“মীর মশাররফ হোসেন সমাজ-সচেতন শিল্পী।”
ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের চর্চায় যে-কজন মুসলিম সাহিত্য-সাধক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন [১৮৪৭-১৯১২] সর্বাধিক খ্যাতিমান। লেখকের দীর্ঘ সাহিত্যিকজীবনে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন এ অঞ্চলের ইতিহাস ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ভাঙা-গড়া। বিশেষকরে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি মানব সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসময় বহুবিধ বিবর্তন, সংঘাত ও পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। সমাজ ও স্বকালের বিবিধ বিষয় তাই সহজেই প্রযুক্ত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে তাঁর বিচরণ ছিল সব্যসাচী লেখকের মতো। তাই বাঙালি মুসলিম লেখকদের অগ্রপথিক হিসেবে তাঁর নাম স্মরণীয়। তিনি একাধারে গদ্য, পদ্য, নাটক, প্রহসন, নকশাধর্মী গ্রন্থ এবং আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর
রচনায় ক্ষুরধারাভাব প্রকাশ হতে থাকে।
বিষাদ-সিন্ধু’র পর মশাররফ হোসেন এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০) ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯)। এ গ্রন্থ দুটিতে মশাররফ হোসেন সমকাল-সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। এ দুটি রচনায় সমাজ সংস্কৃতির নকশা ফুটে উঠেছে। নিচে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করার প্রয়াস পাব।
‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’য় লেখকের ব্যক্তিগত পটভূমি সুবিস্তৃত হলেও একমাত্র নয়। পারিবারিক এবং বাস্তব ঘটনার রূপ এ গ্রন্থে ধরা পড়েছে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে নীলকরের অবাধ অত্যাচারের কাহিনি-চিত্র উদঘাটন করাই ছিল এ রচনার লক্ষ্য। অকপট সত্যভাষণের অসাধারণ গুণের অধিকারী হওয়ার জন্যই মশাররফ হোসেন তাঁর গ্রন্থে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সত্য কথা বলতে দ্বিধা করেননি। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ গ্রন্থে কোথাও বিন্দুমাত্র স্ববিরোধী খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোনো কোনো সমালোচক এ গ্রন্থে মশাররফ হোসেন এর পিতার প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্বের যে অভিযোগ এনেছেন, তার বড় কারণ সম্ভবত বইটি না পড়ে এমনকি না দেখেই মন্তব্য করেছেন। মীর সাহেব এ গ্রন্থে বার বার বলেছেন, তাঁর পিতা ইংরেজভক্ত এবং শুধু নীলকর কেনী নয় সবই ইংরেজ নীলকরদের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সম্পত্তির লোভে তাঁর পিতাকে জামাই সাগোলাম আজম যখন বিষ খাওয়ায় তখন একমাত্র কেনীর সাহায্যেই তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কেনীর সঙ্গে তাঁর ‘বিশেষ প্রণয় ছিল’। তিনি লাঠিয়াল দিয়ে কেনীকে সাহায্য করেছেন একথাও মশাররফ হোসেন বলেছেন। (উল্লেখ্য এ কেনী সাহেব ছিলেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের কুখ্যাত নীলকর টি. আই, কেনী) তাঁর পিতার মনে দেশবাসীদের জন্য গভীর মমতাও ছিল। প্যারী সুন্দরী কেনীকে ‘জব্দ’ করলে মীরের পিতা বলেছেন- “ধন্য বাঙ্গালীর মেয়ে, সাবাস সাবাস! সাহেবকে একেবারে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে।” প্যারীর মুখ দিয়ে লেখক প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরেছেন: “যে উপায়ে হউক রাজ্য রক্ষা করিতে হইবে। ও বেলাতী কুকুর, এদশের সকলকেই দংশন করবে।”
‘উদাসীন পথিকের কথা’ গ্রন্থে মশাররফ হোসেন এর মানস বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছে। এখানে তিনি রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ জটিলতার মধ্যেও পড়েছেন। (তাঁর বাবা নীলকরের সাহায্যকারী, কেনীর বন্ধু, ঘোর আমুদে, বাইজীভক্ত, সাঁওতাল জমিদারি জামাই এর ষড়যন্ত্রে হারিয়ে ফেলেছেন, পিতার রক্ষিতা মাতাকে বিষ প্রয়োগ করেছে অন্যদিকে কৃষকগণ এবং কয়েকজন জমিদার নীলকরদেরও নীল চাষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে; সম্পত্তি আত্মসাৎকারী জামাই গোলামাজ্জম ঝোপ বুঝে কোপ মেরে নেতা সেজেছেন।) মশাররফ হোসেন এর পিতা নীলকরের সমর্থক, লেখক নীলচাষের উচ্ছেদে, কৃষক কেন্দ্রর বিদ্রোহে উল্লসিত। কেনীর অত্যাচারকে তিনি ঘৃণার সঙ্গে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থটিতে সর্বত্রই সাধারণ মানুষের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন এবং পিতৃবন্ধু অত্যাচারী কেনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা দ্বিধাহীনভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন। সাহসী, সত্যভাষী, মানব-দরদী মহান এক সাহিত্যিকরূপেই মশাররফ হোসেন এ গ্রন্থে নিজের মহিমা এবং সমাজসচেতনতাকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন।
