উত্তর রামচরিত : ভবভূতির শ্রেষ্ঠ নাট্যকীর্তি হল উত্তর রামচরিত। আসন্ন প্রসবা সীতার কাহিনি দিয়ে নাটকটির সূচনা। এমন সময় রামচন্দ্র সংবাদ পেলেন প্রজারা সীতার শুচিতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন। কারণ কিছুদিন তিনি রাবণের গৃহে বসবাস করেছেন। তাই প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য সীতাদেবীকে বনবাসে পাঠানো হল। এরপর বহু বাধাবিঘ্ন সামলে বাল্মীকির মধ্যস্থতার লব-কুশ অর্থাৎ রামচন্দ্রের দুই পুত্র ও সীতার মিলন ঘটল রামচন্দ্রের সাথে। উত্তর রামচরিত’ ভবভূতির শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্ম। সমালোচকেরা এ নাটকটিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন। যদিও এ নাটকের কাহিনি মৌলিক নয়, তবুও কাহিনির সর্বত্র মৌলিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে এমন কিছু কাহিনির উত্থাপন করেছেন যা অস্তিত্ব বাল্মীকি রামাজন নেই। যেমন আলেখ্য দর্শন, তমস্যা ও মূলত কথোপকথন ছাড়া সীতা প্রসঙ্গ, ভরতমুনি কর্তৃক নাট্যাভিনয়ের আয়োজন ও রামসীতার মিলন-এ সবই ভবভূতির মৌলিক সৃষ্টি। চরিত্র বিশ্লেষণেও ভবভূতির বিচক্ষণতা চোখে পড়ার মতো, এখানে রামচন্দ্রের দ্বন্দ্ব অপূর্ব কুশলতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও সীতার পরিকল্পনায় ও অভিনবত্ব আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
হর্ষচরিত : বাণভট্টের রচিত হর্ষচরিত এক ঐতিহাসিক কাব্য। এটি অটটি উচ্ছ্বাসে বিভক্ত। এই কাব্যে বাণভট্ট হর্ষবর্ধনের জীবনের এক বিস্তৃত অধ্যায়কে স্থান দিয়েছেন। রচনাটির তৃতীয় উচ্ছ্বাস থেকে শ্রীহর্ষের পরিবারের কথা বিবৃত করা হয়েছে। যদিও এই বাক্যটি অসম্পূর্ণ কারণ কোনো সম্পত্তিসূচক বাক্য তিনি এ কাব্যের শেষে ব্যবহার করেননি। তবুও একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে হর্ষচরিত অসম্পূর্ণ কাব্য হলেও এতে লেখকের প্রতিভার ছাপ মুদ্রিত হয়ে আছে। ঐতিহাসিক কাব্য হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাসের শুধু কাঠামোয় সাহিত্যিক রস সঞ্চারিত করে বাণভট্ট তার কাব্যটিকে করেছেন অসামান্য।
কাদম্বরী : বাণভট্টের রচনা কাদম্বরী। সংস্কৃত সাহিত্যে গ্রন্থটিকে ‘কথা’ রূপে অভিহিত করা হয়েছে। এর কাহিনি অংশ কিন্তু মৌলিক নয়, কথাসরিৎসাগরে উল্লিখিত রাজা সুমন সেনের কাহিনি অবলম্বনে এই গ্রন্থের আখ্যান ভাগ পরিকল্পিত। আধুনিক রোমান্সধর্মী রচনার সাথে গ্রন্থটির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও হর্ষচরিতের মতো বাণভট্টের এই রচনাটিও অসম্পূর্ণ। এই অসম্পূর্ণ রচনাটিকে সম্পূর্ণ করেন তারই পুত্র ভূষণ ভট্ট মতান্তরে পুলিঙ্গ। যখন এ গ্রন্থটি রচিত হয় অমন উপন্যাস নামক শিল্পরূপ জন্ম নেয়নি। কিন্তু কাদম্বরীর তথ্য আখ্যানে যেন তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। চরিত্র চিত্রণেও বাণভট্ট কৃতিত্ব প্রশ্নাতীত। সবরকম ধর্মীয় প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তিনি কাব্যটি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে মানবিক প্রণয়ের মহাত্ম্য, প্রচার করেছেন। চন্দ্রানীয় বৈশম্পায়ণ, মহাশ্বেতা, কাদম্বরী ইত্যাদি চরিত্রগুলি বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কাদম্বরীর অপর বৈশিষ্ট্য নিহিত আছে প্রকৃতি বর্ণনার মধ্যে। বাণভট্টের প্রকৃতি বর্ণনার সবচেয়ে বড়ো গুণ সানুপুঙ্খতা। তবে প্রকৃতি বর্ণনায় তুচ্ছ-মহৎ সবকিছুই স্থান পেয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় মানবিক প্রণয় আখ্যান হিসাবে সংস্কৃত সাহিত্যে গ্রন্থটির মূল্য অপরসীম।
