‘মুক্তধারা’ (১৯২২) নাটকের পূর্বপরিকল্পিত নাম ছিল ‘পথ’। ‘পথ’ নামটি পরবর্তীকালে পরিত্যক্ত হলেও এটি নামকরণের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পথের ওপরেই নাটকটি অভিনীত হয়েছে। মানুষ পথে নেমেছে। কারুর পথচলা আদর্শ অনুযায়ী, কেউ বা পথে নেমেও অন্ধকারে পথ হাতড়ে মরে। পথের গোলকধাঁধায় তারা হতকচিত। এক পথের পথিক বিভূতি, যন্ত্র সভ্যতার রথে চড়ে সে পথে বার হয়েছে। আর এক পথের পথিক অভিজিৎ ধনঞ্জয় বৈরাগী— তারা কল্যাণের পথ আবিষ্কারে রত। এই দুই পথের সংঘর্ষই নাটকটির মূল বক্তব্য। পথই তো মানুষের জীবনকে নির্দিষ্ট করে। যে পথে বার হয়নি সে জীবনকে জানে না। পথের সাহায্যেই মানুষ লক্ষ্যে উপনীত হয়। এ নাটকের দুই পথিকের সংঘর্ষে জীবনের পথের সন্ধান পাওয়া যায়।
মুক্তধারা নাটকের পথ ভৈরব মন্দিরে গমনের পথ। এই পথের পার্শ্বে রাজা রণজিতের শিবির স্থাপিত। রাজা পদব্রজে ভৈরব মন্দিরের আরতি দেখতে যাবেন বলে পথেই বিশ্রামরত, অপেক্ষমান। উত্তরকূটের সমস্ত লোক, ভৈবর মন্দির প্রাঙ্গণে উৎসবের জন মিলিত হতে চলেছে। নাটকের সমস্ত ঘটনা ঘটেছে পথের ওপেরই। পথের এই গভীর তাৎপর্যমূলক সংকেতের কথা মনে রেখে বোধ করি রবীন্দ্রনাথ বলতে সচেষ্ট হয়েছিলেন—“আমি সমস্ত সপ্তাহ ধরে একটা নাটক লিখেছিলুম…এর নাম পথ।”
‘পথ’ শব্দটি এক বিশেষ তাৎপর্যের পরিচয়বাহী। পথ অবিরাম চলার প্রতীক— জীবনের নিরস্তর অগ্রসর হওয়া। পথের ওপরেই জীবনের বিচিত্র ঘটনা ঘটছে, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হচ্ছে আর মানুষ সেই গতি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ক্রম অগ্রসরমান। পথকে অবলম্বন করেই মানুষ জীবন থেকে জীবনাত্তরে এগিয়ে চলেছে। সে কখনও কোনো স্থানেই আবদ্ধ নয়, সে চিরপথিক—কোথাও তার স্থায়ী আবাস নেই। জীবনের যা কিছু সঞ্চয় পথেই নিঃশেষ আবার বৃদ্ধিও পথে। কবে কোন অনাদি অতীতে মানুষ পথে বহির্গত হয়েছে, আর কবেই বা তার পথ চলা শেষ হবে তা কেউ জানে না। অর্থাৎ পথ সীমাহীনতার ইঙ্গিতবাহী। সমালোচক কনক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতে—পথই অজানা নিরুদ্দেশের পানে জীবনকে নিয়ে যায়। পথই মানুষকে মৃত্যুর তোরণ উত্তীর্ণ করে অমৃতলোকের কূলে পৌঁছে দেয়।
অন্যদিকে, ‘মুক্তধারা’ নামের এই পার্বত্য ঝর্ণা কিন্তু প্রত্যক্ষত দৃশ্যগ্রাহ্য নয়; অথচ নাটকের বিভিন্ন সংলাপে, ভাবে, বক্তব্যে তার উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাটকের আদ্যন্ত তারই ভূমিকা। মুক্তধারা ঝর্ণার কল্লোলিত ধ্বনি ও চরিত্র সমূহের আবেগোল্লাস শেষ পর্যন্ত আমাদের নিয়ে যায় নাটকের সমাপ্তিতে। পূর্বনাম ‘পথ’, পরবর্তী নাম ‘মুক্তধারা’ বাধামুক্ত জীবনস্রোতের তীব্র গতিশীলতায় দর্শক পাঠককে আবেগ স্পন্দিত করে তোলে। প্রবহমানতা, গতিশীলতা মানবজীবনের, সভ্যতার ধর্ম ; তাকে রুদ্ধ করলে প্রকৃতিকে, স্বভাবকে রুদ্ধ করতে হয়, মানবকল্যাণবিরোধী শাসন মানবজীবনের গতি রুদ্ধ করে মানবতার অস্তিত্বকে সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ‘মুক্তধারা’ নামকরণে রবীন্দ্রনাথ এই তত্ত্বধর্মিতাকে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন।
