‘মুক্তধারা’ নাটকের নামগুলি বিশেষ অর্থসংকেত বহন করে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উত্তরকূটের অধিবাসীদের মারনেওয়ালা, এবং শিবতরাই-এর লোকেদের ‘মারখানেওয়ালা’ রূপে অভিহিত করেছেন। উত্তরকূট কথাটার অর্থ উত্তরের পাহাড় অর্থাৎ উচ্চস্তরে যে আছে, যারা মারনেওয়ালা বলে চিহ্নিত। আর শিবতরাই কথাটির অর্থ হতে পারে যূপকাষ্ঠের নীচে। তারা অত্যাচারিত অথচ তাদের মধ্যে স্বয়ং ভগবানের অধিষ্ঠান। দেহের ভোগাকাঙ্ক্ষায় আত্মা অত্যাচারিত, যূপকাষ্ঠে আবদ্ধ আত্মা, বদ্ধ আত্মা, সে মুক্ত নয়।

এবার ব্যক্তি চরিত্রের কথায় আসা যাক। রণজিৎ কথার অর্থ যিনি চিরকাল রণে জয় লাভ করেছেন। ন্যায়-নীতি সত্যধর্ম কী তা জানার চেষ্টা করেননি। কেবল অপরের পরামর্শে চালিত। যে শক্তির দ্বারা দেহমনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তারাই আমাদের রাজা, জোরকে শক্তি মনে করা যায় বলেই রাজা হয়ে যায় রণজিৎ। কিন্তু প্রেমের শক্তির স্পর্শ পেলে তখন রণজয়ের স্পৃহা থাকে না। রণজয় কেবল বল প্রয়োগেই হয় না; নিজেকে উপলব্ধি করতে হয়।

রণজয় অপেক্ষা যিনি বিশ্বজয় করেন তিনি সবচেয়ে বড়ো। নাটকে এই বিশ্বজিৎই হলেন খুড়া মহাশয়। তিনি মোহনগড়ের রাজা। তাঁর রাজত্বের পরিবেশ মনোমুগ্ধকর সুন্দর পরিখাবেষ্ঠিত—তাঁর রাজ্য প্রেমের বেষ্টনীতে তিনি বাঁধেন বলেই তাঁর পরিখা সুন্দর। তিনি সুন্দরভাবে নত হতে জানেন। তাই তিনি বিশ্বপ্রেমিক; আর তার ফলেই বিশ্বজয় তাঁর পক্ষে সম্ভব, অহংকে লুপ্ত করলেই প্রেমে পূর্ণতা আসে আর খুড়া মহাশয়ের সেই প্রেমের জোরেই বিশ্বজিৎ।

সুমন অর্থাৎ সুন্দরমন এবং শুভংকর মন। সুন্দর মন না থাকলে প্রেমের দীপ্তি দুর্লক্ষ্য বিশ্ব জয় করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“চোখের আলো প্রাণের নিশ্বাস, সুন্দর মন না থাকলে যথার্থ আনন্দ অলভ্য থেকে যায়। আনন্দের জীবনেই প্রাণের নিঃশ্বাস প্রবাহিত আর তার ফলে চোখের দৃষ্টি হয় উজ্জ্বল। এই সুমনকেই যন্ত্রদেবতা ধ্বংস করেছেন— তারই জন্য আকুল আহ্বান শোনা যায়। দেহের ভোগের মধ্যেও মনের যতটুকু প্রেমপ্রীতি অবশিষ্ট থাকে তা আকুল হয়ে ওঠে, ভোগের সামগ্রীকে তা অতিক্রম করে উঠতে চায়। অন্ধকার যখন ঘনীভূত তখনই দেখা দেয় কঠিন প্রতিক্রিয়া, আর সেই কঠিন প্রতিক্রিয়ার আঘাতে সুন্দর মন প্রত্যাগমন করে।

উদ্ধব কথাটির অর্থ যজ্ঞাগ্নি। আহুতির জন্য অগ্নির প্রয়োজন, না হলে যজ্ঞ হয় না। উদ্ধব রাজপ্রহরী। সে ধনঞ্জয়কে বন্দি করে এনেছে। বাঁধন ছেঁড়ার জন্যই বন্ধনের প্রয়োজন ছিল। অপরদিকে বন্দিশালায় আগুন লাগিয়ে সে অভিজিৎকে মুক্তিদান করেছে। যজ্ঞাগ্নি এই বন্দিশালাতেই জ্বলে উঠল, অভিজিৎ মুক্ত হয়ে যজ্ঞকে পরিপূর্ণ করে তুলল পূর্ণাহুতির মাধ্যমে।

‘বটু’ শব্দের অর্থ ব্রহ্মচারী বা ভৈরব বিষয়। তাকে আঘাত দিয়ে ভৈরবকে জাগরণের কাজ অনেকটা এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মচারী বলেই সে ভোগের বন্ধনে আবদ্ধ নয়, বন্ধনাতীত, বিশ্বের মূলসত্য তার কাছে উদ্‌ঘাটিত। অমবস্যার রাত্রে ভৈরব পূজা যে দম্ভের পূজা ব্যতীত আর কিছুই নয়, একথা সে উপলব্ধি করেছে। ভৈরবের আহ্বান যে শুনেছে তার নিষ্কৃতি নেই। আত্মবলিদান তাকে দিতেই হবে।

