নাটকের কথাবভু বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজার আদেশে যন্ত্ররাজ বিভূতি লৌহযন্ত্রের বাঁধের সাহায্যে মুক্তধারার গতি রুদ্ধ করেছেন। তাঁর এই অসামান্য স্মরণীয় কীর্তিকে পুরস্কৃত করার জন্য সমস্ত উত্তরকূটবাসী ভৈরব মন্দিরে উৎসব করতে চলেছে। যে দুটি প্রতিবেশী রাজ্যের সম্ভাবে, প্রীতিতে, মৈত্রীতে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থায় থাকার কথা ছিল, তাদের মধ্যে ভেদাভেদের অনৈক্যের সূচনা হয়েছে। আর এরজন্য দায়ী বিভূতি। শিবতরাইয়ের চরম দুর্ভোগে উত্তরকূট রাজ্যের মানুষ প্রথম ‘গৌরব’ অনুভব করেছে। তাদের মানসিকতা তাদের কথাবার্তায় তা প্রকাশিত। পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্বন্ধভেদের এই আত্মঘাতী চেতনা তাদের এমনভাবে প্ররোচিত করেছে যে, তারা জীবনের সহজ সুন্দর কল্যাণের মঙ্গলের প্রেমের প্রীতির ব্রতভ্রষ্ট হয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার দাস হয়েছে। তারা স্বার্থান্ধতায়, ব্যক্তিসর্বস্বতায় ও অহংচেতনায় পূর্ণ হয়েছে।

অমাবস্যায় ভৈরবমন্দিরে আরতি দেখতে রাজা স্বয়ং যাত্রা করেন। পথে শিবিরে তিনি বিশ্রামরত। যন্ত্ররাজ বিভূতি সুদক্ষ শিল্পীর ন্যায় দক্ষতা সহকারে রাজার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করেছে। ফলে রাজার রাজনৈতিক অভীষ্ট সিদ্ধির পথটি প্রশস্ত হয়েছে। রাজাও আত্মপ্রসাদে পরিপূর্ণ চিত্ত ; কেননা তাঁর পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ হওয়ায় প্রসারণ সার্বিক-ক্ষেত্রে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আর সেটাই রাজার একান্ত প্রার্থিত। কিন্তু দেবারতি দেখতে যাবার পথে রাজা সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন যে, রাজশক্তির প্রতীকরূপে নির্মিত লৌহযন্ত্রের মাথাটা যেন ভৈরব চূড়ার প্রতিস্পর্ধী আস্ফালনের ঔদ্ধত্য, আত্মম্ভরিতা, অহংকার নিয়ে দণ্ডায়মান। ওটাকে এত বেশি উচুঁ করা ভালো হয়নি।

রাজা রণজিৎ এক কঠিন আত্মপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। তাঁর মনের গহনে উদ্যত প্রশ্ন, তাঁর ভিতরকার মানুষটি কি সত্যই ততো বড়ো, যে বড়োত্বের জোরে শিবের অপসারণ ঘটিয়ে শক্তিকে মাথা তুলে দাঁড়াবার অবকাশ করে দিয়েছেন। তাহলে মাথা কার কাছে নত করতে হবে কোন্ পথটি শ্রেয়— বিভূতিময় শক্তির পথ, না শিবময় প্রেমের পথ? শ্রেয় ও প্রেয়— এর দ্বন্দ্বে রাজার চিত্ত উম্মুখর, শংশয়গ্রস্ত। আজ যার উদ্দেশ্যে তিনি পূজার্ঘ্য নিবেদনের জন্য যাত্রা করেছেন—তিনি কি তাঁর অর্ঘ্য গ্রহণ করবেন ? আত্মবিশ্লেষণমুখী রাজার মনে হয়, এ অর্ঘ্য আত্মম্ভরিতা ও ধ্বংসাত্মক মনোভাবের স্পর্শ মিশ্রিত। এ অর্ঘে ভক্তির প্রণতি কোথায় ? তাঁর শাসনব্যবস্থা অভিনব হতে পার কিন্তু এযেন পেষণযন্ত্র।

