ভূমিকা: ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের দিকে মুসলমানদের মধ্যে ক্রমশ সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনতা দেখা দেয়। তাঁরা আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আত্মনিয়োগ করতে থাকে। কালের হিসেবে এ যুগের শ্রেষ্ঠ মুসলমান লেখক মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১]। রচনার সংখ্যাধিক্য ও প্রতিভার গৌরবে তিনি বাংলার সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে সুপরিচিত হয়ে আছেন। বিষয়-আঙ্গিকের দিক থেকে এগুলো হলো নাটক, প্রহসন, উপন্যাস, কাব্য, ধর্ম বিষয়ক রচনা, জীবন-চরিত আত্মজীবনী প্রভৃতি।

নিচে তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনার বিষয় ও শিল্পরূপ আলোচনা করা হলো:
‘বিষাদ-সিন্ধু’র পর মশাররফ হোসেনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০)। মুখ বন্ধের শেষে লেখকের ছদ্মনাম ব্যবহৃত হয় ‘উদাসীন পথিক’। এই গ্রন্থে মোট ৪২টি পরিচ্ছেদ বা অধ্যায় আছে। প্রত্যেক পরিচ্ছেদকে লেখক ‘তরঙ্গ’ নামে অভিহিত করেছেন এবং প্রতিটি বিষয়ের পরিচয় জ্ঞাপক শীর্ষনামও দিয়েছেন। যেমন-প্রথম তরঙ্গ ‘নীলকুঠী’, দ্বিতীয় তরঙ্গ ‘মীর সাহেব কে’, তৃতীয় তরঙ্গ ‘প্যারী সুন্দরী’ ইত্যাদি।

নীলকর শোষিত ও অত্যাচারিত পল্লি বাংলার চিত্র পাওয়া যায় মশাররফ হোসেনের উদাসীন পথিকের মনের কথায়। মশাররফ হোসেনের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ায়, সেখানকার নীলকরদের অত্যাচারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এই গ্রন্থ রচিত। ‘নীল-বিদ্রোহ’ সম্বন্ধে বহু তথ্য মশাররফ হোসেনের জানা ছিল; এমন কি নীল বিদ্রোহের একটা ইতিহাস লেখার ইচ্ছেও তাঁর ছিল।

‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ গ্রন্থে পাশাপাশি দুটি কাহিনি স্থানালাভ করেছে। এক, শালঘর মধুয়ার নীল কুঠীয়াল টি. আই. কেনী সাহেবের অত্যাচার, তার অত্যাচারে জর্জরিত অসহায় দরিদ্র চাষিদের চিত্র এবং সে নির্যাতিত চাষিদের পক্ষাবলম্বন করে জমিদার প্যারী সুন্দরীর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। দুই, মীর পরিবারের, বিশেষকরে মশাররফ হোসেনের পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন এবং মাতা দৌলতন নেসার সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা-বিজড়িত জীবনের বর্ণনা। এই দুটি কাহিনি ধারা কখনো পরস্পর সংলগ্ন, কখনো বিচ্ছিন্ন। উভয় ধারার মধ্যে আবার একাধিক স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ বিদ্যমান।

‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ কোন শ্রেণির রচনা এ নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এটিকে শ্রেণিভুক্ত করেছেন ‘উপন্যাস’ হিসেবে। মুনীর চৌধুরী এটিকে আত্মজীবনীমূলক রচনায় পর্যায়ভুক্ত করেছেন; ‘ভারতী ও বালক; পত্রিকার মতে পুস্তকখানি ঠিক উপন্যাস নহে। সমালোচনার দৃষ্টিতে বিচার করলে একে সার্থক আতাজীবনী বা উপন্যাস কোনটিই বলা চলে না। আত্মজীবনী ও উপন্যাসের একটি সংমিশ্রিত রূপ এতে ফুটে উঠেছে।

টি.আই. কেনী একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। এই চরিত্রাঙ্কনে লেখক তুলনামূলকভাবে অধিকতর শিল্পচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। লেখকের পিতা মীর সাহেব কেনীর বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন, তত্সত্ত্বেও এই গ্রন্থে কেনীকে প্রবঞ্চক রূপে অঙ্কন করা হয়েছে। প্যারীসুন্দরীর মুখ দিয়ে লেখক বলেছেন- ‘ও বেলাতী কুকুর এ দেশের সকলকেই দংশন করিবে। সে বিষে সকলেই জজ্জরীভূত হইবে।’