‘গণেশ’ শব্দের অর্থ হল জনগণের প্রধান, শক্তি থাকলেও বুদ্ধিহীন। মারখানেওয়ালারা যখন অত্যাচারে মরিয়া হয়ে ওঠে তখন তার পরিচয় আছে গণেশের মধ্যে। গণেশ বলে ওঠে “আর সহ্য হয় না হাত দুটো নিশপিশ করছে। কিন্তু এই গণেশের যে বুদ্ধি নেই তার পরিচয় আছে—“চললুম কিন্তু আমাদের বলবুদ্ধি রইল এখানে পড়ে।”

‘সঞ্জয়’ শব্দের অর্থ সম্যকরূপে জয়লাভ করা। নিজের প্রেম অভিজিৎকে দিয়ে সে সম্পূর্ণরূপে জয়ী হয়েছে। কচি মনের কোমল অন্তরের প্রীতিতেই সে আনন্দিত। ভয়ংকরের মূর্তি তাকে শঙ্কিত করে—“দেখছ না যুবরাজ ও যন্ত্রের চূড়োটা সূর্যাস্ত মেঘের বুক ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন উড়ন্ত পাখির বুকে বান বিঁধেছে, সে তার ডানা মুড়িয়ে রাত্রির গহ্বরের দিক পড়ে যাচ্ছে। আমার এ ভালো লাগছে না।” এমনকি সে সকালে যে শ্বেতপত্র তুলে দিয়ে আসে অভিজিৎকে তার সেই ভীরু গোপন পূজাও গোপন করতে পারে না। সেই সরলতার জন্যে একমাত্র সে অভিজিতের আত্ম-বিসর্জনের সাক্ষী হতে পেরেছিল। ভালোবেসে সে অভিজিৎকে বুঝতে পেরেছিল।

‘বিভূতি’ শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য। ঈশ্বর লাভের সাধনায় যে সাধক সে যদি ঐশ্বরিক বিভূতি লাভ করে সন্তুষ্ট হয় তাহলে সে মূলের সন্ধান পায় না। শক্তি লাভ করে যদি শক্তির মোহে পতিত হয় তবে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। বিভূতি ঈশ্বরের দান, কিন্তু ঈশ্বরের উদ্দেশ্য মঙ্গল সাধনের জন্য বিভূতি দান। যদি কেউ সেই উদ্দেশ্যে বিস্মৃত হয় তবে ঐশ্বর্য হয় অন্ধশক্তির উৎস এবং তখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবার শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থপ্রসারণ (বি-ভূ + ক্তি)। অর্থাৎ নিজেকে প্রসারণ করাই যার ধর্ম। ঋগ্বেদে শব্দটি ‘সর্বব্যাপী’ ও ‘অনুপ্রবেশক’ অর্থে ব্যবহৃত। মহাভারতে শব্দটির অর্থ ‘ক্ষমতাশালী’, আলোচ্য নাট্যকাহিনিতে সম্ভবত বিভূতির তাৎপর্যবাচকতা হল, সে মন্ত্রশক্তির সাহায্যে উত্তরকূটের শাসনব্যবস্থায় সর্বাত্মক কর্তৃত্ব স্থাপনে অনুপ্রবিষ্ট।

‘ধনঞ্জয়’ হল ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে ঐশ্বর্যকে জয় করেছে ; বিভূতি ঐশ্বর্যলাভ করে থেমে গেছে, আর ধনঞ্জয় ঐশ্বর্য লাভের জন্য লোভকে জয় করে উচ্চতর মার্গে আরোহণ করে মূলের সন্ধান পেয়েছে। সে জ্ঞানী, সে তত্ত্ব ও সে মুক্তির সন্ধান রাখে। ঐশ্বর্যের প্রয়োজন দেহের, আত্মার প্রয়োজন হয় মুক্তিলাভ। ধনঞ্জয় সেই মুক্তির অগ্রদূত এবং জয়ের অভিমুখে যার যাত্রা সুনিশ্চিত।

‘অভিজিৎ’ শব্দের অর্থ বিজয়ী, নক্ষত্র, প্রায়শ্চিত্ত বিশেষ। এই নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করলে নর ললিতকাস্তি সম্পন্ন, বিনীত, কীর্তিমান, সুবেশ, দেব দ্বিজে ভক্তি এবং স্পষ্ট বক্তা হয়। অভিজিৎ মারনেওয়ালাদের হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে আকাশে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে মারখানেওয়ালা এবং মারনেওয়ালা উভয়কেই মহান আদর্শের সন্ধান দেয়। এইভাবে মুক্তধারা নাট্যাস্তর্গত ব্যক্তিচরিত্রের নামকরণগত তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।