গৌড়েশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ কাব্যটি রচনা করেছিলেন।

“গুন নাই, অধম মুই, নাহি কোনজ্ঞান।

গৌড়েশ্বর দিল নাম গুণরাজখান।।”

কিন্তু এই গৌড়েশ্বয়ের প্রসঙ্গে মালাধর বসু নীরব থাকলেও পণ্ডিতরা গ্রন্থ রচনাকাল ধরে অনুমান করেন রুকুনুদ্দিন বরবক শাহই গৌড়েশ্বর। তিনি কবিকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘গুণরাজ খান’।

মালাধর বসুর আবির্ভাব কাল :

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য কবিদের মত মালাধর বসুর আবির্ভাব কালও কুয়াশায় আবৃত। তাঁর রচিত ‘শ্ৰীকৃবিজয়’ বাংলা সাহিত্যের সাল তারিখযুক্ত প্রাচীনতম গ্রন্থ। তাতে কবির আবির্ভাব কাল সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে গ্রন্থে পরিবেশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, তিনি সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব কালেও জীবিত ছিলেন।

মালাধর বসুর জন্মস্থান ও বংশ পরিচয় :

তিনি বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রামে কায়স্থ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ধর্ম সাধনের ক্ষেত্রে এই গ্রামের প্রসিদ্ধির কথা সর্বজনবিদিত। এই গ্রাম বৈষ্ণুব সাধনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তাঁর পিতা ভাগীরথ, মাতা ইন্দুমতী। তাঁর এক পুত্র সত্যরাজখান ছিলেন শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ।

মালাধর বসুর রচনাকাল :

“তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন। 

চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন।।”

অর্থাৎ মালাধর বসু ১৪৭৩ খ্রীঃ তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ গ্রন্থের রচনা শুরু করেন এবং ১৪৮০ খ্ৰীঃ সমাপ্ত করেন।

মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় (নামকরণ) :

মালাধর বসু বাংলায় ভাগবত অনুবাদের প্রথম পথিক। সংস্কৃতের জটা বন্ধন থেকে তিনিই প্রথম ভাগবতী কাহিনিকে বাংলায় মুক্তি দেন। তাঁর অনূদিত ভাগবতী কাহিনি ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামে পরিচিত। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’, ‘গোবিন্দবিজয়’, এবং ‘গোবিন্দমঙ্গল’ নামেও তাঁর কাব্য খ্যাত। কোথাও কোথাও তা ‘শ্রীকৃষ্ণবিক্রম’ নামেও চিহ্নিত। শ্রীকৃষ্ণবিজয় মূল ভাগবত পুরাণের ধারানুসারী। নামকরণের ‘বিজয়’ কথাটি অর্থ মৃত্যুকে দ্যোতিত করে। কিন্তু এখানে কৃষ্ণের মৃত্যুর কথা নেই আছে তাঁর অসুরঘাতী শত্রু দশনের ও ঐশ্বর্যের রূপায়ণ। তবে ‘মঙ্গল’ কথাটির উপস্থিতিতে বোঝা যায় কৃষ্ণ জীবন-কথা নিয়ে হয়ত তিনি কোন পাঁচালী রচনা করতে চেয়েছেন।

শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের কাহিনি :

এই কাব্যে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, মথুরা লীলা ও দ্বারকালীলা বর্ণিত হয়েছে। বৃন্দাবন লীলায় রয়েছে ভূভার হরণের জন্য বিষ্ণুর বৃন্দাবনে কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ থেকে মথুরা যাত্রা, মথুরালীলায় রয়েছে কংসের নিধন। দ্বারকায় দ্বারকাপুরী নির্মাণ থেকে কৃষ্ণের তনুত্যাগ পর্যন্ত কাহিনির ধারাবাহিক বর্ণনা। মালাধর বসু কৃষ্ণের গোপীপ্রসঙ্গ ও রাসলীলা বিষয়গুলিকে সংক্ষিপ্ত করে কৃষ্ণের বলবীর্যের কাহিনি বিবৃত করেছেন।

মালাধর বসুর কবিত্ব :

মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যে কবিত্ব ও শিল্প চাতুর্যের থেকে অনুবাদকের পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছিল। কবিত্বময় বর্ণনা কিংবা শিল্পচাতুর্যময় প্রকাশ অত্যন্ত দুলর্ভ, সহজ, সরল, নিরলঙ্কিত ভাষায় কৃষ্ণের ঐশী শক্তির বর্ণনা ছিল তাঁর মুখ্য পরিকল্পনায়।

শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের ভক্তিরস :

ভক্তিরস তেমনভাবে এখানে পরিস্ফুট হয়নি। মূলত কৃষ্ণের ঈশ্বর সত্তার শক্তি প্রাচুর্যের বিজয় গাথা রচনা করেছেন। এর মধ্যে দিয়ে তাঁর সমকালীন যুগ বাসনার চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের ভাষা :

শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের ভাষা সহজ, সরল নিরলংকৃত। আসলে যুগধর্মের চাহিদা পুরণের জন্য মালাধর কৃষ্ণের সহজ সরল জীবনকাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ফলে তাঁর কাব্য অচিরেই কৃষ্ণলীলা প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

সর্বোপরি বলতে হয়, মালাধর বসু বিরচিত ও শ্রীচৈতন্য প্রশংসিত ‘শ্ৰীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যে বাংলাদেশের জন জীবনে কৃষ্ণ কাহিনি প্রচারের প্রথম ও প্রধান কাব্যগ্রন্থ। মালাধরের কৃষ্ণ নিষ্ঠা এবং তাঁর কাব্যের রস পরিণাম বাঙালির অন্তর্লোকে যে কৃষ্ণভক্তির ঐশ্বর্য সঞ্চারিত করেছিল পরেরকালে সেই ঐশ্বর্য দিয়ে—’বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া’ নিমাই কায়া পরিগ্রহ করেন।