‘নীলদর্পণের’ তোরাপের মতো একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চরিত্র মশাররফ হোসেন সৃষ্টি করতে পারেননি, সত্য; তবে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি চরিত্রের পরিচয় এতে আছে; তা হলো জমিদার প্যারীসুন্দরী। অসহায় প্রজাদের দুর্গতি ও দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে জমিদার প্যারীসুন্দরী যে বলিষ্ঠ প্রতিরোধের ব্যুহরচনা ও প্রতিবাদী প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

স্বদেশ প্রেমের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের উল্লেখও এতে আছে। কেনীর মুখ দিয়ে আমাদের অনৈক্যের প্রতি শ্লেষসূচক ইঙ্গিতের পর লেখক দেখিয়েছেন যে, নীল-আন্দোলনে বাঙালির এই দুর্নাম আংশিক হলেও দূর হয়েছে। যেমন- “হিন্দু মুসলমান একত্রে একযোগে পূর্ণ উৎসাহে বক্ষ বিস্তার করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিল। কাহারও কোন কথা কানে করিল না। কাহারও বাধা মানিল না… হিন্দু মুসলমান একত্রে আপন আপন ইষ্ট দেবতার নাম করিয়া সার বাঁধিয়া পথে বাহির হইল।… সকলেই যেন জেল হইতে খালাস পাইয়াছে। নীলকরদের ষড়যন্ত্রের ফলে এদেশের লোকই এদেশের শত্রু হয়ে যায়। স্বার্থের কারণে এই দেশীয় অনেকেই নীলকরদের পক্ষাবলম্বন করেন, স্বদেশীয়দের সর্বশান্ত করেন। দেশের লোকের একটা অংশ অর্থের কারণে নীলকরদের পক্ষে, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে অবশিষ্ট জনগণও নানাভাবে বিভক্ত। এই বিভেদকে দূর করে এদেরকে এক করে শত্রুর বিরুদ্ধে মোর্চা গঠনের ঐকান্তিক বাসনাও ব্যক্ত হয়েছে এতে। প্যারীসুন্দরীর মাধ্যমে লেখক বলেছেন:

“প্রকাশ্য যাহাই করুক, হিন্দু মুসলমানকে এক ভাবা চাই। শত্রুর বিনাশ করিতে একতা শিক্ষা করা চাই। একতাই সকল অস্ত্রের প্রধান অস্ত্র। জাতিভেদে হিংসা, জাতিভেদে ঘৃণা, দেশের মঙ্গল জন্য একেবারে অন্তর হইতে চিরকালের জন্য অন্তর করা চাই।”

তবে শৈল্পিক বিচারে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’র তুলনায় শ্রেষ্ঠ। দরিদ্র কৃষক সাধারণের দুখ-দুর্দশার কথা ‘উদাসীন’ এ স্থান পেলেও এটিই এই গ্রন্থের মূল বিষয় নয়। এ গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ মীর পরিবারের অন্দর মহলের এবং মীরের অন্তর্জীবনের সংবাদ, কেনীর জুলুম বা প্রজার প্রতিবাদের বিবরণ নয়।

‘বিষাদ-সিন্ধু’র পর মশাররফ হোসেন এর অন্যতম আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯)। দুই খণ্ডে বিভক্ত এ গ্রন্থে মোট চব্বিশটি অধ্যায় আছে। ‘বিবি কুলসুম” গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, গাজী মিয়ার বস্তানী বহু শাখা প্রশাখা বিজড়িত উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত একটি সামাজিক নক্ষাজাতীয় রস রচনা বিশেষ। প্রায় পঞ্চাশজন পাত্র-পাত্রীর বিচিত্র  চরিত্রের এই বিরাট মিছিলের মাধ্যমে লেখক সে যুগের সমাজ জীবনের শঠতা এবং প্রবঞ্চনার চিত্রসহ সমগ্র সমাজ চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’ শুরু হয়েছে অরাজকপুরের হাকিম ভোলানাথ এবং কুঞ্জনিকেতনের বেগম সাহেবার বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এখানে লেখক বিচিত্র নামকরণের মাধ্যমে কাহিনির গতিবিধি এবং অগ্রসরমানতার প্রস্ত বিনা করেছেন। ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’র উদ্দেশ্য প্রবণতা গ্রন্থে বর্ণিত পাত্র-পাত্রী ও স্থানের নাম থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায়। জমিদারের নাম সাবলেট চৌধুরী, পয়জারন্নেসা, সোনাবিবি, মনিবিবি ইত্যাদি।

‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ ১৩০৬(১৮৯৯) সালে প্রকাশিত হলেও লিখিত হয়েছিল এর কয়েক বছর আগে। মশাররফ হোসেন এর কর্মস্থল দেলদুয়ারের তিক্ত অভিজ্ঞতা ‘বস্তানী’ রচনার প্রধান উৎস বলে ধরে নেওয়া যায়। গ্রন্থে বর্ণিত ‘যমম্বার’ হলো দেলদুয়ার আর ‘পয়জারন্নেসা’ হলেন করিমুন্নেসা চৌধুরানী। উল্লেখ্য মশাররফ হোসেন এরই অধীনে দেলদুয়ার স্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। সুতরাং স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র কাহিনি ও ঘটনাংশের পটভূমি দেলদুয়ার স্টেট, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ। ইতঃপূর্বে রচিত ‘নববাবু বিলাস’, ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ ইত্যাদি নকশা-জাতীয় গ্রন্থে প্রধানত হিন্দু সমাজের কাহিনিহি বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মশাররফ হোসেন এর ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র বর্ণিত সমাজ হিন্দু মুসলমানের মিশ্র সমাজ।

‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র প্রধান চরিত্র হচ্ছে তিনজন মুসলমান মহিলা জমিদার-পয়জারন্নেসা, মনিবিবি ও সোনাবিবি। এরা সবাই বিধবা পুরুষ চরিত্রের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ভোলানাথ বা হাকিম সাহেবের চরিত্র। তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও তাৎপর্যপূর্ণ আরো কয়েকটি চরিত্র হচ্ছে ভেড়াকান্ত, দাগাদারী ও জয়ঢাক। এছাড়া অনেকগুলো অপ্রধান চরিত্র আছে, যাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। তবু কাহিনির আয়তন বৃদ্ধি ও কাহিনিকে বর্ণবহুল করার ক্ষেত্রে এদের একটা ভূমিকা আছে। সমগ্রভাবে গোটা পাঞ্চাশেক চরিত্রের এক বিরাট মিছিলের বিচিত্র সমাহার ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’।

অরাজকপুরের হাকিম ভোলানাথ ও কুঞ্জনিকেতনের বেগম পয়জারন্নেসার সম্পর্ক বর্ণনার মধ্য দিয়ে গাজী মিয়া তার বস্তানী শুরু করেন। বস্তানীর নায়িকা চরিত্রের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন: “গাজী মিয়ার নায়িকা সুন্দরী বড়ই সুন্দরী কিন্তু মিছরীর ছুরি; মিষ্ট অথচ প্রাণনাশক। তাঁহার মন্ত্র-স্বার্থসিদ্ধি, অর্থাৎ কার্য্যোদ্ধার। তিনি কার্য্যোদ্ধারের জন্য কিনা করিয়াছেন; কিনা করিতে পারেন। তাহাতে ধর্মের ভান আছে, ধর্মভাব নাই; প্রেমের ভান আছে, প্রেম নাই”

মশাররফ হোসেন ছিলেন স্বচ্ছ অন্তদৃষ্টির অধিকারী। তাঁর এক একটি চরিত্র ব্যঙ্গ বিদ্রূপের তীব্র কষাঘাতে আপনাতে আপনি সুষ্পষ্ট। এক একটি বাক্যের প্রকাশ ভঙ্গির তীক্ষ্ণতায় চরিত্রগুলো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। মশাররফ হোসেন এর চরিত্রাঙ্কনের এই দক্ষতা সম্পর্কে অক্ষয়কুমার মৈত্রের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য: “লিপি কৌশল গুণে পাত্র-পাত্রীগণের চরিত্র এমন পরিষ্কার ফুটিয়া উঠিয়াছে, যেন চিনি চিনি করিয়া অঙ্গুলি নির্দেশের ক্ষমতা জন্মিতে পারে। চৌকিদার, কনষ্টেবল, দারোগা, ইনস্টোর বাবু, সাবরেজিস্ট্রার, সাবডেপুটি, ডেপুটি মুন্সেফ শিক্ষক, গোপন শিক্ষক, উকিল মোক্তার, জেলখানার ওয়ারডার ও সরকারি ডাক্তারবাবু, ইহাদিগকে না চিনেন মপস্বলে এমন বাঙ্গালি দুর্লভ। সুদখোর মহাজন, কলহ লিপ্ত জমিদার, ফিকিরবাজ নাএব গোমস্তা, ধড়িবাজ অমাত্য বর্গ, ইহাদিগের সহিত পরিচয় নাই মপস্বলে এমন কে আছেন?”

তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জবানী’তে মশাররফ হোসেন উল্লেখ করেছেন যে, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র অনেক ঘটনা তাঁর জীবন থেকে আহরিত। মশাররফ হোসেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে করিমন্নেসা খানমের জমিদারিতে ম্যানেজার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মনিবের বিরাগভাজন হয়ে পরে তাকে চাকরিস্থল পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। এই কর্মস্থল দেলদুয়ারের অভিজ্ঞতাই তাঁর বস্তানী রচনার প্রধান উৎস।

উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশের তথকথিত অভিজাত সমাজে কতদূর নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক দুর্নীতি প্রবেশ করেছে ‘গাজী মিয়ার বস্তানীতে’ মশাররফ হোসেন তা উদঘাটিত করেছেন। তৎকালীন বাংলাদেশের জমিদারদের জীবনে যে যথেচ্ছাচার এবং উচ্ছৃঙ্খলতার কথা আমরা শুনি তার একটি আশ্চর্য দক্ষ পরিচয় আমরা পাই তাঁর এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থে মশাররফ হোসেন এক বিধবা জমিদারকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন এবং তাঁর আমলা ও কর্মচারীদের জাল জুয়াচুরির চিত্র এঁকেছেন। অন্যপক্ষে একজন অত্যাচারী জমিদারের পরস্ত্রী অপহরণের কাহিনি, দরিদ্রের সর্বস্ব অপহরণ এগুলো রসসিক্ত কুটিলতায় প্রকাশ পেয়েছে। এই গ্রন্থে সমাজ জীবনের আরো বিচিত্র ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি।

‘গাজী মিয়ার বস্তানী’র ভাষা সরল সাধু ভাষা। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অনেক আরবি-ফারসি শব্দ এতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- উকিল, মোক্তার, আমলা, মঞ্জুর, মশহুর, দরখাস্ত, বেআক্কেল, বেকসুর ইত্যাদি। ইংরেজি ভাষা থেকেও কিছু কিছু শব্দ এতে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- কোর্ট, পুলিশ, ইনেসপেক্টর, জজ, ডিসমিস ইত্যাদি। উনিশ শতকের শেষের দিকে অভিজাত মহলে যে হিন্দি ও উর্দুর ব্যবহার আমরা প্রত্যক্ষ করি এই গ্রন্থে হাকিম সাহেবের ভাষায় তার প্রভাব লক্ষণীয়। এই গ্রন্থে সাধু ভাষা ব্যবহৃত হলেও সংলাপের ক্ষেত্রে কথ্যরীতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ‘গাজী মিয়াঁর বস্তানী’র বিভিন্ন অংশের সংলাপের মধ্যে যে সমস্ত কথিত বাক্য আমরা পাই এবং লেখকের বর্ণনার মধ্যে ভাষার যে প্রকাশ আমরা লক্ষ করি তা নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।

মশাররফ হোসেন তাঁর শব্দ ব্যবহারের চাতুর্যে এবং বাক্যের অসাধারণ প্রকাশ ক্ষমতার সাহায্যে গ্রন্থের চরিত্রগুলোকে অপরিসীম দৃশ্যমানতায় উন্মোচিত করেছেন। ঘটনাগুলো উপন্যাসের ন্যায় বিস্ময়জনক হলেও, সত্যের ন্যায় সরল। যার এক প্রান্তে রয়েছে অলোদ্ভূত শোভনতা, অন্যপ্রান্তে নিরলোদ্ভূত এবং নিরহঙ্কার বাচ্যতা। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর সমতুল্য অধিকার এবং সুনিশ্চিত শাসন। মশাররফ হোসেন তাঁর ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’তে সুন্দর সুন্দর শব্দ-বিন্যাস ও প্রবাদ বাক্যের
ব্যবহার করেছেন। যেমন-

১. ধরি মাছ নাই ছুই পানি।
২. উড়ো খই গোবিন্দায় নম।
৩. রথ দেখা কলা বেচা।
৪. পুরুষের দশ দশা কখনো হাতি কখনো মশ। ইত্যাদি।

‘গাজী মিয়ার বস্তানী’তে বাংলাদেশের একালের সমাজ জীবনের শঠতা এবং প্রবঞ্চনার চিত্র বিস্তৃত পরিধি নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। সমাজের মোহলিপ্ত স্বার্থান্ধ মানুষ নামধারী এক একটি জীবকে মশাররফ হোসেন তাঁর কলমের এক একটি খোঁচায় যে নামে ফুটিয়েছেন, তাদের নামই তাদের চরিত্রকে পাঠকের কাছে সুস্পষ্ট করে দেয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।