অভিজিৎ শিবতরাইয়ের জনজীবনের যাত্রাপথের অচলতা চিরকালের জন্য নির্মূল করে দেবার উদ্দেশ্যে তাঁর অমূল্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁর আত্মোৎসর্গে মানবকল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে আছে এক আলোকাভিসারী মন যা তাঁর মধ্যে গতি সঞ্চার করেছে তাকে উদ্ধোধিত করেছে আত্মোৎসর্গের প্রেরণায়। অভিজিতের জন্ম রাজবাড়িতে নয়, তিনি ঘরছাড়া সন্তান, মুক্তধারার ঝর্ণাতলায় তাকে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে। তিনি ঘরছাড়া পথের পথিক বলেই গৌরীশিখরের দিকে তাকিয়ে দুর্গম পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভাবীকালের পথ দেখতে পেতেন— যা ছিল দূরকে নিকট করার পথ। ‘মুক্তধারার’ কলধ্বনি তাঁর চিত্তের গহনে জাগিয়ে তুলেছিল মাতৃস্নেহের আস্বাদ। “এ জলের শব্দে আমি আমার মাতৃভাষা শুনতে পাই।” যখন তিনি জানলেন যে, তাঁর জন্ম রহস্যাবৃত, তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর জন্মলগ্নে গিরিরাজ তাঁকে পথেই অভ্যর্থনা করেছেন। ঘরে শঙ্খধ্বনি তাঁকে ঘরে ডাকেনি। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ অভিজিৎ চরিত্রে মুক্তধারার বহতা ভাবটি অনুপ্রবিষ্ট করিয়ে তাঁর চিত্তে আত্মার নির্বোধ অজেয় শক্তি সারিত করে দিয়েছেন।

মানুষের জন্ম প্রকৃতিলোকে, মুক্তাবস্থায় তারপর নানাকারণে পরিবেশের প্রবাহে সে নানা বাঁধনে বাঁধা পড়ে। বন্ধন যখন এবং যেখানে কৃত্রিম এবং দুঃসহ তখনই মানুষের নিত্যবুদ্ধ শুদ্ধ আত্মা, মুক্তবুদ্ধির বিবেক সেই বন্ধন মোচনের আপ্রাণ চেষ্টায় রত হয়। সে সংগ্রাম করে সামগ্রিক পারবশ্যতার বিরুদ্ধে। অভিজিৎ মুক্তধারার অনন্ত স্রোতোপ্রবাহের সঙ্গে তাঁর প্রাণ প্রবাহের, জন্মসূত্রলব্ধ আত্মিক ও অবিচ্ছেদ্য জন্মসূত্র সম্পর্ক উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন প্রত্যয় দীপ্ত কণ্ঠে—“জন্মকালের ঋণ শোধ করতে হবে, স্রোতের পথ আমার ধাত্রী তার বন্ধনমোচন করবো।” তাঁর জীবনের লক্ষ্যই হল বন্ধনমুক্ত পথের বাধা মোচন করা।—”আমি পৃথিবীতে এসেছি পথ কাটবার জন্য, এই খবর আমার কাছে এসে পৌঁচেছে।”

মুক্তধারার নির্বাধস্রোতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে জেনে অভিজিৎ উপলব্ধি করেছিলেন, উত্তরকূটের রাজসিংহাসন তাঁর কাছে জীবনস্রোতে বাঁধস্বরূপ। কেননা, এ সিংহাসন তাঁর জীবনের স্বাভাবিক ধারাকে স্বাভাবিক স্রোতে প্রবাহিত হতে দেবে না। এইজন্যেই তাঁর যাত্রা শুরু হল পথে, তিনি হলেন পথিক। পথে না বেরোলে মুক্তির সাধনায় সিদ্ধিলাভ হবে না। তিনি এ বিষয়ে প্রত্যয়ী ছিলেন যে, মানুষকে নিজের পথ নিজেই অন্বেষণ করতে হবে। পথ খোঁজার সাধনা একক সাধনা।

অন্যদিকে, ধনঞ্জয় বৈরাগীর দলভূক্ত শিবতরাইয়ের প্রজারা ধনঞ্জয়ের ওপর নিজেদের ভালোমন্দের ভার দিয়েছিল; কিন্তু চরম বিপদের দিনে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে সংশয় আর অসহিষ্ণুতা। স্বীয় স্বাধীন চিন্তা না থাকায় তারা পথ খুঁজে পায়নি। অভিজিতের প্রতি তাদের ভক্তি ছিল কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত। অভিজিতের মতো পথের অন্তগূঢ় তাৎপর্য তারা উপলব্ধি করতে পারেনি। তাঁর মধ্যে তারা প্রত্যক্ষ করেছিল ভীতিহীন চিত্তের বিকাশ। তারা দেখেছিল এক বীর্যমান ব্যক্তিত্বকে যে অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার-শাসন-শোষণ-হিংসা কুশ্রীতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রদীপ্ত। অভিজিৎ নামকরণটিও প্রতীকী ব্যঞ্জনায় আলোকিত—এ যেন সেই আকাশ, পৃথিবীর মতো ভীতিহীন, শংকরাহীন, ‘অভীঃ’ মন্ত্রে দীক্ষিত চিরকালের মানুষ।