কবিতা একান্তভাবে ভাবনির্ভর, কিন্তু ছোটোগল্প আখ্যাননির্ভর। কবিতা বা পদ্য ছন্দশাসনে বাঁধা, কিন্তু ছোটোগল্প যেহেতু গদ্যনির্ভর, সেহেতু তা ছন্দশাসন থেকে মুক্ত। এইভাবে ছোটোগল্প বা গদ্যের জগতের সঙ্গে কবিতা বা পদ্যের জগতের পার্থক্য নিরূপণ করাই যায়। কিন্তু তবু স্বীকার করতে হবে, এই সীমারেখা টানা, কিংবা ভাব ও আখ্যানের জগতের কাঁটাতার ঘেরা পৃথক কোনো মানচিত্র নির্মাণ কার্যত অসম্ভব। কারণ সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন যেখানে মানব-হৃদয় বা মানব চরিত্র এবং সাহিত্যের সৃজনভূমি যেহেতু সূক্ষ্ম সংবেদনশীল সাহিত্যিকের হৃদয় ও মস্তিষ্ক, সেহেতু প্রায়শই গদ্য ও পদ্যের জগতের সীমারেখা লঙ্ঘন করে একটা পারাপার চলে। কবিতা চলে আসে গদ্যনির্ভর কোনো সাহিত্যের সীমানায়, কিংবা গদ্যরচিত সাহিত্য চলে আসে কবিতার কাছাকাছি।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্য পদ্যে রচিত হলেও তার প্রধান আশ্রয় ছিল কোনো-না-কোনো আখ্যান। মঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে এই গল্প প্রাধান্য ছিল তীব্র। অর্থাৎ মধ্যযুগে গদ্যের প্রচলন থাকলে মঙ্গল-পাঁচালিগুলি অনায়াসে গদ্যেও উপন্যাস আকারে লেখা চলত। এমনকি বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে তীব্রভাবে গীতধর্মিতা থাকলেও সেখানেও একটি প্রচ্ছন্ন আখ্যানের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। মধ্যযুগ পর্যন্ত পদ্য ছাড়া গদ্যের বিকল্প ছিল না বলেই বাধ্য হয়ে মধ্যযুগীয় সাহিত্যিকবৃন্দকে কবিতা ও আখ্যানের উভয় কর্মকেই পদ্যের মাধ্যমে রূপ দিতে হয়েছে।
কিন্তু আধুনিক যুগপর্বে গদ্য ও পদ্যের রীতিপদ্ধতি চিহ্নিত ও প্রচলিত হয়ে গেলে কবিতা ও গল্পের ক্ষেত্রও পৃথকভাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। তখনই বস্তুঘন, আখ্যানপ্রধান বিষয় গদ্য বা গল্পের ক্ষেত্র এবং ভাবঘন বিমূর্ত ভাবনা কবিতার ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হতে থাকে। কিন্তু এই যান্ত্রিকভাবে গদ্য-পদ্যের ক্ষেত্র বিভাগ সর্বদা সম্ভব নয়। জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটির মধ্যে স্পষ্ট একটি আখ্যান রেখা আছে। ফলে বলা যেতেই পারে, আলোচ্য কবিতাটি আসলে একটি ছোটোগল্প, কিন্তু লেখা হয়েছে কবিতার আদলে।
প্রকৃতপক্ষে ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটির মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের আভাস। জয় গোস্বামীর অনেক কবিতাই যেন একটা গল্প বলে। এইরকম আখ্যানের আভাস আছে।
‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর আখ্যানটি আসলে নিহত-প্রেম এক সাধারণ মেয়ের আত্মকথনমূলক কাহিনি। কিশোরী বয়সে নবম শ্রেণিতে পড়াকালেই বয়ঃসন্ধির স্বাভাবিক নিয়মে তার মনে জেগেছিল প্রেমের স্বপ্ন। মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ডেস্কে বসে অঙ্ক কষতে করতেই সে দেখতে পেত বাইরে দিদিমণির সঙ্গে পাশে দিদিমণির বরের ঘনিষ্ঠ কথোপকথন। শিক্ষিকার দাম্পত্য জীবনের এইটুকুমাত্র ঘনিষ্ঠ জীবনের চিত্রই তার মনে এক মধুর প্রেমাকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন বুনে দিত। সেই স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনা দেখা দিল শহর থেকে গ্রাম বা গভটিতে বেড়াতে আসা বেণীমাধবকে ঘিরে। কিন্তু বেণীমাধবকে ভালোবাসার তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা জাগলেও একটা মানসিক বাধাও মেয়েটিকে ঘিরে থাকে। তার মধ্যে কিশোরী বয়সের বা বয়ঃসন্ধিকালের লজ্জা তো ছিলই। সেইসঙ্গে সাধারণ মেয়েটি সেই কিশোরী বয়সেই বুঝে গিয়েছিল মেধাগত নিরিখে বেণীমাধবের স্থান তার থেকে অনেক উঁচুতে। তাছাড়া, আর্থিক সঙ্গতির পার্থক্যটাও তখনই অনুভব করেছে ষোলো বছরের কিশোরীটি। “আমার বাবা দোকানে কাজ করে” –এই স্বগতোক্তির মধ্যে সেই পূর্বরাগ পর্বেই তার মনে জাগে প্রেম হারাবার আশঙ্কা।