‘বিষাদ-সিন্ধু’র পর মশাররফ হোসেন এর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯)। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ মশাররফ হোসেন এর অন্যতম আত্মজীবনীমূলক রচনা। এতে তাঁর পরিণত বয়সের কর্মজীবনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বজীবনীমূলক রচনা হলেও গাজী মিয়ার বস্তানী ব্যঙ্গ বিদ্রূপাত্মক রচনা। কাহিনির আবেদনকে ব্যাপকতা দানের উদ্দেশ্যে, কোনো কোনো চরিত্রের চোখে ধূলো দেওয়ার মতলবে এবং সম্ভবত নিজের নিরাপত্তার জন্য লেখক এ গ্রন্থের স্থান ও পাত্র-পাত্রীর জন্যে বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এই কাল্পনিক নাম ব্যবহার আত্মজীবনীর আদর্শের পরিপন্থি। কিন্তু মশাররফ হোসেন এর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে পরিচয় থাকলে ছদ্মনামের অন্তরালে কারা কি ভূমিকায় আছেন, তা বুঝতে বা চিনতে অসুবিধে হয় না। কর্মস্থল দেলদুয়ারের অভিজ্ঞতা বস্তানী রচনার প্রধান উৎস। ‘যমদ্বার’ হলো দেলদুয়ার আর পয়জারন্নেসা হলেন করিমুন্নেসা চৌধুরানী। গাজী মিয়া ও ভেড়াকান্ত লেখক স্বয়ং।
‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ শুরু হয়েছে অরাজকপুরের হাকিম ভোলানাথ এবং কুঞ্জনিকেতনের বেগম সাহেবার বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এখানে লেখক বিচিত্র নামকরণের মাধ্যমে কাহিনির গতিবিধি এবং অগ্রসারমানতার প্রস্তাবনা করেছেন। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র উদ্দেশ্য প্রবণতা গ্রন্থে বর্ণিত পাত্র-পাত্রী ও স্থানের নাম থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায়। জমিদারের নাম সাবলেট চৌধুরী, পয়জারন্নেসা, সোনাবিবি, মনিবিবি ইত্যাদি।
‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ মশাররফ হোসেন এর কর্মস্থল দেলদুয়ারের তিক্ত অভিজ্ঞতা ‘বস্তানী’ রচনার প্রধান উৎস বলে ধরে নেওয়া যায়। গ্রন্থে বর্ণিত ‘যমদ্বার’ হলো দেলদুয়ার আর ‘পয়জারন্নেসা’ হলেন করিমুন্নেসা চৌধুরানী। উল্লেখ্য মশাররফ হোসেন এরই অধীনে দেলদুয়ার স্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। সুতরাং স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র কাহিনি ও ঘটনাংশের পটভূমি দেলদুয়ার স্টেট, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ। ইতঃপূর্বে রচিত ‘নববাবু বিলাস’, ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ইত্যাদি নকশা-জাতীয় গ্রন্থে প্রধানত হিন্দু সমাজের কাহিনিহি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মশাররফ হোসেন এর ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র বর্ণিত সমাজ হিন্দু মুসলমানের মিশ্র সমাজ।
অরাজকপুরের হাকিম ভোলানাথ ও কুঞ্জনিকেতনের বেগম পয়জারন্নেসার সম্পর্ক বর্ণনার মধ্য দিয়ে গাজী মিয়া তার বস্তানী শুরু করেন। বস্তানীর নায়িকা চরিত্রের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন: “গাজী মিয়ার নায়িকা সুন্দরী বড়ই সুন্দরী কিন্তু মিছরীর ছুরি; মিষ্ট অথচ প্রাণনাশক। তাঁহার মন্ত্র-স্বার্থসিদ্ধি, অর্থাৎ কার্য্যোদ্ধার। তিনি কার্য্যোদ্ধারের জন্য কিনা করিয়াছেন; কিনা করিতে পারেন। তাহাতে ধর্মের ভান আছে, ধর্মভাব নাই; প্রেমের ভান আছে, প্রেম নাই।”
মশাররফ হোসেন ছিলেন স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী। তাঁর এক একটি চরিত্র ব্যঙ্গ বিদ্রূপের তীব্র কষাঘাতে আপনাতে আপনি সুস্পষ্ট। এক একটি বাক্যের প্রকাশ ভঙ্গির তীক্ষ্ণতায় চরিত্রগুলো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। মশাররফ হোসেন এর চরিত্রাঙ্কনের এই দক্ষতা সম্পর্কে অক্ষয়কুমার মৈত্রের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য: “লিপি কৌশল গুণে পাত্র-পাত্রীগণের চরিত্র এমন পরিষ্কার ফুটিয়া উঠিয়াছে, যেন চিনি চিনি করিয়া অঙ্গুলি নির্দেশের ক্ষমতা জন্মিতে পারে। চৌকিদার, কনষ্টেবল, দারোগা, ইনস্টোর বাবু, সাবরেজিস্ট্রার, সাবডেপুটি, স্পেটি মুন্সেফ শিক্ষক, গোপন শিক্ষক, উকিল মোক্তার, জেলখানার ওয়ারডার ও সরকারি ডাক্তারবাবু, ইহাদিগকে না চিনেন মপলে এমন বাঙ্গালি দুর্লভ। সুদখোর মহাজন, কলহ লিপ্ত জমিদার, ফিকিরবাজ নাএব গোমস্তা, ধড়িবাজ অমাত্য বর্গ, ইহাদিগের সহিত পরিচয় নাই মপস্বলে এমন কে আছেন?”
