃষ্ণার ও কৃষির জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রৈতিযুক্ত জীবনের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে, জীবনপ্রবাহের চেয়ে বুদ্ধিকে বড়ো করে তুলতে চেয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির ও জীবনের অপ্রতিরোধ্য গতিকে যে, কোনো ভাবে, কোনো শক্তি দিয়েই নিঃশেষে আবদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়, স্থাপত্যবিদ হয়েও অহংকারী যন্ত্ররাজের এ কথা সম্ভবত জানা ছিল না। অথবা বুদ্ধি ও বিজ্ঞান শক্তির জোরে দেবতার আসন নিজে অধিকার করার দম্ভে হয়তো আমল দিতে চায় নি সেই অমোঘ সত্যকে। তাই যুবরাজ অভিজিতের দূত যখন যন্ত্রের কোনো এক ছিদ্র দিয়ে ভাঙনের দেবতার প্রবেশ সম্ভাবনার কথা জানায়, তখন সে চমকে উঠেছিল। আর নাট্য পরিণতিতে হলও তাই। যন্ত্রের এক ত্রুটিকে আশ্রয় করে অভিজিৎ নিজ প্রাণ দান করে সে শিক্ষাই দিয়ে গেল বিভূতিকে- তার বৈজ্ঞানিক তথা যান্ত্রিকশক্তিকে। তার প্রাণের বিনিময়ে পথ মুক্ত হল, পরাস্ত হল নির্মম যান্ত্রিকতা, গতি পেল জীবন।
Leave a comment