কিন্তু যৌবনের স্বপ্ন কোনো প্রতিবন্ধকতাকেই স্বীকার করতে চায় না। কিশোরী মেয়েটির বাবা দোকানে কাজ করলেও যৌবনের উদ্গমকে সেই দারিদ্র্য ঠেকিয়ে রাখতে পারে না; পারে না প্রেমের স্বপ্নকে অবদমিত করে রাখতে। মনের মধ্যে যৌবনের তমাল তরুমূল থেকে ভেসে আসে যে প্রেমের বাঁশির আহ্বান, সেই নাছোড় ডাকের তাড়নাতেই পড়াশোনায় মন বসে না তার, অঙ্ক করতে ভুল হয়ে যায় বারবার। এরই মধ্যে একদিন সুলেখাদের বাড়িতে আলাপ হয় বেণীমাধবের সঙ্গে, তারপর ব্রিজের ধারে লুকিয়ে দেখা হয় সেই প্রিয় মানুষটির সঙ্গে, যার নাম বেণীমাধব।
অনেকদিন পর সেই কিশোরকালের প্রেম-রোমাঞ্চের কথা কেবল স্মৃতি হয়ে ভাসে মেয়েটির মনে। কৈশোর পর্ব কেটে যেতেই সময়ের ব্যবধানে একদিন বেণীমাধর পেয়ে যায় রূপে-গুণে উপযুক্ত অন্য সঙ্গিনী। বেণীমাধবের এই নতুন প্রেমজীবন সম্পর্কে কোনো অভিযোগ নেই মেয়েটির। কিন্তু দুজনকে ‘মানিয়েছিল ভালো’ এই স্বীকারোক্তি এবং ওদের ভালো হোক’ বলে কল্যাণ কামনার অন্তরালে প্রেমবঞ্চিতা মেয়েটির রক্তাক্ত হৃদয়ের যন্ত্রণা ও কুলপ্লাবী অশ্রু অগোচর থাকে না পাঠকের।
দারিদ্র্য ও প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আজ দিন কাটে মেয়েটির। দারিদ্র্যের চাপেই তার ছোটো বোনটি একদিন হারিয়ে যায় চোরাপথের বাঁকে। পাড়ার সেলাই দিদিমণি হিসাবে কোনোক্রমে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে করতেই তার মহার্ঘ দিনগুলি পার হয়ে যায়। আজকের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হলেও আগামী দিনটির ভবিষ্যৎ জানে না সে—“আজ জুটেছে, কাল কি হবে, কালের ঘরে শনি—”।
জীবনের এই তীব্র বঞ্চনা কখনো কখনো ক্ষোভের আগুন হয়ে প্রতিবাদী ভূমিকায় প্রকাশ পেতে চায় হয়তো। কিন্তু কী এক প্রচণ্ড অবসাদে সেই প্রতিবাদের আগুনও যেন জ্বলে না– “তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই!” কেবল কোনো এক সর্বনাশা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতটাই তার সামনে বড়ো হয়ে ওঠে। চোরাপথের বাঁকে হারিয়ে যাওয়া বোনের মতো প্রেমবঞ্চিতা এই মেয়েটিও যদি একদিন নিজেকে নষ্ট করে ফেলে! অথবা যে বেণীমাধব একান্ত আর্থ-সামাজিক শ্রেণিভেদের কারণেই তার প্রেমকে উপেক্ষা করেছে, সেই বেণীমাধবের প্রেমবঞ্চনার প্রতিবাদেই সে নিজেকে নষ্ট ভ্রষ্ট করে দিতে চায় হয়তো। হয়তো বৈষ্ণব পদাবলির সেই রাধিকার মতো আত্মহননের পথেই মেয়েটি তার স্বপ্নের নায়ককে মানসিকভাবে পীড়ন করতে চায়। বঞ্চিতা রাধা যেমন বলেছিল—’বঁধু, যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও/মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।”— তেমনি ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর কালো মেয়েটিও বেণীমাধরের উদ্দেশে জানায়—“কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই।”
সমগ্র কবিতাটির মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে আধুনিক এক ছোটোগল্পের বীজ। যেখানে আখ্যানের বিস্তৃত পুঙ্খানুপুঙ্খ অবাত্তর। রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের মতো চরিত্রের গভীর গহনের থেকে উঠে আসা একটি অনুভব যেন মহাকাব্যের ব্যাপ্তি নিয়ে মেঘলা ব্যথার মতো জড়িয়ে যায় পাঠকের অন্তরে। তখন কবিতা আর ছোটোগল্পের মধ্যে তেমন স্পষ্ট বিভাজন আর থাকে না। কালো মেয়ের কিশোরবেলার স্বপ্ন বাস্তবের অভিঘাতে তার স্বপ্নভঙ্গ, প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানিভোগ, বঞ্চনার যন্ত্রণাভোগ ইত্যাদি আখ্যানধর্মী বিবরণগুলি ছাপিয়ে তবু পাঠকের মনে কবিতার মতো অথবা গানের মতো বাজতে থাকে তার অপরাজেয় প্রেমস্বপ্ন— ‘বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো।’
Leave a comment