সূচনা: নানকিং-এর সন্ধি (১৮৪২ খ্রি.)র আগে ইউরােপের বিভিন্ন বণিকজাতি চিনের ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করতে আসে। সেই সূত্রে এখানে কয়েকটি খ্রিস্টান মিশনারি সংগঠন আসে। নানকিং-এর সন্ধির পর চিনের অন্তত পাঁচটি বন্দরে এবং টিয়েনসিন-এর সন্ধি (১৮৫৮ খ্রি.)র পর চিনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে মিশনারিরা প্রবেশ করে। পিকিং-এর সন্ধির (১৮৬০ খ্রি.) দ্বারা তারা চিনে জমিজমা কেনার অধিকার পায়। তারা চিনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা করে, মুদ্রিত বাইবেল, ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি গ্রন্থ প্রচার করে। এভাবে তারা চিনে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নিলে পশ্চাৎপদ চিনা সমাজ-সংস্কৃতিতে এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে।
[1] পাশ্চাত্যের আধুনিক ভাবধারা: খ্রিস্টান মিশনারিরা চিনে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে বিদেশিদের প্রতি চিনের মানুষের শ্রদ্ধার মনােভাব তৈরি হতে থাকে। এভাবে প্রাচীন কনফুসীয় মতাদর্শের ওপর নির্ভরশীল চিনের রক্ষণশীল সমাজ-সংস্কৃতি ক্রমে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে শুরু করে। ম্যাকেনজির লেখা ‘The Nineteenth Century: A History’ গ্রন্থে ইউরােপীয়দের আদর্শ ও অগ্রগতির অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয়।
[2] বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগ: উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে চিনের প্রগতিশীল সমাজসংস্কারক ও বুদ্ধিজীবীগণ চিনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। অনেকেই মনে করতেন যে, মাঞ্চু রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটিয়ে চিনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কার আন্দোলনের প্রয়ােজন রয়েছে।
[3] ১৮৯৮-এর সংস্কার আন্দোলন: পাশ্চাত্য ভাবধারায় প্রভাবিত চিনের বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে এক সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। চিনের প্রাচীন ও পিছিয়ে-পড়া ভাবধারা ছেড়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণে আধুনিক ভাবধারার প্রসারের উদ্দেশ্যে এই আন্দোলন শুরু হয়। চিনা ও ইউরােপীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। চিনা দার্শনিক কাংইউ-ওয়ে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
[4] বিংশ শতকের আন্দোলন: খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে চিনে ছড়িয়ে পড়া পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাবে চিনে এক বৌদ্ধিক আন্দোলন শুরু হয়। চিনে রাজতন্ত্রী ও প্রজাতন্ত্রীদের মধ্যে প্রবল লড়াইয়ের সময় এই বৌদ্ধিক আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সমন্বয়ে আধুনিক চিন গড়ে তােলা। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে চিনের প্রাচীন কনফুসীয় দর্শন ত্যাগ করে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ ও জীবন পরিচালনার দাবি জোরদার হয়। এবিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন কাংইউ-ওয়ে এবং লিয়াং- চি-চাও প্রমুখ বুদ্ধিজীবী।
[5] ছাত্রদের ভূমিকা: বিংশ শতকের শুরুতে চিনের বহু ছাত্র আধুনিক শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান ও অন্যান্য দেশে পাড়ি দেয়। আমেরিকায় পাঠরত ছাত্রদের মধ্যে অগ্রগণ্য হুশীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিপ্লবী আন্দোলনের পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে নতুন চিন প্রতিষ্ঠা করা। হু শী চিনে সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিপ্লবের বিশেষ প্রয়ােজন অনুভব করেন। এর ফলে চিনে এক বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
উপসংহার: ইউরােপীয় খ্রিস্টান মিশনারিরা চিনে আধুনিক পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রসার ঘটালেও তাদের অতি সক্রিয়তার ফলে চিনের প্রাচীন ঐতিহ্য ও ধর্ম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তারা বিভিন্ন কৌশলে দরিদ্র চিনাদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। ধর্মান্তরিত চিনারা ইউরোপের আচার- আচারণ ও বেশভূষা গ্রহণ করে চিনের ঐতিহ্যবাদী সংস্কৃতির নিন্দায় মুখর হয়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে চিনের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব জেগে ওঠে। ঐতিহাসিক ইমানুয়েল সু মনে করেন যে, প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধাচরণকারী ধর্ম হিসেবে খ্রিস্টধর্মই চিনে বিদেশিদের বিরােধিতার মূল কারণে পরিণত হয়।
Leave a comment