‘মুক্তধারা’ নাটকে ঘটনার স্বল্পতা সংলক্ষ্য। পরস্পর অসংলগ্নতা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টিতে অক্ষম ; ফলে কাহিনিতে পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিণতিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়। এই জাতীয় নাটকের গঠনকৌশল কালগত ও কার্যকারণ সম্পর্কে গ্রথিত ঘটনা ধারা থেকে উৎসারিত হয় না। তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা ও চরিত্র কল্পিত হওয়ায় তত্ত্বের বিভিন্ন দিক তারাই অর্থাৎ ঘটনা এবং চরিত্র তুলে ধরে। সামগ্রিক কাহিনির পরিপ্রেক্ষিত ‘মুক্তধারার’ গঠন কৌশল হয়তো পরস্পর সংলগ্ন নয়; কিন্তু তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; আর এখানেই ‘মুক্তধারার’ গঠন কৌশলের বিশিষ্টতা নিহিত।
নাটকে যবনিকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় একদল সন্ন্যাসী ভৈরবের জয়গান গেয়ে মঞ্চ ত্যাগ করে। পর মুহূর্তেই দর্শক দেখেন মঞে দুজন লোক প্রবেশ করে কিছু কথাবার্তা বলছে যার মধ্য দিয়ে দর্শক জানতে পারেন যে, উত্তরকূটে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে যন্ত্রবিদ্ বিভূতির দীর্ঘ পঁচিশ বছরের চেষ্টার পর। অতঃপর মঞ্চে প্রবেশ ঘটে অম্বার, যে তার একমাত্র হারানো সন্তান সুমনের খোঁজ করে। অম্বাকে নাটকে অবশ্য এই একটিবার দেখা গেছে। পথিকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। এর পরে মঞ্চে যন্ত্ররাজ বিভূতি ও যুবরাজ অভিজিতের দূত প্রবেশ করে। অভিজিতের বক্তব্য তারা বহন করে আনে।
রাজা রণজিৎ মন্ত্রী ও বিশ্বজিতের কথোপকথন অংশে নাট্যকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটা ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা জনগণের পক্ষে এমনই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে, তারা যে-কোনো উপলক্ষ্যে শাসকজাতির বিরোধিতা করতে থাকে। এরপরে শিবতরাই-এ প্রজারা যখন খাজনা বন্ধের দাবি তুলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তখন রাজনৈতিক জগতে একটা পরিবর্তন ঘটে যায়। শোষণে অতিষ্ঠ প্রজারা আর পূর্বের মতো ভয়ে মুখ বুজে থাকতে চায় না—দমননীতি সত্ত্বেও তারা ক্রমশই তাদের দাবি সম্পর্কে সোচ্চার হয়।
রাজা ও মন্ত্রীর কথোপকথন অংশের শেষদিকে মঞ্চে গুরুর সঙ্গে শিষ্যদের প্রবেশ ও ঘটনাগতভাবে যুক্ত হওয়ার ব্যাপার অনিবার্য নয় এবং এই তথ্য কাহিনির প্রয়োজনে কোনো নতুন ঘটনারও সংযোজন করেনি, অর্থাৎ এক্ষেত্রেও প্লট-গঠন ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তত্ত্বনিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এই অংশে নাট্যকার দেখিয়েছেন, শাসক জাতি ও শোষক শ্রেণি নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য স্বাজাতির সমস্ত মানুষের কাছে উগ্রজাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রচার ক’রে জাতীয় স্বার্থের আদর্শকে বড়ো করে তোলে। সেই আদর্শ জাতির সমস্ত মানুষকে একই ভাবনার সূত্রে সংহত করে। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে শাসকশ্রেণি স্বদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও কাজে লাগায়।