গীতগোবিন্দম : সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, জয়দেব রচিত ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যটির সংস্কৃত সাহিত্যে তো বটেই, বাঙালি মানুষ একটি আলাদা স্থান দখল করে আছে। বারোটি সর্গে বিন্যস্ত ‘গীতগোবিন্দম’ ভাগবতের অংশ বিশেষের বিষয়বস্তুর অবলম্বনে রচিত এমন মত পোষণ করে বহু সমলোচক। তবে এমত পুরোপুরি না মেনে নিয়ে বলা যায় প্রাচীন প্রকৃতি কবিতা ও সংস্কৃত উদ্ভট শ্লোকে রাধাকৃষ্ণের উত্তপ্ত প্রণয়লীলার যে বর্ণনা আছে তার সাথে লৌকিক কাহিনির মিশ্রণ ঘটিয়ে খানিকটা লৌকিক কাহিনির আদর্শেই গীতগোবিন্দম্ রচিত হয়। রাধাকে নায়িকা করে জয়দেবই এমন একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্য রচনা করেন। সেদিক থেকে ‘গীতগোবিন্দম্’-এর আলাদা মূল্য আছে। দ্বাদশ সর্গে বিন্যস্ত এই কাব্যটির প্রতিটি সর্গের স্বতন্ত্র নামকরণ করা হয়েছে। এগুলি হল সাখোদ দামোদর, অক্লেশ-কেশর, মুগ্ধ-মধুসূদন, স্নিগ্ধ-মধুসূদন, সাকাঙ্ক্ষ-পুণ্ডরীকাক্ষ, ধৃষ্ট-বৈকুণ্ঠ, নাগর-নারায়ণ, বিলক্ষ-লঙ্কাপতি, মুগ্ধ-মুকুন্দ, সুন্দ-মাধব, সানন্দ গোবিন্দ ও সুপ্রীত পীতাম্বর। এই কাব্যটির প্রতিটি সর্গে কবি মূল কাহিনি বিন্যস্ত করেছেন। এছাড়াও গ্রন্থারম্ভে আছে প্রশস্তি বর্ণনা ও দশাবতার স্তোত্র। রাধাকৃষ্ণের বিরহ, রাধার যন্ত্রণা ও অন্তিমে উভয়ের মিলন এই-ই হল মূল বিষয়। সংস্কৃত সাহিত্যে মেঘদূতের পরেই বহুগঠিত কাব্য হিসাবে স্থান করে নিতে পারবে গীতগোবিন্দম। কৃষ্ণ ও রাধার চরিত্রাঙ্কনে কাজে কৃতিত্বের পরিচয় মেলে। ও এক অসামান্য সাম্প্রীতিক উৎকর্ষে গীতিগোবিন্দম্-এর বিষয়বস্তু সামান্য হয়েও হয়ে উঠেছে অসামান্য।
বিষয়বস্তু—রাধাকৃষ্ণের বসন্তকালীন রাসলীলা। এই কাব্য নায়ক-নায়িকা ও সখীর উক্তি প্রত্যুক্তি ছিল নাট্যগীতের ধরনে রচিত—সংগীত প্রধান একটি রচনা।
শ্রীকৃষ্ণ রাধা ভিন্ন অন্যান্য গোপীদের সঙ্গে রাসলীলায় মত্ত আছেন তা দেখে ঈর্ষাভরে, শ্রীরাধা মানিনী হলেন। শ্রীকৃষ্ণ সখীদের ত্যাগ করে অনুতপ্ত চিত্তে রাধার প্রসন্নতাবিধানে সচেষ্ট হলেন। অনেক অনুনয় বিনয় এমনকি তার পায়ে ধরে সাধার চেষ্টা করলে সখীদের অনুরোধে রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বিরূপতা ত্যাগ করেন রাধাকৃষ্ণের পুনর্মিলন ঘটে। গীতগোবিন্দের এই হল সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