‘পথ’ নাটকের পরিবর্তিত নামকরণ ‘মুক্তধারা’ হলেও ‘মুক্তধারা’ নামটি অবশ্য অনেক কাব্যগুণ সমৃদ্ধ ; যদিও কাব্যগুণ সমৃদ্ধ এই জাতীয় নামকরণের একমাত্র শর্ত নয়। নাটকটির— উপসংহারে রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের যে মূল্য নির্ধারণ করেছেন, তার সঙ্গে মুক্তধারা নামকরণটি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মুক্তধারা নামকরণে পথের সংঘাত ও দ্বন্দ্ব অপেক্ষা মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই প্রবল। অবশ্য তারজন্য সংঘর্ষের কথাও একেবারে অগোচরে থাকে না। নাটকে দুটি ভাবধারার সংঘাতে কোন্টি শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করবে, ‘মুক্তধারা’ নামটি সেই সংকেত বহন করে মনকে দোদুল্যমান রেখে রক্তের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টির পরিবর্তে গভীর প্রশান্তি আনয়ন করে। কনকবাবুর মতে— “মুক্তধারা আসলে জীবনের প্রতীক। নাটকে মুক্তধারা ও জীবনকে অভিন্ন বলে ধরা হইয়াছে। মুক্তধারার ধর্ম চলা, জীবনের ধর্মও তাই। মুক্তধারার মতো গতিতেই জীবনের পরিচয়, গতির মধ্যেই জীবনের সার্থকতা।”
মৃত্যু জীবনের নব মূল্যায়ন করে—মানবজীবনের তাৎপর্য অন্বেষণ করায় উপলব্ধি করায়। এই রীতি মুক্তধারার মধ্যে অভিনিবিষ্ট। কারণ, মানবজীবনের অব্যাহত স্বচ্ছন্দ, অবিরাম গতিই মুক্তধারা। গতির স্রোতে মানুষ নিত্য ভাসমান। জন্ম-জন্মান্তরের নানা অবস্থার মাধ্যমে সে নিত্য অগ্রসরমান। গতিই জীবনের স্বরূপ; গতিতেই জীবনের সার্থকতা। গতির স্রোেত রুদ্ধ হলেই মানুষের অন্তরাত্মা পীড়িত হয়ে ওঠে, নানা জালজঞ্জাল ও ক্লেদাক্ততায় তার সাবলীল প্রাণের লীলা ব্যাহত হয়। মানুষ তার নিত্যমুক্তবুদ্ধিমান আত্মাকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়। এই রুদ্ধ অবস্থা জীবনের বিকৃতি ও অসত্যরূপ। সর্ববন্ধন মুক্ত গতিই মানবজীবনের স্বরূপ, মুক্তধারাই তার জীবনের প্রতীক।
রাজশাসন যন্ত্রশক্তির সহায়তায় মানুষের সচল জীবনধারায় বাধা সৃষ্টি করেছে। যন্ত্র সর্বস্বতায় মানুষের অন্তরাত্মা পীড়িত। কুমার অভিজিৎ সেই নিপীড়িত মানবাত্মার প্রতীক। সমগ্র বিজিত পরাধীন জাতীয় অন্তরাত্মার প্রতীক ধনঞ্জয় বৈরাগী। একজনের বিদ্রোহ বুদ্ধি ও বিজ্ঞানদৃপ্ত যন্ত্রশক্তির বিরুদ্ধে, আর একজনের বিদ্রোেহ প্রচলিত যান্ত্রিক ব্যবস্থাবিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে। উভয়েই মানব মুক্তির সপক্ষে। অর্থাৎ এই নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় এমনটি বলে লেখক এর নামকরণ করেছেন মুক্তধারা।
তাই বলতে হয়, তত্ত্বের দিক দিয়ে মানবাত্মার স্বরূপ নির্দেশের ওপরই কবি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কোনো বন্ধন মানব আত্মাকে আবদ্ধ করতে পারে না, মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনের মুক্ত স্বরূপকে ফিরে পাওয়া যায়—কবির এই ইঙ্গিতই সমগ্র নাটকের মর্মকেন্দ্রে বিরাজিত। স্বীয় মুক্তি এবং সমগ্র বদ্ধ মানবের মুক্তিকামনা বর্তমান নাটকের বিষয়বস্তু বলে স্বীকার করতেই হয়। নাটকটির নামকরণ মুক্তধারা, সার্থক ও সঙ্গত হয়েছে।
Leave a comment