ইংল্যান্ডের সাহিত্যগগনে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র শেকসপীয়রের পরেই যাঁর নাম উল্লেখযোগ্য তিনি হচ্ছেন জন মিল্টন (১৬০৮-৭৪ খ্রিঃ)। জন্মস্থান লণ্ডন। কেম্ব্রিজ থেকে এম. এ. পাশ করার পর তাঁর ছাত্রজীবনের একটা পর্যায় শেষ হয়। তারপর নিরালা গৃহকোণে চলে তাঁর প্রস্তুতির তপস্যা, দ্বিতীয় ছাত্রজীবন। গ্রীক, ল্যাটিন, ইউরোপের অনেকগুলি ভাষা এমনকি হিব্রুও গভীর নিষ্ঠা ও অনুরাগের সঙ্গে তিনি শিক্ষা করেন। সঙ্গীতেও তিনি দক্ষতা লাভ করেছিলেন।

তারপর কিছুকাল পরে তিনি বহির্গত হলেন ইউরোপ ভ্রমণে। ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি ঘুরে গ্রিসে যাবার পথে তিনি দেশে রাজনৈতিক গোলযোগের সংবাদ পান। ফিরে এলেন দেশে। এই সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের সঙ্গে পার্লামেন্টের বিরোধ আরম্ভ হয়, তারপরই শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই বিরোধে পার্লামেন্টের হয়ে প্রজাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। জড়িয়ে পড়লেন রাজনৈতিক সংগ্রামে। ক্রমওয়েল বনাম রাজশক্তির সংগ্রামে প্রথম চার্লস নিহত হন। এই সময়ের রচনাগুলি সবই রাজনৈতিক রচনা। এই রচনাগুলির মধ্যে ‘আরিওপাজিটিকা’ (Areopagitica) এক উল্লেখ্য গ্রন্থ। ‘আরিওপেগাস’ ছিল প্রাচীন এথেন্স জনসভার স্থান, তা থেকেই ‘আরিওপাজিটিকা’। গ্রন্থটিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সপক্ষে এবং মত প্রকাশের উপর সরকারী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মিল্টনের অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। চিন্তাশীলতা, যুক্তি ও তেজস্বিতার জন্য এই গদ্য রচনাটি সুপ্রসিদ্ধ। প্রবন্ধ গ্রন্থটি লেখা হয়েছে তৎকালীন লর্ডসভা ও কমন্সসভার সদস্যদের সম্বোধন করে। তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ। জনগণ বনাম রাজশক্তির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে অসির চেয়ে মসীকেই তিনি অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন ন্যায়, নীতি ও ধর্মের পক্ষে।

সাংসারিক জীবন মিল্টনের খুব সুখের ছিল না। তিনি পর পর তিনবার বিবাহ করেন। তাঁর জীবিত সন্তানদের মধ্যে সবকটিই মেয়ে। জীবনের শেষ কয়েক বছর তাঁর কাটে গ্রামের বাড়িতে। ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মিল্টনের চোখের অসুখ শুরু হয়েছিল, ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে পুরোপুরি তিনি দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে পড়লেন। বাইরের দিক থেকে তাঁর উপরে যতই আঘাত এসেছে ততই তিনি অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন। এই অন্ধত্বের ফলে তাঁর কাছে বাইরের জগতের রূপ রস হারিয়ে গেলেও তাঁর মনের আলো যেন আরও প্রজ্বলিত হল। কবি ও সাধক সুরদাসের মতোই অন্তর আলোর অনির্বাণ জ্যোতিতে তাঁর মনোজগৎ হয়ে উঠল ভাস্বর। কবির তিনটি অবিনশ্বর কীর্তি ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (১৬৬৭), ‘প্যারাডাইস রিগেইনড্’ (১৬৭১) এবং ‘স্যামসনস্ অ্যাগোনিস্টিস’ (১৬৭১) এই সময়ের লেখা।

ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন ক্লাসিক গ্রন্থপাঠ, ধর্মবিশ্বাস এবং নীতি-নিয়ম ও শৃঙ্খলাবোধ একত্রিত হয়ে মিল্টনের যে মানসিকতা গড়ে উঠেছিল তাঁর লেখার প্রথম প্রভাত থেকেই আমরা সেই কবি-মানসিকতার পরিচয় পাই।

ছাত্রজীবনেই কবিতা রচনায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। এই কবিতাগুলির মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা অন দ্য মর্নিং অব ক্রাইস্টস নেটিভিটি’ (On the Morning of Chirst’s Nativity)। রচনাকাল ১৬২৯ খ্রিস্টাব্দ। এখানে উল্লেখ করা যায় যে তাঁর এম. এ. পাশের কাল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দ। খ্রিস্টের জন্মদিনের প্রভাতী স্তোত্র বিষয়ক এই উৎকৃষ্ট গীতিকবিতাটিতে কাব্যজীবনের প্রায় প্রথম লগ্ন থেকেই তাঁর ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে কবি-ক্ষমতার পরিচয়। ‘লা’ লেগ্রো’ (L’ Allegro) এবং ইন পেনসেরোসো’ ( Il Penseroso)— তাঁর প্রথম যৌবনে রচিত এই কবিতা দু’টিও বিখ্যাত। একটিতে রয়েছে সুখের গান, অপরটি বিষাদ-গাভীর্যের। প্রথমটিতে ভোরের আলো ফুলের শোভা, পাখির কুজন; অপরটিতে সন্ধ্যার ছায়া, চাঁদের উদয় ; জীবনের লঘু আনন্দের পরিবর্তে গভীর চিন্তা, মৌন প্রশান্তি। কবির জীবনের ভিন্নধর্মী দুটি বোধ আনন্দ ও বেদনা (pensive melancholy), এই দুটি ভাবনাই সারাজীবন কবির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল।

সারাজীবন ধরেই মিল্টন মাঝে মাঝে সনেট লিখেছেন। ফলে তাঁর মানসিক বিবর্তনের রূপরেখা তাঁর সনেটগুলির মধ্যে চমৎকার ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রথম বয়সে লেখা নাইটিঙ্গেল’ (পাখির) প্রতি সনেট উল্লেখ্য। এছাড়া ‘শেক্‌সপীয়রের প্রতি’, ‘সাইরিয়াক স্কিনারের জন্য’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখ্য সনেট কবিতা। এমনকি নিজের অন্ধত্বকে নিয়েও কবির সনেট আছে, নাম ‘অন হিজ ব্লাইন্ডনেস’ ঈশ্বরের প্রতি পরম নির্ভরতা কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে। ব্যক্তিচেতনা, সমাজচেতনা, ঈশ্বরচেতনা মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, They also serve who only serve and wait (On his Blindness)। এই বিবেকবোধ (Conscience), ভগবৎনির্ভরতা ও ঈশ্বরবিশ্বাস মিল্টনের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।

কবির পরবর্তী রচনা ‘কোমাস’ (Comus)। রচনাকাল ১৬৩৩। এটি নাট্যকাব্য। তরুণ কবির এই নাট্যাকাব্যটি ‘মাস্ক’ জাতীয় রচনা। রেনেসাঁসের কালে অর্থাৎ এলিজাবেথের যুগে এই জাতীয় রচনা খুবই জনপ্রিয় ছিল। এখানে ঘটনা ও চরিত্র গৌণ, মুখ্য হচ্ছে নাচ-গান-সাজ পোষাক। সেখান থেকেই নাট্যকারই যুগচাহিদা মেটাতে গিয়ে মাস্ক জাতীয় নাটক লিখতেন। কিন্তু মিল্টনের ‘কোমাস’ মাস্ক হলেও তার প্রকৃতি স্বতন্ত্র। অন্যান্যদের মাস্ক যেখানে ছিল আমোদ-প্রমোদ-সর্বস্ব, সেখানে নাচ-গান থাকলেও নৈতিক আদর্শ এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। ঈশ্বরে স্তব, সুনীতি ও শুদ্ধতার কথাই এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। কাহিনীতে রয়েছে, মায়াবিনী সার্সির পুত্র রাখালবেশী কোমাস ও তাঁর সঙ্গীরা বনের পথহারা এক নারীকে ভুলিয়ে উৎসবমুখর কুটীর-প্রাঙ্গণে নিয়ে এলেন। কিন্তু পানপাত্র মুখের কাছে তুলতেই শুদ্ধচারিণী নারী তা প্রত্যাখ্যান করলেন। দেবদূতের কাছে খবর পেয়ে পথের সঙ্গীরাও সেই সভায় এসে পড়ল, কিন্তু তারা তাঁকে মায়া শাসন থেকে তুলতে পারল না। শেষে দেবদূত নদীর দেবী স্যাব্রিনাকে আহ্বান করলেন। মুক্ত হলেন নারী। কাহিনীতে নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড় সবই আছে। কিন্তু তার সঙ্গে আছে এই কথা যে অন্তর পবিত্র থাকলে কামনা-বাসনাময় এই সংসার-অরণ্যে ত্রাণকর্তারূপে ভগবানের সাহায্য প্রসারিত হয়।

এই সময়েই তিনি একটি শোককাব্য লেখেন। নাম লিসিডাস (Lycidas)। রচনাকাল ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ। মিল্টনের এক সহপাঠী বন্ধু আইরিশ সমুদ্রে ডুবে মারা যান। এই বন্ধুর বিয়োগব্যথাই কাব্যটির উৎস। লিসিডাস হচ্ছে একজন মেষপালক। মেষপালকের রূপকে এই রাখালিয়া শোকগীতি (Pastoral Elegy)-তে কবির বেদনা ব্যক্তিগত দুঃখের ঊর্ধ্বে সর্বজনীন রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে। আর এই রূপকের অন্তরালে কবির ধর্মচেতনারও সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে।

মিল্টনের কাব্যের প্রথম পর্যায় এখানেই শেষ হল। এই কাব্য ও কবিতাগুলি কবির পরবর্তী বৃহত্তর কাব্য রচনার যেন প্রস্তুতি পর্ব। এর মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেরও দুর্বিপাক ঘনিয়ে এল। ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি আগেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কবির এই মধ্য বয়সের রচনা অধিকাংশই গদ্য। সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়কে নিয়ে লেখা গদ্য। এরই ফাঁকে ফাঁকে লিখেছেন কিছু কিছু সনেট।

জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করায় হাত দেন। জীবনের তিনটি মহৎ ও বৃহৎ কাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (১৬৬৭ খ্রিঃ), ‘প্যারাডাইস রিগেইনড়’ (১৬৭১খ্রিঃ) এবং ‘স্যামসনস্ এগোনিস্টিস’ (১৬৭১ খ্রিঃ) এই সময়েই লেখা। প্রথম দুটি মহাকাব্য এবং তৃতীয়টি গ্রিক নাটকের আদর্শে কল্পিত নাট্যকাব্য। কবির জীবনের এই শেষ পর্যায়ই তাঁর কাব্য জীবনের শেষ পর্যায়।

ইংরেজি সাহিত্যে প্যারাডাইস লস্ট’ (Paradise Lost)-এর তুলনা নেই। মহাকাব্য রচনার বাসনা তাঁর অনেকদিন আগে থেকেই ছিল। তার জন্য তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতিও চলছিল। সেই চেষ্টার ফল তাঁর এই মহাকাব্য। অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ১২টি সর্গে কাব্যটি সম্পূর্ণ। এই মহাকাব্যের কল্পনার বিশালতা, বর্ণনার কুশলতা আমাদের মুগ্ধ করে। এর বেশির ভাগ অংশ আদম ও ঈভকে নিয়ে। জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার পূর্বেকার আদম ও ঈভতে স্বর্গজীবন, শয়তান কর্তৃক প্রলুদ্ধ হয়ে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার ফলে তাঁদের স্বর্গচ্যুতি, শয়তানের ষড়যন্ত্র এবং ভগবৎশক্তির কাছে পরাজয় এই কাহিনীর বিষয়বস্তু। কাব্যের স্বর উদাত্ত, বৈদিক সামস্তোত্রের মতোই আকর্ষণীয়। দ্বাদশ স্বর্গের শেষ অংশে যেখানে দেবদূত মাইকেলের কণ্ঠে মহাপুরুষের আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী ধ্বনিত হয়েছে, মানবমুক্তির কথা, সে অংশ প্রকৃতই মহাকাব্য রচনার লক্ষণাক্রান্ত। স্বর্গ, মর্ত্য ও নরকের চরিত্র ও দৃশ্যাবলী এই কাব্যে বিস্ময়কর এক মহাজাগতিক রূপ নিয়ে বর্ণিত হয়েছে।

‘প্যারাডাইস রিগেইন্ড’ (Paradise Regained) চারটি সর্গে রচিত। এই কাব্যটি পূর্ববর্তী ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এর পরিপূরক অংশ। যিশুখ্রিস্টের আগমন এবং তার সাধনা মানবমুক্তির পথ প্রশস্ত করল। শয়তান এখানে হতবল কিন্তু কৌশলী ও একটা বিকলাঙ্গ চরিত্র হয়ে উঠেছে। ‘প্যারাডাইস লস্ট’-এ শয়তানের যে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব দেখা যায় তা এখানে নেই। কাহিনী মূলত ‘বাইবেল’ অবলম্বনে লেখা। যিশুখ্রিস্টের জীবনের মধ্য দিয়েই স্বর্গ জয় ও প্রাপ্তির দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছে। কাব্যসৌন্দর্য এখানে আছে, তবে সমগ্রভাবে কাব্যটি ‘প্যারাডাইস লস্ট এর সমকক্ষ নয়।

‘স্যামসন আগোনিস্টিস্’ (Samson Agonistes) কবির ‘প্যারাডাইস রিগেইনড্’-এর সঙ্গেই প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থটি কবির শেষ রচনা। নাটকটিতে কবির নিজের ছায়া পড়েছে। ইস্রায়েলের বীর নেতা স্যামসন অন্ধ ও অসহায় হয়ে ফিলিস্টাইনদের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই ফিলিস্টাইন প্রভুদের আনন্দ দানের জন্য অন্ধ স্যামসনকে প্রমোদ স্থলে নিয়ে আসা হয়। স্যামসন সেই প্রমোদ-প্রাসাদের স্তম্ভ বিচ্যুত করেন। ফলে প্রাসাদের ছাদ ভেঙে পড়ে এবং উপস্থিত দর্শক-প্রভুদের মৃত্যু ঘটে। গ্রিক ট্র্যাজেডির ধরনে লিখিত এই নাট্যকাব্যে অন্ধ স্যামসনের চরিত্র নির্মাণে কবির আপন জীবনের প্রক্ষেপণ ঘটেছে। স্যামসনের মতোই মিল্টন জীবনযুদ্ধে পরাজিত, আশাভঙ্গে নিরুৎসাহ, রোমান্টিক কবির মতোই বিষাদগ্রস্ত অথচ ক্লাসিক কবির মতোই আদর্শে অবিচল।

মিল্টনের কাব্য-কবিতাসমূহের আলোচনায় দেখা যায় তা কল্পনার বিশালতায়, অপূর্ব শব্দসম্পদ ও ধ্বনিঝঙ্কার আজ পর্যন্তও পাঠককে মুগ্ধ করে। কিন্তু এখানেই তাঁর কাব্য শেষ হয়ে যায় নি। এই সৌন্দর্যপ্রিয়তার (Hellenic) সঙ্গে কবির প্রতিটি কাব্যেই রয়েছে নীতিবাদিতা (Hebraic)। মিল্টনও যেন বলতে চেয়েছেন শুধু সৌন্দর্য দিয়ে কি হবে, যদি তা সমাজের কাজে না লাগে, যদি তা মঞ্চালের পথে পূর্ণতার পথে মানুষকে এগিয়ে না নিয়ে যায়। এইখানেই মিল্টনের কাব্যসাধনার বৈশিষ্ট্য।