মূল কাব্যের আরম্ভের পূর্বে অপূর্ব বসন্ত বর্ণনা— তারপর সামোদ দামোদরের অতিসুন্দর বেশবাসের বর্ণনা ‘চন্দনচর্চিত নীল কলেবর পীত বসন বনমালী’। কৃষ্ণ আমোদ মত্ত। সখীরা এসে রাধাকে সে সংবাদ দিলেন— সরস বসন্তে হরি অন্য যুবতীদের হৃদয়ে ধারণ করে নাচ গানে রত। এ সংবাদে ঈর্ষাকাতর রাধা দুঃখিত হয়ে এক লতাকুঞ্জে বসে বিলাপ করতে লাগলেন। কৃষ্ণ ওদিকে রাধাকে হৃদয়ে ভেবে অন্য ব্রজ সুন্দরীদের ত্যাগ করে অনুতপ্ত হৃদয়ে রাধার জন্য বিলাপ করতে লাগলেন। এরপর সখীরা এসে রাধার বিরহাবস্থার বর্ণনা দিলে কৃষ্ণ রাধাকে কুঞ্জে নিয়ে আসতে বললেন। কিন্তু রাধা শক্তিহীনা হয়ে পড়েছেন তাই সখী আবার ফিরে গেল কৃষ্ণের কাছে বাসকসজ্জিকা নায়িকার অবস্থা বর্ণনা করতে। সেই সঙ্গে রাধার বর্তমান অবস্থার জন্য ‘ধৃষ্ট মধুসূদন’কে দায়ী করে তাকে ভর্ৎসনাও করা হয়। ৭ম সর্গে ‘নাগর নারায়ণে’ বিপ্রলবদ্ধা নায়িকার বিলাপ বর্ণনা করা হয়েছে। অষ্টম সর্গে রতিবঞ্চিতা নায়িকা রাধার বিলাপ। শ্রীরাধা কোনো প্রকারে কষ্টে রাত্রি অতিবাহিত করলেন—পরদিন তাঁর প্রভাতকে মনিলতর করতে মথিত দেহে নায়ক শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁর সামনে এসে প্রণত হয়ে অনুনয় করতে লাগলেন তখন মদনশরকাতরা রাখা প্রবল অসূয়া বশে প্রিয়তমকে বললেন—’যার প্রতি অনুরাগ বশে তোমার নয়নে গত রজনির গুরু জাগরণ-জনিত আলস্য জড়িত, হে মাধব, হে কেশব তুমি, তার কাছেই যাও। আমাকে কপট বাক্যে ভুলবার চেষ্টা কোরো না। নবম সর্গ ‘মুগ্ধ মুকুন্দঃ’। দশম ‘মুগ্ধ মাধবঃ’। মান ভঞ্জনের এই অপূর্ব সর্গটি সংস্কৃত সাহিত্যে শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। শ্রীকৃষ্ণ তথা জয়দেবের বচন পটুত্বের চুড়ান্ত নিদর্শন এই সর্গটি ‘বদসি যদি কিঞিদপি দন্তরুচি কৌমুদি’ ইত্যাদি। শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব বাণী বন্যায় রাধার হৃদয় টলল, তিনি মনে মনে গললেন এবং সখীদের অনুরোধে কুঞ্জগৃহে কৃষ্ণ মিলনের জন্য যাত্রা করলেন। একাদশ সর্গ ‘সানন্দ গোবিন্দ’ এবং শেষ সর্গটি ‘সুপ্রীত পীতাম্বর’। রাধার সঙ্গে মিলনে পীতাম্বর প্রীত হলেন। কাব্য শেষ হল নিজ কাব্যের স্বরূপ ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশ করে।
বস্তুত জয়দেবের কাব্য অতি মধুর, ভাষা সুললিত, পরিমার্জিত ও শ্রুতি সুখকর। প্রেম কবিতার, বিবর্তনের ইতিহাসে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ একটি সীমাচিহ্ন। বৈশ্বব সাহিত্যে এর প্রভাব অপরিসীম।
শকুন্তলা চরিত্র : ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ মহাকবি কালিদাসের অমর সৃষ্টি। আর অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকটির প্রাণ শকুন্তলা চরিত্র, এ নাটকটি কালিদাসের সর্বশেষ এবং সর্বদিক থেকে পরিণত রচনা। তাই নায়িকা শকুন্তলার চরিত্র চিত্রণে নাট্যকারের প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। শকুন্তলা চরিত্রটি মহাভারত থেকে আহরিত, কিন্তু নাটকে চরিত্র চিত্রণে কালিদাস বিশেষ অভিনবত্ব প্রদর্শন করেছেন।
মহাভারতের শকুন্তলা নিজেই নিজের আত্মপরিচয় দিয়েছে এবং নিজপুত্রের রাজা হওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বিবাহে সম্মতি দান করেছে। রাজ সভায় প্রত্যাখ্যাতা হয়ে সে রাজার সঙ্গে বিস্তর কথা কাটাকাটি করেছে। কালিদাসের শকুন্তলা কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির, সে নিজ মুখে নিজের জন্মবৃত্তান্ত বলেননি, সখীরাই রাজাকে তার পরিচয় দিয়ে চলেছে—’এর পিতা হলেন মহাজেতা তপস্বী বিশ্বামিত্র এবং মা স্বর্গের অপ্সরা মেনকা। জন্মমাত্রেই ইনি পরিত্যক্তা হলে শকুন্ত অর্থাৎ শকুন পাখির পক্ষ ছায়ায় লালিত হচ্ছিলেন দেখে মহর্ষি কণ্ব এর নাম দেন শকুন্তলা এবং পিতৃস্নেহে তাকে আপন তপোবনের আশ্রমে প্রতিপালিত করেন।