তাঁর আত্মত্মজীবনী ‘আমার জবানী’তে মশাররফ হোসেন উল্লেখ করেছেন যে, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র অনেক ঘটনা তাঁর জীবন থেকে আহরিত। মশাররফ হোসেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে করিমন্নেসা খানমের জমিদারিতে ম্যানেজার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মনিবের বিরাগভাজন হয়ে পরে তাকে চাকরিস্থল পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। এই কর্মস্থল দেলদুয়ারের অভিজ্ঞতাই তাঁর বস্তানী রচনার প্রধান উৎস।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশের তথকথিত অভিজাত সমাজে কতদূর নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক দুর্নীতি প্রবেশ করেছে ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে’ মশাররফ হোসেন তা উদ্ঘাটিত করেছেন। তৎকালীন বাংলাদেশের জমিদারদের জীবনে যে যথোচ্ছাচার এবং উচ্ছৃঙ্খলতার কথা আমরা শুনি তার একটি আশ্চর্য দক্ষ পরিচয় আমরা পাই তাঁর এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থে মশাররফ হোসেন এক বিধবা জমিদারকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন এবং তাঁর আমলা ও কর্মচারীদের জাল জুয়াচুরির চিত্র এঁকেছেন। অন্যপক্ষে একজন অত্যাচারী জমিদারের পরস্ত্রী অপহরণের কাহিনি, দরিদ্রের সর্বস্ব অপহরণ এগুলো রসসিক্ত কুটিলতায় প্রকাশ পেয়েছে। এই গ্রন্থে সমাজ জীবনের আরো বিচিত্র ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। যেমন- মামলা-মোকদ্দমায় হাকিম উকিলদের বড়োদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং ছোটোদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করেও বিশ্বাসঘাতকতা করা, বিপদের দিনে বন্ধুর চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা, ডাক্তার-দারোগার অবৈধ অর্থোপার্জন, মানুষে মানুষে বিশ্বাসহীনতা, তাদের মধ্যে সততা ও সাধুতার নির্বাসন ইত্যাদি। তৎকালীন মুসলমান জমিদারদের মন-মানসিকতা ও সাধারণ মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি বাস্তব চিত্র তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন “জমিদারগুলি এমন বে আক্কেল, ধর্মের জন্য দান করে না। কেবল নাম কিনবার দান। কেমন মজার দান। টাকা অভাবে কত মুসলমান বালক গরুর দলে মিশেছে, টাকা অভাবে কত ভদ্র বংশের ছেলে কত প্রকার নীচ ব্যবসা অবলম্বন করেছে।… কত দুধের ছেলে কয়েক ফোঁটা দুধের জন্য এক মুটো ভাতের জন্য ছটফট করছে, সেদিকে লক্ষ নাই। আপন ধর্ম কর্মের দিকে দৃষ্টি নাই। কেবল নাম ফুটাবার জন্য দান।”
‘গাজী মিয়ার বস্তানী’তে বাংলাদেশের একালের সমাজ জীবনের শঠতা এবং প্রবঞ্চনার চিত্র বিস্তৃত পরিধি নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। সমাজের মোহলিপ্ত স্বার্থান্ধ মানুষ নামধারী এক একটি জীবকে মশাররফ হোসেন তাঁর কলমের এক
একটি খোঁচায় যে নামে ফুটিয়েছেন, তাদের নামই তাদের চরিত্রকে পাঠকের কাছে সুস্পষ্ট করে দেয়।
সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ এবং ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ উভয় রচনাতে মীর মশাররফ হোসেনের সমাজ-সচেতনতার প্রভাবটি সুস্পষ্ট। এর মধ্য দিয়ে তিনি যেমন সমাজের অনাচার- অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরেছেন- একই সাথে সমাজ শোধনেরও স্বপ্ন দেখেছেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment