বিরুদ্ধবাদীরা মিলের ঊনিশ শতকী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে।
(১) সমালোচকদের মতানুসারে সমাজবদ্ধ প্রত্যেক ব্যক্তির কাজকর্ম সমাজের অন্য সদস্যদের কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে ব্যক্তির আত্মকেন্দ্রিক ও পরকেন্দ্রিক কাজকর্মের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা যায় না। অর্থাৎ ব্যক্তির কার্যাবলীর এই বিভাজন যথার্থ নয়।
(২) মিল সবরকম বাধা-নিষেধের অপসারণকেই স্বাধীনতা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। এ হল অবাধ স্বাধীনতা বা স্বৈরাচার। এ রকম স্বাধীনতা থেকে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। বার্কার (Emest Barker) স্বাধীনতা সম্পর্কিত এই ধারণার সমালোচনা করেছেন। বার্কারের মতানুসারে ‘মিল ছিলেন, শূন্যগর্ভ স্বাধীনতার প্রবক্তা। অধিকার সম্পর্কে তাঁর আদৌ কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না, যার থেকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়।’ বার্কার বলেছেন: “Mill was the prophet of an empty liberty…. He had no clear philosophy of rights through which alone the conception of liberty attains a concrete meaning.’
(৩) মিল ব্যক্তিকে এক বিমূর্ত সত্তা হিসাবে দেখেছেন। তিনি ব্যক্তিকে একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। ব্যক্তির যৌথ সত্তাকে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। কিন্তু সমাজবদ্ধ মানুষের পক্ষে বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতা ভোগ করা সম্ভব নয়।
(৪) জোড-এর মতানুসারে ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সমকালীন প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে পারেনি। তাই মতবাদটি তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ব্যক্তিকে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এই নীতির প্রয়োগের ফলে অনেক দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থা পঙ্গুদশা প্রাপ্ত হয়।
হার্বার্ট স্পেনসার: হার্বার্ট স্পেনসার (Herbert Spencer) আর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত। অনেকের মতে স্পেনসার ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এক চরমপন্থী প্রবক্তা। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীতে মূলত মিল ও স্পেনসারের হাতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একটি রাজনীতিক মতাদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্পেনসারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত The Man Versus the State, 1884 শীর্ষক গ্রন্থে।
রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপের বিরোধিতা: স্পেনসার স্বাভাবিক অধিকার এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিধি-ব্যবস্থার কথা বলেছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সরকারী কার্যকলাপের পরিধি সীমিত করা যুক্তিসঙ্গত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাঁর মতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সামাজিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তিনি রাষ্ট্রের কার্যাবলীকে শান্তি-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ, সামরিক পরিষেবা বিতরণ, অপরাধ দমন, বিশ্বাসভঙ্গ ও চুক্তিলঙ্ঘন প্রতিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী। স্পেনসারের অভিমত অনুসারে সীমিত ক্ষেত্রের মধ্যে সরকারী কার্যকলাপ যুক্তিসঙ্গত ও প্রয়োজনীয়। তিনি বলেছেন: “Within its proper limit governmental action is not simply legitimate, but all important.” মিলের মত স্পেনসার ব্যক্তির স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে ব্যক্তির স্বাধীনতা সংরক্ষণ রাষ্ট্রের একমাত্র কর্তব্য। তিনি বলেছেন: “The individual has but one right, the right of equal freedom with everybody else, and the State has but one duty the duty of protecting that right.” স্পেনসার যে-কোন রকম সরকারী নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছেন এবং অবাধ স্বাধীনতাযুক্ত ব্যক্তির কথা বলেছেন। তবে ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপ অপরের আচরণে যদি আঘাত করে, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে।
সমাজ জীবনে যোগ্যতমের অস্তিত্ব: স্পেনসার ডারউইনের বিবর্তনবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। বিবর্তনবাদের ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ (survival of the fittest) নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতানুসারে সমাজে কেবল যোগ্য ব্যক্তিরাই বেঁচে থাকতে পারে। মানব-সমাজে ‘যোগ্যতমের অস্তিত্বের’ নীতিকে প্রয়োগ করে তিনি আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। তিনি সবকরম সরকারী ত্রাণ বণ্টন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। তিনি শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, শিল্প-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিপক্ষে ছিলেন।
স্পেনসারের মতামতের সমালোচনা: হার্বার্ট স্পেনসারের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বক্তব্যও বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকরা এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করে থাকেন। (১) স্পেনসার যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ নীতির অবতারণা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সমাজে কেবল যোগ্যতমেরই বাঁচার অধিকার আছে। স্পেনসারের এই বক্তব্য অমানবিক। (২) স্পেনসার পরিষেবামূলক কাজকর্মের বিরোধিতা করেছেন। তিনি সরকারের কল্যাণমূলক কাজকর্মকে বাতিল করে দেওয়ার কথা বলেছেন। অক্ষম-অসমর্থ ব্যক্তিদের পক্ষে বা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের সাহায্যে সরকারের ভূমিকাকে তিনি সমর্থন করেননি। স্পেনসারের এই অভিমতও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। (৩) ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অনুকূলে স্পেনসারের যাবতীয় বক্তব্য রাষ্ট্রকে এক দুর্বল ও অকর্মণ্য প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু কোন কোন চিন্তাবিদ মনে করেন যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কর্মমুখর রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছে।
সিজউইক: সিজউইক (Sidgewick)-ও একজন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত। Elements of Politics শীর্ষক গ্রন্থে তিনি তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। সিজউইকও ব্যক্তিজীবনের কল্যাণ সাধনের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তির কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে সাধারণের কল্যাণ সাধিত হবে।
অ্যাডাম স্মিথ: রিকার্ডো (Ricardo), অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের সমর্থক হিসাবে পরিচিত। অ্যাডাম স্মিথ হলেন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী অর্থনীতিবিদ। তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী আর্থনীতিক ধ্যান-ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর Wealth of Nations শীর্ষক গ্রন্থে। বস্তুত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে অ্যাডাম স্মিথের অবদান অনস্বীকার্য। স্মিথও ব্যক্তিস্বার্থের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে সামাজিক কল্যাণ সাধনের স্বার্থে সর্বোচ্চ ব্যক্তিস্বার্থের অনুসরণ হওয়া আবশ্যক। তাঁর অভিমত হল প্রত্যেককে যে যার নিজের বিচার-বিবেচনা অনুসারে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাহলে সকলের কল্যাণ সাধিত হবে। এবং এইভাবে সকলের মঙ্গলের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণের ব্যাপারে নিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। স্মিথ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ বাণিজ্যের নীতিকে সমর্থন করেছেন। তিনি শিল্পোৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাবতীয় আর্থনীতিক কার্যকলাপকে ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। স্মিথের মতানুসারে বেসরকারী শিল্প-বাণিজ্যের ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। তার ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাবে। এতে দ্রুতহারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এবং এই সমস্ত কিছুর সামগ্রিক ফল হিসাবে সমাজের আর্থনীতিক সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হবে।
Leave a comment