ঋষিকন্যা এইভাবে তপোবনে প্রতিপালিতা হয়ে অনুপম চরিত্র ধারিণী হয়ে ওঠে। শকুন্তলা চরিত্রে তার আরণ্যক সরলতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। রাজা দুষ্মন্ত কর্তৃক এই সরলা বালিকা সহজেই প্রেমবাণাহত হয়েছে। তারপর তার দ্বারা রাজসভায় প্রত্যাখ্যাতা হলে সে রাজাকে শাপশাপান্ত না করে দু-একটি কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েছে ও আপন অদৃষ্টকে দায়ী করে সে সীতার মতোই বসুমতীর কোলে বিশ্রাম প্রার্থনা করেছে। পতিগৃহে যাত্রাকালে তার কোমল স্বভাব ও প্রকৃতির অঙ্গীভূত হয়ে থাকার যে চিত্র কালিদাস এঁকেছেন তা অনবদ্য।
নাটকের সূচনায় এবং অন্ত্যে শকুন্তলাকে দেখা যায় তপোবনে। তপোবন কন্যাকে একবার মাত্র রাজদ্বারে কবি উপস্থিত করেছেন, তাকে দুস্মন্ত চিনতে পারেননি অভিজ্ঞানের অভাবে। এ থেকে মনে হয় পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই শকুন্তলাকে চেনা যায়নি। কিন্তু সেখানেও কালিদাসের শান্ত প্রকৃতির শকুন্তলা তার বাক সংযম, ধীর নম্র স্বভাবেরই পরিচয়। দিয়েছে।
শকুন্তলার মধ্যে প্রেয়সীর প্রণয় লীলায় মদনের যেটুকু মাদকতা ছিল দুঃখতাপে দগ্ধ করে কবি শেষ অঙ্কে তার মধ্যে জননীর কল্যাণী মূর্তিকে বিকশিত করেছেন—মাতৃত্বের এই বাৎসল্যময়ী শ্রী চরিত্রটিকে অপূর্ব সুন্দর করে তুলেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর—’শকুন্তলা প্রবন্ধে এজন্য বলেছেন : “কেহ যদি তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বৎসরের ফল, কেহ যদি মর্ত্য ও স্বর্গ একত্র দেখিতে চায়, তবে শকুন্তলায় তাহা পাইবে।”
উত্তর রামচরিত : ‘উত্তর রামচরিত’ শ্রীকান্ত ভবভূতির শ্রেষ্ঠ নাটক। এটি ভবভূতি রচিত ‘মহাবীর চরিত্রের পরিপূরক রচনা, বীর রামচন্দ্রের পূর্ব ও উত্তর জীবন অবলম্বনে ভবভূতি যথাক্রমে রচনা করেন মহাবীর চরিত ও উত্তর রামচরিত। উত্তররাম চরিত নাটকটি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বনে রচিত, রাম কর্তৃক সীতার প্রত্যাখ্যান ও পরে তাঁর সঙ্গে পুনর্মিলন এ নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়।
এর মূল ঘটনা রামায়ণ থেকে গৃহীত বটে, কিন্তু অনেক বিষয়ে ভবভূতির স্ব-কল্পিত। রামায়ণে যেমন বাল্মীকির আশ্রমে সীতার বাস, এবং যে ঘটনার মধ্য দিয়ে রাম সীতার পুনর্মিলন ও মিলনান্তে সীতার পাতাল প্রবেশ ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে, উত্তর রামচরিতে সেভাবে বর্ণিত হয়নি। সবথেকে বড়ো পার্থক্য এর পরিণত অংশে। রামায়ণে যেখানে রাম সীতার বিচ্ছেদ ঘটেছে ভবভূতি সেখানে তাদের পুনর্মিলনের বর্ণনা দিয়েছেন, কারণ ভারতীয় নাটকে মৃত্যুর প্রয়োগ নিষিদ্ধ তাই ভবভূতি এ নাটকে সীতার পৃথিবী প্রবেশ না দেখিয়ে রামের সঙ্গে তাঁর মিলনেই নাটকের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছেন। রামায়ণের রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠান। ভবভূতির রক্ষার জন্য কৌশলে সীতাকে বনবাসে পাঠান। ভবভূতির রাম প্রজানুরঞ্জনের জন্য বিনা কৌশলে জীবনটাকে নির্বাসিত করেন।
উত্তর রামচরিতের প্রথমাংক ‘চিত্রদর্শন’। এতে অন্তঃসত্ত্বা সীতার চিত্ত বিনোদনের জন্য চিত্রদর্শন উপলক্ষ্যে রামসীতার পূর্ববৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। চিত্রপট দর্শনকালে সীতার ইচ্ছা হয়েছে পঞ্চবটী দর্শনের রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে সীতার সেই সাধন পূর্ণ করতে আজ্ঞা দিলেন। সীতা রামের কোলে যখন নিদ্রিত তখনই দুর্মুখ এসে সীতা সম্পর্কে লোকাপবাদের কথা বললে তিনি প্রজানুরঞ্জনে সীতা বিসর্জনের আজ্ঞা দিলেন। লক্ষ্মণ রথ নিয়ে এলে সেই আজ্ঞাই কার্যকরী হল। অবশ্য সীতা জানতে পারলেন না যে এ তার নির্বাসন—তিনি আনন্দে দর্শনে গেলেন।
দ্বিতীয় অঙ্কের নাম পঞ্চবটী প্রবেশ। এখানে লবকুশ প্রসঙ্গ বাল্মীকির রামায়ণ রচনার বৃত্তান্ত বর্ষিত হয়েছে। তৃতীয় অঙ্কের নাম—’ছায়া’। এটিও ভবভূতির অপূর্ব সৃষ্টি। এখানে সীতার জন্য রামের বিলাপ বর্ণিত হয়েছে। চতুর্থ অঙ্কে কৌশল্যা ‘জনক যোগে’ দৃশ্যের লবের আবির্ভাব। পঞ্চম অঙ্কে কুমার প্রত্যাভিজ্ঞানে। লব ক্রুশের সঙ্গে রামের পরিচয়, সপ্তম অঙ্কে ‘সম্মেলন’ ভবভূতির নতুন পরিকল্পনা তিনি এখানে করুণ রসোচ্ছল রামায়ণের মিলনান্ত পরিণতি দান করেছেন। সব মিলিয়ে ভবভূতির এ নাটক একেবারেই অভিনব আঙ্গিকে গড়া।
কাদম্বরী চরিত্র: অর্ধসমাপ্ত এই রোমান্সধর্মী গদ্য রচনাটিকে সম্পূর্ণতা দান করে বাণভট্টের পুত্র ভূষণভট্ট বা ভট্টপুলিন; সুতরাং কাদম্বরীর কাহিনি স্পষ্টত দুটি অংশে বিভক্ত—পূর্ব ভাগ ও উত্তর ভাগ। পূর্ব ভাগে আছে—
উজ্জ্বয়িনীর রাজা তারাপীড় ভগবৎকৃপায় চন্দ্রাপীড়কে পুত্ররূপে লাভ করেন এবং মন্ত্রী শুকনাক বৈশম্পয়ান নামে পুত্র লাভ করেন। রাজপুত্র ও মন্ত্রীপুত্র বড়ো হলে ইন্দ্রায়ুধ নামে একটি অশ্ব রাজপুত্র ও পত্রলেখা নাম্নী এক সুন্দরী রমণীকে মন্ত্রীপুত্র পুরস্কার স্বরূপ পান, একদা চন্দ্রাপীড় বন্ধু ও দাসী সহ অশ্বারোহণে দ্বিগ্বীজয়ে বার হন, পথিমধ্যে স্বজন ভ্রষ্ট হয়ে চন্দ্রাপীড় অচ্ছোদ সরোবর তীরে অপূর্ব সুন্দরী বিরহিণীর নারীমূর্তির সম্মুখীন হন। কন্যাটির নাম মহাশ্বেতা। পরিচয় জানতে চাইলে মহাশ্বেতা বলে—
সে গৌরী নাম্নী অপ্সরার কন্যা। এক সুদর্শন মুনীপুত্র পুণ্ডরীকে ও তাঁর বন্ধু কপিঞ্জলকে দেখে মুগ্ধ হন এবং পুণ্ডরীককে ভালোবেসে ফেলে। পুণ্ডরীকও তাঁর প্রেমে পড়ে বিরহ কাতর হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। সংবাদ পেয়ে মহাশ্বেতাও আত্মহত্যা করতে উদ্যত হলে চন্দ্রমণ্ডল থেকে একদিব্য জ্যোতি এসে পূনর্মিলনের আশ্বাস দিয়ে যায়, মহাশ্বেতা তাই প্রতীক্ষামানা, কথা প্রসঙ্গে উত্থাপিত হয় তার প্রিয়সঙ্গী কাদম্ববীর কথা। সখীর সঙ্গে কাদম্বরীর আলাপ হলে অচিরেই তাঁর প্রেমে পড়ে। চন্দ্রাপীড় উজ্জ্বয়িনীতে এখানেই বাণভটের কাহিনি সমাপ্ত হয়েছে।
উত্তর ভাগে ভূষণভট্ট বর্ণনা দেন চন্দ্রাপীড়ের কাদম্বীর দর্শনের জন্য ব্যাকুলতা, বৈশম্পায়নের মহাশ্বেতার প্রতি উন্মত্ত প্রেমের প্রকাশ ও তার অভিশাপে শুক পাখি হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে মৃত্যুবরণ, পুণ্ডরীকের মৃত্যু, কাদম্বরী ও পত্রলেখার শোক ও কাদম্বরীর আত্মহননের আকাঙ্ক্ষা, শেষে দৈববাণী শ্রবণে পুনর্মিলনের জন প্রতীক্ষা, পত্রলেখা ও ইন্দ্ৰায়ুধ সলিল সমাধি, কপিঞ্জলের পুনরাবির্ভাব ও তার পূর্ববৃত্তান্ত কখন সেই সঙ্গে পুণ্ডরীকে ও চন্দ্রাপীড়ের সত্য পরিচয় উদ্ঘাটন শূদ্রকই যে চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়নই যে শুক তথা পুণ্ডরীক তা জানা গেল। শূদ্রক ও শূক দেহত্যাগ করলে চন্দ্রপীড়ের দেহে জীবনসঞ্চার হল পুণ্ডরীকও চন্দ্র থেকে নেমে এলেন। কাদম্বরীর সঙ্গে চন্দ্রাপীড় ও মহাশ্বেতার সঙ্গে পুণ্ডরীকের মিলনের মধ্য দিয়ে কাহিনির উপসংহার টানা হয়।