তত্ত্বোপস্থাপনের পরবর্তী পর্যায় শুরু হয় ধনঞ্জয় সহ শিবতরাইয়ের নাগরিকদের প্রবেশ ও কথোপকথন থেকে। এই অংশে নাট্যকার উত্তরকূটের ঔপনিবেশিক শাসনে ও শোষণে নিপীড়িত মানুষ অমানবিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছে তারই তাত্ত্বিক দিকটা তুলেছেন। উপনিবেশের জনগণের কাছে শাসকশ্রেণির শোষণ ও দমননীতি যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে বলে মনে হয়, তখন তারা তার প্রতিরোধ এগিয়ে আসে। ঠিক এইখানেই তাদের সঙ্গে তাদের নেতা ধনঞ্জয়ের পার্থক্য। ধনঞ্জয় তার নেতৃত্বে এতই আস্থাশীল যে, তারা তার নির্দেশ ব্যতিরেকে এক পাও চলতে সক্ষম নয়। এরপর মঞ্চ থেকে ধনঞ্জয় নিষ্প্রান্ত হয় এবং তার অনুপস্থিতিতে উত্তরকূটের নাগরিকদের মুখোমুখি করে শিবতরাই-এ মানুষদের উপস্থাপনা করা হয়েছে।
নাট্যকার উত্তরকূট ও শিবতরাই-এ চরিত্রগুলিকে পর্যায়ক্রমে উপস্থাপনা করে তাঁর নাটকের বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করলেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে নাট্যকাহিনির সম্ভাবনা, বিকাশ ও পরিণতির প্রস্তুতি নিলেন। প্রথম দুটি পর্যায়ে সংকটের পরিচয় পাওয়া যায় মূলত চরিত্রগুলির কথাবার্তা থেকে। এই সংলাপের মধ্য দিয়ে একথাও জানা যায় যে, সংকট সৃষ্টিকারী ও সংকট থেকে মুক্তিকামীদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এরপর প্রত্যাশা জেগেছে, এই দ্বন্দ্বের পরিণতি কী হবে তা দেখার। এইখানেই প্লট নির্মাণের তৃতীয় ও শেষ পর্যায়। প্লট গঠনে রবীন্দ্রনাথ যে সামান্য কাহিনিকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন তার এই দুটি পর্যায় মিলিতভাবে নাট্যকাহিনির কথা বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করেছে। সুতরাং কাহিনি নির্মাণের পরিভাষা অনুযায়ী এটিকে পরবর্তী পর্যায়ে উপস্থাপনা অংশ বলা যেতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে ঘটেছে কাহিনির বিকাশ ও পরিণতি।
সর্বোপরি, ‘মুক্তধারার’ প্লট প্রচলিত নাট্যরীতির অনুসারে অঙ্ক ও দৃশ্যে বিভক্ত করে উপস্থাপিত না হলেও উল্লিখিত তিনটি পর্যায়কে অঙ্ক বিভাজনের সঙ্গে সমীকৃত করা চলে। আর নাট্যকার ‘মুক্তধারায় দৃশ্যপটের পরিবর্তন নিরপেক্ষভাবে দৃশ্য-বিভাজনের ক্রম অনুসরণে করেছেন; যা ঘটনার ওপর নির্ভরশীল নয়, বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে। দৃশ্যানুযায়ী উপস্থাপনরীতির সঙ্গে পার্থক্য এইটুকুই যে, এখানে দৃশ্যপটের পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়নি—একই ঘটনাস্থল পথে, কয়েকটি চরিত্রের এসে কিছু কথা বলা অথবা কিছু করে চলে যাওয়ার পরেই সম্পূর্ণভাবে অন্য চরিত্রগুলি প্রবেশ করেছে। এইদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে—উত্তরকূট অঙ্কের প্রথমদৃশ্য ভৈবরপন্থীদের নিয়ে। দ্বিতীয় দৃশ্য এদের নিয়ে যন্ত্রকে কেন্দ্র করে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত হয়েছে। তৃতীয় দৃশ্যে বক্তব্যের প্রতিনিধিরা হল বিভূতি, অভিজিতের দূত ও বিভূতি সমর্থক উত্তরকূটের নাগরিক দল। এইভাবে ক্রমশ নাট্যকাহিনি দৃশ্যের পর দৃশ্যের দ্বারা পরিবৃত হয়ে পরিণতির দিকে ধাবিত হয়েছে।
তাই বলতে হয়, তাত্ত্বিক নাট্যবিষয় নাটকীয় বিভাজনরীতি অনুসারে স্তরে স্তরে উপস্থাপিত হয়ে নাটকটির প্লটনির্মাণ কৌশলকে একটা অনন্যতা দান করেছে—যা রবীন্দ্রনাথের মৌলিকত্ব প্রমাণ করে।
Leave a comment