মধ্যযুগে পৃথিবীর বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে দুটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য ছিল ভারতের মােগল সাম্রাজ্য এবং ইউরােপের অটোমান সাম্রাজ্য। নীচে মােগল ও অটোমান শাসনকালের শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতচর্চার একটি তুলনামূলক অলােচনা করা হল一

মােগল সাম্রাজ্য

  • মােগল যুগে চিত্রশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল। সম্রাটগণ চিত্রশিল্পীদের পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। এযুগের কয়েকজন উল্লেখযােগ্য চিত্রকর ছিলেন মির সৈয়দ আলি, খাজা আব্দুস সামাদ, তারাচাদ, জগন্নাথ, বসাবন, কেসু, যশােবন্ত, ফারুক বেগ, বিষেণ দাস, কেশব, গােবর্ধন, নাদির সমরকান্দি প্রমুখ।

  • মােগল সম্রাটদের শাসনকালে স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ করা যায়। এযুগের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থাপত্যকীর্তি হল ‘কাবুলবাগ মসজিদ’, ‘দিনপনাহ মসজিদ’, ‘পুরানা কিলা’, ‘ইবাদৎখানা, দেওয়ান ই-আম”, ‘দেওয়ান ই-খাস’, ‘জামি মসজিদ, মতি মসজিদ”, বুলন্দ-দরওয়াজা’, ‘লালকেল্লা’, তাজমহল প্রভৃতি। স্থাপত্যের পাশাপাশি এযুগে বিভিন্ন ভাস্কর্যেরও উন্নতি হয়েছিল। শাহজাহানের আমলে নির্মিত ময়ূর সিংহাসন মােগল সাম্রাজ্যের উন্নত শিল্পচেতনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

  • মােগল সম্রাটগণ সংগীতের অনুরাগী ছিলেন। বাবর তুর্কি ভাষায় কয়েকটি গান এবং সঙ্গীতধারা’ নামে সংগীত বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। আকবরের দরবারে দেশ-বিদেশের ৩৬ জন খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী উপস্থিত থাকতেন যাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন তানসেন। এ যুগের অন্যান্য উল্লেখযােগ্য সংগীতশিল্পী ছিলেন রামদাস, সুরদাস, হরিদাস, বাজবাহাদুর, বৈজু বাওরা প্রমুখ।

  • মােগল আমলে ফারসি ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এ ছাড়া হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, আরবি- সহ অন্যান্য ভাষাও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। এযুগের সাহিত্যও মূলত এইসব ভাষাতেই রচিত হয়েছিল।

    • ইতিহাস-সাহিত্য: মােগল আমলে বেশ কিছু ইতিহাস-সাহিত্য রচিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল বাবরের ‘তুজুক-ইবাবরি’, গুলবদন বেগমের হুমায়ুননামা’, আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ ও ‘আকবরনামা’, বদাউনির “মুন্তাখাব-উল-তারিখ”, প্রভৃতি।

    • অনুবাদ সাহিত্য: এযুগে কবি ফৈজি ‘রাজমনামা নামে মহাভারতের এবং বদাউনি রামায়ণের ফারসি অনুবাদ করেন। ‘লীলাবতী নামে একটি গণিতশাস্ত্র ফারসি ভাষায় রচনা করেন ফৈজি সরহিন্দ।

    • আঞ্চলিক সাহিত্য: এযুগে হিন্দি ভাষায় তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’, জয়সির ‘পদ্মাবৎ’ কাব্য, মীরার ভজন, বাংলা ভাষায় কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত”, বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ও বিদ্যাসুন্দর কাব্য, কাশীরাম দাসের “মহাভারত প্রভৃতি রচিত হয়।

অটোমান সাম্রাজ্য

  • অটোমান সুলতানদের শাসনকালে চিত্রশিল্পেও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। পঞ্চদশ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যে নাক্কাসানি-ইবুম নামে গ্রিক চিত্রকরদের একটি অ্যাকাডেমি এবং পরে পারসিক চিত্রকরদের একটি অ্যাকাডেমি গড়ে ওঠে। এযুগের কয়েকজন উল্লেখযােগ্য চিত্রকর ছিলেন নাক্কাস ওসমান, মাট্রকসি নাসুহ, মােল্লা কাশিম, হাসান পাশা, আলি সেলেবি প্রমুখ।

  • অটোমান শাসনকালে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। এযুগের স্থাপত্যের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল ষােড়শ শতকে। সুলেমানের আমলের শ্রেষ্ঠ স্থপতি মিরার সিনান সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে অন্তত তিন শতাধিক অট্টালিকা নির্মাণ করেন। তার তত্ত্বাবধানে নির্মিত ইস্তানবুলের সুলেমানীয় মসজিদ এবং অ্যাড্রিযানোপলের সেলিমিয়া মসজিদ খুবই উল্লেখযােগ্য স্থাপত্য নিদর্শন। নীল মসজিদ এযুগের অপর উল্লেখযােগ্য স্থাপত্যকর্ম। কনস্ট্যান্টিনােপল, মক্কা, দামাস্কাস, বাগদাদ প্রভৃতি স্থানে এযুপে বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শনগুলি ছড়িয়ে আছে।

  • অটোমান রাজদরবারে বিশেষ ধরনের সংগীতের ধারার বিকাশ ঘটেছিল। অটোমান সামরিক বাহিনীতেও ব্যান্ড-সহ সংগীতের প্রচলন ছিল। সংগীতের সঙ্গে নৃত্যানুষ্ঠানও হত। এ যুগে নাট্যশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল এবং নাটকে সংগীতের ব্যবহার হত।

  • অটোমান শাসনকালে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা থেকে তুর্কি ভাষার উৎপত্তি ঘটে। এযুগে আরবি লিপিতে এবং অলংকারবহুল অক্ষরের মাধ্যমে তুর্কি ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়। এই ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে বইপত্র লেখা শুরু হয়।

    • কাব্যচর্চা: অটোমান তুর্কি শাসকরা কবিদের পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। সুলতানদের রাজদরবারে ব্যাপক কাব্যচর্চা হত। পারসিক কাব্যধারা তুর্কি কাব্যচর্চাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তেভফিক ফিকরেট ছিলেন আধুনিক তুর্কি সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা।

    • গদ্যসাহিত্য: তুর্কি সাহিত্যে সর্বাধিক অগ্রগতি লক্ষকরা গিয়েছিল গদ্যসাহিত্যে। তুর্কি গদ্যসাহিত্যে প্রথমদিকে আরবি সাহিত্যের এবং পরের দিকে ইউরোপীয় সাহিত্যের, বিশেষ করে ফরাসি সাহিত্যের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। তুর্কি ভাষায় রচিত সেমসেটিন সামির ‘তাসুক-উ-তালাত ভি ফিৎনাৎ’ প্রথম বিখ্যাত তুর্কি উপন্যাস হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। আহমেট মিথাট, হালিত জিয়া উসাক্লিগিল প্রমুখ এযুগের উল্লেখযোগ্য তুর্কি সাহিত্যিক ছিলেন।