বাণভট্টের কাদম্বরী নিঃসন্দেহেই সংস্কৃত গদ্য সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর অত্যুজ্জ্বল রত্ন বিশেষ, এমন শব্দ সম্পদ ও ধ্বনি গৌরব, এমন ভাষার ইন্দ্রজাল, মানবিক হৃদয়বৃত্তির এমন অপূর্ব বিশ্লেষণ, নিসর্গ পর্যবেক্ষণের এমন সন্ধানী দৃষ্টি সর্বোপরি এমন চিত্র সৌন্দর্য ভারতীয় সাহিত্যে দুর্লভ। রবীঠাকুরের কথা দিয়ে শেষ করতে হয়— কবিদের মধ্যে চিত্রাঙ্কনে বাণভট্টের সমতুল্য কেউ নাই, সমস্ত কাদম্বরী কাব্য একটি চিত্রশালা। এখানেই কবি বাণভট্টের বিশেষত্ব।
বিক্রমোবর্শী : কালিদাসের শেষ নাটক বিক্রমোবশী পঞ্চাঙ্কে বিভক্ত নাটকটি পুরুরূবা ও উর্বশীর প্রেম কাহিনির অবলম্বনে রচিত।
শিবপূজার জন্য উর্বশী কৈলাসে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় বেশী দাস তাকে অপহরণ করে, পুরুরবা এই সময় সূর্য পূজা করে ফিরছিলেন, ‘তিনি উর্বশী-কে উদ্ধার করেন এবং সখীদের কাছে তাকে ফিরিয়ে দেন। অপ্সরা স্বর্গে ফিরে গেলেন বটে কিন্তু পুরুরবা ও ঊর্বশী পরস্পরের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেন। অতঃপর ইন্দ্রসভায় লক্ষ্মী স্বয়ংবর নাটকে লক্ষ্মীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে পুরুবব্বার প্রেমে গভীরভাবে মগ্না উবর্শী পুরুষোত্তম বলতে গিয়ে ‘পুরুরবা’ বলে ফেলায় আচার্য ভরত ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে অভিশাপ দেন—উর্বশীর স্থান স্বর্গে হবে না। ইন্দ্র দয়া পরবশ হয়ে শাপকে বরে পরিণত করেন—“যার প্রতি তুমি অনুরাগিণী সেই রাজর্ষি পুরুরবা আমার যুদ্ধের সহায় তাঁর উপকার করা আমার কর্তব্য। অতএব যতদিন না তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণ করে ততদিন তুমি তার সঙ্গে যথেচ্ছ বাস করো।”
রাজা পুরুবরা উর্বশীর সঙ্গে কৈলাসের গন্ধমাদন পর্বতে প্রমোদে গা ভাসিয়ে দেন এবং রাজ্যভার অর্পণ করেন মন্ত্রীদের ওপর। পর্বতে একদিন রাজার অন্যমনস্কতায় অসংযতায় উর্বশী মান ভরে রাজাকে ত্যাগ করে কুমার বনে চলে যান। চিরকুমার কার্ত্তিকেয়ের সংরক্ষিত এই বনে স্ত্রীলোকের প্রবেশ নিষেধ ছিল—উর্বশী বনে প্রবেশ করা মাত্র লতায় পরিণত হলেন। তাকে না দেখতে পেয়ে রাজা শোকে উন্মাদগ্রস্ত হন। সমস্ত চতুর্থ অঙ্ক জুড়ে বিরহে উন্মত্ত রাজার প্রেম প্রলাপোত্তিতে পূর্ণ। পাগলের মতো ঘুরতে ঘুরতে একদিন রাজা একটি রক্তবর্ণ মণি পেলেন এবং দৈববাণী শুনলেন—“এই মণির দ্বারাই তুমি তোমার হারানো প্রিয়াকে ফিরে পাবে।” রাজা কুমার বনে প্রবেশ করে একটি পুষ্পবিহীন লতাকে স্পর্শ করা মাত্র জীবন্ত উর্বশীকে ফিরে পেলেন। এরপর রাজা সুখে কাটাতে লাগলেন। পরে নানা কৌশলে রাজা ও উর্বশী আজীবন সুখে কাটানোর জন্য দেবতাদের নিকট নির্দেশ পেলেন।
