এক অবিবাহিতা মেয়ের প্রথম প্রেমের স্মৃতিকাতরতার চিত্র যথাযথভাবে পরিস্ফুট হয়েছে আলোচ্য কবিতায়। মেয়েটির চরিত্রে গভীর বাস্তবতাবোধ থাকলেও তার শরীর ও আত্মা রোমান্টিকতার হাতছানিকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। প্রেমিকের স্মৃতি তার অবচেতন সত্তায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা জাগিয়েছে। বেণীমাধবকে জীবনসঙ্গী করার স্বপ্ন তার ছিল, কিন্তু সামর্থ্যে কুলোয় নি । সে কালো এক গরিব। তার বাবা সামান্য এক দোকানে কাজ করতো। সে ছিল পাড়াগ্রামের সাধারণ মেয়ে। অপরদিকে বেণীমাধব ছিল শহরের ছেলে এবং লেখাপড়ায় ভালো—
‘বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভালো
শহর থেকে বেড়াতে এলে, আমার রঙ কালো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে
বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জুরী
সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কে ভুল করি
আমি তখন নবম শ্রেণি : আমি তখন ষোলো
ব্রীজের ধারে, বেণীমাধব, লুকিয়ে দেখা হল।’
পরের দুই স্তবকে আছে তার ব্যর্থ যৌবনের কথা। সে কথা স্মৃতিকে নিয়ে গোপনে গোপনে আয়তনে বেড়েছে। মেয়েটি আলোর নীচে তার স্বপ্নের বেণীমাধরের সঙ্গে তাঁর প্রেমিকাকে দেখে স্পর্ধা, করুণা আর প্রচ্ছন্ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্চারণ করেছিল—
‘আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে: অপূর্ব সে আলো।
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমরা, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।’
কিন্তু মেয়েটি প্রজাপতির মতো দিনগুলোর হাতছানি, তার ষোলো বছরের কৈশোরের মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের স্মৃতিকে কি করে ভুলবে? শেষ স্তবকে বেণীমাধবকে উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলে, তাতে আসলে নিজেকে নিজেই ব্যঙ্গ করে—’কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?’ শুধু অভিমান নয়, চাপা ক্রোধও আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না।
বেদনার গঙ্গাকে বহন করার ক্ষমতা মেয়েটির নেই, তার শুধু আছে চোখের জল। মরীচিকার মায়ায় এরা ঘুরপাক খায়, আর চোখের জলে রাত্রে বিছানা ভেজায়। ভবিতব্যকে জানার ক্ষমতা এদের থাকে না। উচ্ছ্বল দিনগুলো সরে যায়, জড়ত্বময় দিনগুলোকে আঁকড়ে ধরে একা-একাই তাদের বেঁচে থাকতে হয়।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ কবিতার মেয়েটিকেও এইভাবেই বেঁচে থাকতে হয়েছিল। শেষে বিকেলে একটা দুটো পয়সার বিনিময়ে যে হরবোলা ছেলেটি কোকিল ডাকতে ডাকতে চলে যেত, দুর্ভিক্ষের নিষ্ঠুর দিনগুলো সেই ছেলেটিকে চিরকালের জন্য ছিনিয়ে নিয়েছিল। কালোকুৎসিত মেয়েটির সে ছিল প্রেমিক। ছেলেটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনের মগ্ন ও আশা ফুরিয়ে গেল। তারপর অনেকদিন পর গায়ে হলুদ দেওয়া বিকালের আকাশের দিকে তাকিয়ে তার ব্যর্থ যৌবনের কথা মনে পড়লো। আকাশটিকে তার বিয়ের চিঠি বলেই মনে হয়েছিল। প্রজাপতিটা গায়ে উড়ে এসে পড়তেই তার গোপন স্বপ্ন ভেঙে গেল। সে জানতে পারলো, যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের ঝড় তার জীবনের সমস্ত কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। এ জীবনে আর তার বিয়ে হবে না। তার প্রেমিক আর কখনও ফিরে আসবে না—
‘লাল কালিতে ছাপা হলদে চিঠির মত
আকাশটাকে মাথায় নিয়ে
এ-গলির এক কালো কুচ্ছিত আইবুড়ো মেয়ে
রেলিঙে বুক চেপে ধরে এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিল—
ঠিক সেইসময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
আ মরণ ! পোড়ারমুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি!
মেয়েটি যেমন করে বাস্তবে ফিরে এলে, ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর নায়িকাও ঠিক তেমনইভাবে কবিতার শেষ স্তবকে বাস্তবে ফিরে এসেছিল। ভেঙে গিয়েছিল তার বিস্ময়ের ঘোর। কঠিন জীবন-জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়ে সেলাই দিদিমণি বেণীমাধবকে জিজ্ঞাসা করেছে—’কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?’
খাঁচায় বন্দী উড়তে না পারা পাখির মতো মেয়েটিও শুধু ডানা ঝাপটেছে। ‘আজ জুটেছে কাল কী হবে? কালের ঘরে শনি—ক্ষান্তহীন এক ক্লান্তির ছায়া তাকে গ্রাস করেছে। চরণের ভিতরে হাইফেন তো প্রেম ও করুণা না পাবারই বিরতি। ‘দেখেছিলাম আলোর নীচে ; অপূর্ব সে আলো’—আলোর অলঙ্কৃত বর্ণনা এখানে থাকে না, বরং আলো ছাপিয়ে পুঞ্জ-পুঞ্জ দুঃখই ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। এ আলো ঠিক জীবনের আলো নয়, এ আলো বর্হিজীবন থেকে নিজেকে খণ্ডিত করে নেয়। এ আলোয় আপন বেদনার অসম্পূর্ণতাই বড়ো হয়ে ওঠে। স্কুলের দিদিমণি বর পায়, কিন্তু সেলাই দিদিমণির বর জোটে কই? যৌবনের ডাকে সাড়া দিয়ে তার বোন নষ্টমেয়ের দলে নাম লিখিয়েছে। তার জীবনের গতি কোথায়? বেণীমাধব তো তাকে একটিবারও শোনায় নি, বিয়ের ‘ফুল ফুটুক’ না ‘ফুটুক’ কবিতায় কিন্তু সেই পৌরুষদীপ্ত ঘোষণা আছে— ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, তবু, আজ বসন্ত’, কিন্তু মেয়েটির জীবনের বসন্ত তো শেষ হয়ে গেছে।
বর্তমানের কোনো একদিন একটি আলোর নীচে সে বেণীমাধবের সঙ্গে তার প্রেমিকাকে দেখেছি—
“আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো”
—এই মানানসই যুগলের উপস্থিতি তার চোখ জুড়িয়েছিল। একই সঙ্গে তাকেও পুড়িয়েও ছিল। কেননা, যাকে পাওয়ার অন্তিম বাসনায় সে আজও বিনিদ্র রজনী জাগে—সেই স্বপ্নের পুরুষ বেণীমাধব আজ অন্যের। এ যেন রাধার ‘আমার বধূয়া আন বাড়ি যায়/আমারি আঙিয়া দিয়া’। এমত অবস্থায় সে ‘কুম্ভকারের পোণীর’ মতোই অন্তরে জ্বলতে জ্বলতে প্রেমের চিরন্তন বেদনাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চায়। একই সঙ্গে তার শুভবোধ থেকে প্রিয়তমের মঙ্গল কামনায় বিষণ্ন মনে সে বলে ওঠে—
“জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।”
প্রেম তার ব্যর্থ। তবুও তার কাছে প্রেমের দুঃখই সত্য। মোহনবাঁশি বাজিয়ে যে বেণীমাধবের আগমন তার অন্তরে, সেই বেণীমাধব এখন হয়তো জ্যোৎস্না ভরা রাতে তার নতুন প্রেমিকাকে নিয়ে নতুন স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু মেয়েটি ? তার কথায়—
‘রাতে এখন ঘুমোতে যাই একতলার ঘরে
মেঝের উপর বিছানা পাতা, জ্যোৎস্না এসে পড়ে।
এ জ্যোৎস্না তার কাছে আর রোমান্সের অনুভূতি জাগায় না। এ জ্যোৎস্না এক নির্মম আলো হয়ে তাকে শুধু বিছানায় জাগিয়ে রাখে। তার ছোটবোনটিও এমনই ভাবে কোনো এক উন্মাদনায় ঘর ছেড়েছে। আজ তার কোনো ঠিকানাই মেয়েটির জানা নেই। সে শুধু বুঝেছে— ‘আজ জুটেছে। কাল কী হবে? কালের ঘরে শনি’ অর্থাৎ তার কালের ঘরে যেমন শনি বিরাজ করছে, তেমনি চোরা পথের বাঁকে মিলিয়ে যাওয়া বোনটির জীবনেও বিরহের শনি দেবতা উপস্থিত হয়ে তাকে টেনে নিয়ে গেছে জীবনের কোনও অতল পাঁকে।
মেয়েটি এখন শুধুই ‘এই পাড়ার সেলাই দিদিমণি’। কবিতার অন্তিম স্তবক এই ‘সেলাই দিদিমণি’র ব্যথা জর্জরিত জীবনেরই গল্প। ফেলে আসা প্রেমের মধুর স্মৃতিটুকুই তার এখন সম্বল—এ স্মৃতি ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের স্মৃতি। তাই কবিতার যথার্থ নামকরণ ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’। এই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে যে প্রেমের সূত্রপাত জীবনের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়েও সেই প্রেমের স্মৃতিই তার বেঁচে থাকার রসদ। এ প্রেম শুদ্ধ প্রেম। এই প্রেমই তাকে জড়িয়ে নিরেট সোনা করেছে। তাই তো সে পারেনি বোনটির মতো চোরাপথের বাঁকে মিলিয়ে যেতে। পারেনি ‘নষ্ট মেয়ে’ হতে। তবুও তো আগুন জ্বলে। কিন্তু যে আগুন আজ দাউ দাউ করে জ্বলে বেণীমাধবের মনকে পুড়িয়ে ছারখার করবার কথা সে আগুন কই? আগুন আছে অথচ আগুনের পোড়াবার শক্তি যেন নিঃশেষিত—
‘তবু আগুন, বেণীমাধব ; আগুন জ্বলে কই?’ কবিতার শেষে বেণীমাধবের উদ্দেশ্যে বিরহ বোধজনিত যথার্থ ক্ষেদোন্তি—’কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?’ বিরহের কূলভাঙা স্রোতেই মেয়েটি শেষপর্যন্ত নিজেকে ‘নষ্ট মেয়ে’ করেই ভাসিয়ে দিতে চায়, ভাসিয়ে দিতে চায় বেণীমাধবের উদ্দেশ্যে।
কবিতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বমোট চারটি স্তবকে এভাবে পূর্বরাগ, অনুরাগ, অক্ষেপানুরাগ ও বিরহের ভাব নাটকীয় গল্পরসে বিচিত্র ভঙ্গিতে বর্ণিত। এছাড়াও কবিতাটির সরল বাক্য বিন্যাস, মধ্যলয়ের ছন্দের যাদু, অলংকার ব্যবহারের ব্যঞ্জনা ও সর্বোপরী কবিতার প্রেম মনস্তত্ত্বের ট্র্যাজিক ভাবনা কবিতাটিকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা দান করেছে।
Leave a comment