তবে বলতে হয় না আছে সংযত না আছে গৌরব—আছে কেবল স্বার্থপরতা। নায়ক পুরুরবার প্রেমিক সত্তার পরিচয় পাওয়া গেলেও তাঁর রাজোচিত মহিমা প্রেম পারবশ্যতার জন্য নিঃসন্দেহে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। নাটকের গৌণ চরিত্রগুলি কিছুটা প্রাণবন্ত, বিশেষ করে হাস্যরস সৃষ্টির উপাদান বিদূষক চরিত্রটি কিছুটা প্রাণবন্ত মনে হয় তার বোকামি, ভাঁড়ামি নাটকের ক্ষেত্রে এই জাতীয় টাইপ চরিত্রের উপযোগীই হয়েছে। নাটকের শেষ অঙ্কে আয়ুর, আবির্ভাব কতকটা যেন জোর করেই প্রবেশ করানো হয়েছে যা নাটকীয় কৌশল হিসাবে ত্রুটিপূর্ণ, ফলে নাটকটি যেন বর্ণহীন অতি সরল এক কাহিনিতে পরিসমাপ্তি লাভ করেছে।
বসন্তসেনা চরিত্র : ‘বসন্তসেনা’ রাজা শূদ্রক প্রণীত ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের নায়িকা। ইনি গণিকা, ধনী কিন্তু সৎ, নাটকের নায়ক চারু দত্ত অতি দরিদ্র। তাঁর প্রতি বসন্তসেনা আকৃষ্ট হয় তা দেহজ নয় মানসিক। বৃত্তির দিক থেকে গণিকা হলেও চারু দত্তকে দেখার পর বসন্তসেনার জন্মান্তর হয়েছে। কায়মনবাক্যে তিনি গণিকাবৃত্তি পরিহার করেছেন। যে অলংকার ক-টি এই নাটকের নামকরণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা বসন্তসেনার, সেগুলি চারু দত্তের কাছে গচ্ছিত রাখেন, শুধু অলংকার নয় মনও। তার ইচ্ছা চারু দত্তের সঙ্গে আবার যেন দেখা হয়। দাসী মদনিকার কাছে বসন্তসেনা নিজ হৃদয়ে উদ্ঘাটিত করেন, তিনি যে দরিদ্র পুরুষ চারু দত্তে আসন্তু সেকথা গোপন করেননি।
এদিকে মদানিকার প্রতি প্রেমাসক্ত শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণ যুবক উপযুক্ত মূল্য দিয়ে তাকে দাসীত্ব থেকে মুক্তি করতে চারু দত্তের ঘরে সিঁধ কেটে বসন্তসেনার গচ্ছিত অলংকার চুরি করে। চারু দত্ত বিপদে পড়ে। তিনি তাঁর পত্নী ধৃতাদেবীর রত্নমালা বিদূষকের হাতে বসন্ত সেনার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। শর্বিলক সে অলংকার মদনিকার হাতে দিতে সে চিনতে পারে এবং শর্বিলককে দিয়ে তা বসন্তসেনাকে ফেরৎ দেয়। বিদূষক ধৃতাদেবীর রত্নহার বসন্ত সেনাকে দিতে গেলে বসন্তসেনা প্রত্যুত্তরে বললেন সন্ধ্যায় সে চারু দত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী। এক বর্ষার পটভূমিকায় চারু দত্তের সঙ্গে বসন্তসেনা নির্জনে মিলিত হলেন।
বসন্তসেনা ধৃতাদেবীকে তার রত্নমালা ফেরৎ পাঠালে তিনি তা পুনশ্চ ফেরৎ পাঠিয়ে বললেন স্বামীই তার শ্রেষ্ঠ কণ্ঠহার। এমন সময় চারু দত্তের পুত্র রোহ সেন বায়না ধরে—তার সোনার গাড়ি চাই। বসন্তসেনা বালকের মাতৃত্বপদলাভের আশায় তার গায়ের সমস্ত আভরণ দান করে নির্দেশ দিলেন সোনার গাড়ি ক্রয় করতে।
একদা রাজশ্যালক শকারের দ্বারা অপহৃত হয়ে তার বাগান বাটীতে আনীত হলে শকার জোরপূর্বক তার নিকট প্রণয় নিবেদন করে, তাকে বসন্ত সেনা ক্ষীপ্ত হয়ে শকারকে পদাঘাত করেন। ক্রুদ্ধ হয়ে শকার বসন্ত সেনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলা টিপে ধরেন। বসন্ত সেনা অল্পক্ষণেই অচৈতন্য হয়ে পড়লে মারা গেছে ভেবে সেখানেই ফেলে শকার পালিয়ে যায় এবং বিচারকের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানায় চারু দত্তই অর্থলোভে বসন্ত সেনাকে হত্যা করেছে।
এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর কৃপায় ও সেবায় বসন্ত সেনা সংজ্ঞা ফিরে পান। রাজার বিচারে চারু দত্তের শূল দণ্ডাদেশ হয়েছে। তাঁকে যখন দক্ষিণ মশানে নিয়ে যাওয়া হল তখনই বসন্তসেনা বৌদ্ধ ভিক্ষুকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে সব সমস্যার সহজ সমাধান করে দিলেন, এদিকে রাজা বসন্তসেনাকে বধূরূপে স্বীকৃতি দেন।
তাই বলতে হয় বসন্তসেনার চরিত্র চিত্রণে যথার্থই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন বিশেষ করে তার অন্তর্দ্বন্দ্বকে নাট্যকার যথার্থই ফুটিয়ে তুলেছেন।
মালতী মাধব : সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে মহাকবি কালিদাসের পরেই স্মরণীয় নাম শ্রীকান্ত ভবভূতি। তাঁর প্রথম নাটক ‘মালতী মাধব। এটি দশ অঙ্ক বিশিষ্ট নাটক। এর বিষয়বস্তু লৌকিক এবং কবি কল্পিত—প্রেম মিলনের গতানুগতিক কাহিনি।
বৌদ্ধ পরিব্রাজিকা কামন্দকীর নীতি কৌশলে মন্ত্রী ভুরি বসুর কন্যা মালতীর সঙ্গে দেবরাতের পুত্র মাধবের মিলন এ নাটকের প্রধান ঘটনা। এতে নায়ক-নায়িকার হৃদয়গত প্রণয় চেষ্টার বর্ণনা প্রধান স্থান অধিকার করলেও নাট্যকার যে অদ্ভুত, বীভৎস ও রৌদ্ররসের অবতারণা করেছেন তা অভিনব। একটি নাটকে একসঙ্গে এতগুলি রসের পরিবেশন ভবভূতির কৃতিত্বের পরিচায়ক।
এ নাটকে ভবভূতি বামাচারী তন্ত্র সাধনার বিষয়ে মূল্যবান তথ্য বিশেষ বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থিত করতে পেরেছেন এবং বৌদ্ধ সাধক ও সাধিকারের জনকল্যাণমূলক কার্য প্রণালীরও পরিচয় দানে সক্ষম হয়েছেন। পরিব্রাজিকা কামন্দকী সংসার ত্যাগ করলেও লোক কল্যাণে বিশেষ করে নায়ক-নায়িকার মিলনের প্রয়োজনে সাংসারিক কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধা করেননি। তিনি তাঁর দুই সহযোগী অবলোকিতা ও সৌদামিনীর সাহায্যে আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এই ব্যাপারে কাপালিকদের মতো মহামানী বৌদ্ধরা ও যে মন্ত্রবলের ও যোগবলের অধিকারিণী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় সৌদামিনীর কার্যকলাপে।
এ নাটকে নাট্যশিল্প সম্পর্কে ভবভূতির নিজস্ব কিছু মতামতের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করতেন নাটকে—’রসাদির নিগূঢ় প্রমেতা, মনোরঞ্জক অভিনয় ক্রিয়া, বীরুত্ব যুক্ত প্রণয় চিত্র, কথা ও বৈদগ্ধ পূর্ণসংলাপ’ থাকা আবশ্যক।
বস্তুত বৈদগ্ধ্যপূর্ণ সংলাপ রচনায় ভবভূতির বিশেষ দৃষ্টি ছিল, মালতী মাধব নাটকে সেইরূপ সংলাপ রচনা করে অনেক সময় তিনি পাঠক তথা, দশকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছেন। নাটকীয় ঘটনাবলি অনেক পরিমাণেই দৈব ও আকস্মিকতার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় নায়ক নায়িকা চরিত্রে স্বকীয়তা বর্জিত হয়েছে। মালতী দু’দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আকস্মিক ভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এই নাটকের চরিত্রগুলি বাস্তব জগৎ থেকে দূরে-রোমান্সের জগতে বাস করে নামে উজ্জ্বয়িনীর বাসিন্দা হলেও তারা যেন নিজ নিজ গণ্ডিতে আবদ্ধ, যেখানে বাঘের আক্রমণ প্রতিহত করা, কুমারী বলির ষড়যন্ত্র করা চলে এতে অবিশ্বাসের কিছু নেই।
অবশ্য ভবভূতির কবিত্ব শক্তির পরিচয় এই নাটকে প্রকৃতির রূপ বর্ণনায়, বিশেষ করে বিন্ধ্য পর্বতের বর্ণনায় বিধৃত হয়েছে। আর তার শ্রেষ্ঠত্ব উৎকট রস সৃষ্টিতে তাই তিনি ‘উৎকটে ভবভূতি’।
Leave a comment