‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ে এক নারীর কৈশোর প্রেমের স্মৃতি ও প্রিয় মিলনের আকুতি ব্যক্ত হয়েছে। সে নিজের মুখে তার ব্যর্থ প্রেমের কথা বলেছে। সেদিনের সেই কিশোরী আজ সেলাই দিদিমণি, যে আজও ভুলতে পারেনি বেণীমাবকে— ‘বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো’। প্রেম-বিরহের এই আকুলতা মনস্তাত্ত্বিক সম্মতভাবে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। মেয়েটি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ে, যখন ক্লাসঘরের বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বরকে দেখেছিল, তখনই সুলেখাদের বাড়ি বেণীমাধবের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল। বেণীমাধব শহরের ছেলে, লেখাপড়ায় ভালো। এদিকে মেয়েটি ছিল কালো। তার বাবা সামান্য এক দোকানে কাজ করতো। আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। এদিকে বেণীমাধবকে দেখার পর থেকেই মেয়েটির হৃদয়ে মেঘ ডেকে উঠলো, বিদ্যুৎ চমকে উঠলো অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গেল রোমকূপে শ্যামকূপে। সন্ধেবেলা পড়তে বসে। মন পড়ে থাকে ওদিকে। একের পর এক অঙ্ক ভুল করে পায়। ব্রীজের ধারে লুকিয়ে দেখে বেণীমাধবকে। এরপর অনেক দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। স্কুলে দেখেছিল দিদিমণি আর তার বরকে। সেই দিদিমণির ছাত্রীও আজ দিদিমণি হয়েছে—তবে সেলাইয়ের। আর দুঃখের সংসারে তার বর জোটেনি। সে এখন একা-নিঃসঙ্গ। স্মৃতিচর্চাই এখন তার সম্বল। পূর্বরাগ থেকে অনুরাগ। বাসি ফুলের মালার মতোই সে এখন শীর্ণ ও মলিনা। বেণীমাধবকে ভুলবো বললেও ভুলতে পারে না। প্রথম প্রেম, সে যে কালশিটের দাগের মতো—কিছুতেই মেলাতে চায় না—
‘বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পর
সত্যি বলো, সে সব কথা এখনো মনে পড়ে?
সেসব কথা বলেছো তুমি তোমার প্রেমিকাকে ?
আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো।
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক?
বেণীমাধব তাকে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু সে কখনও তাকে ভুলতে পারে না। সে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে বেণীমাধবকে। মেয়েটির জবানীতেই কবিতাটি রচিত হয়েছে প্রথম স্তবকে পাঁচবার, দ্বিতীয় স্তবকে চারবার, তৃতীয় স্তবকে দু’বার এবং চতুর্থ স্তবকে একবার সে বেণীমাধবের নাম উচ্চারণ করেছে। প্রত্যেক স্তবকে আটটি করে চরণ আছে। প্রথম স্তবক এবং দ্বিতীয় স্তবকের কোথাও পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহৃত হয়নি। প্রথম স্তবকে আছে মেয়েটির সঙ্গে বেণীমাধবের আলাপের কথা, দ্বিতীয় স্তবকে আছে পূর্বরাগ ও অনুরাগের বর্ণনা। লজ্জা, শঙ্কা, আকুতি সবই আছে—‘তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে গেছি ঘরে’ এরপরেই আছে তারা দারিদ্র্যের বর্ণনা—‘আমার বাবা দোকানে কাজ করে। তারপরেই প্রেমের ভ্রমরের গুজরণ—‘কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু, ফুটেছে মঞ্জুরী। মনের মধ্যে উথাল-পাতাল সমুদ্রের ঢেউ—’সন্ধেবেলা দেখা হল’ এক-একটি সরলবাক্যে মনস্তাত্ত্বিক সম্মতভাবে প্রেমের এই ভাষাকে জমিয়ে তুলেছেন কবি। সরল বাক্যে ছোটো ছোটো শব্দে অতীতকালের ঘটনাকে প্রত্যক্ষগম্য করে তুলেছেন—
-
(১) আমি তখন মালতী ইস্কুলে
-
(২) ‘আমি তখন নবম শ্রেণি, আমি তখন শাড়ি
-
(৩) ‘আমি তখন নবম শ্রেণি, আমি তখন ষোলো
মেয়েটির নাম নেই। বাংলাদেশের হাজার হাজার কালো মেয়ের ব্যর্থ প্রেমের ক্রন্দন শুনিয়েছে মেয়েটি। অপরদিকে প্রেমের বেণী যে মাধব বাজিয়েছে, সেই তো বেণীমাধব। বেণীমাধব নিছক একটা নাম নয়, প্রেমের বাঁশি বাজিয়ে এইভাবেই সে কাঁদায়, ভাসায়, ঘরছাড়া করায়—’ডেকেছেন প্রিয়তম, কে রহিবে ঘরে’। যখন প্রেমের বাঁশি বাজেনি তখন মন দিয়ে তাকে অঙ্ক করতে দেখি। প্রথম স্তবকে আছে—’ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর’। ঠিক এর পরের চরণেই আছে—’বাইরে দিদিমণির পাশে দিমিণির বর’। বরের রোমাঞ্চ যে কেমন হতে পারে, বেণীমাধবের বাঁশি কানে আসতেই তা অনুভবগম্য হয়েছে। দ্বিতীয় স্তবকে মেয়েটি বলেছে— ‘সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্ক ভুল করি’। খাতার অঙ্ক, প্রেমের অঙ্ক, জীবনের অঙ্ক সবই তখন ভুল হয়ে যায়।
রোমান্টিক আবেশ মুছে যায়। অতীত হারিয়ে যায়। সামনে এগিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাস বাস্তব কঠিন বর্তমান। তৃতীয় স্তবকে বর্তমানের মধ্যেও এসেছে অতীত প্রসঙ্গ। ঠিক তার আগে দুটে বাক্যে বেণীমাধবকে মেয়েটি দুটি প্রশ্ন ছুঁড়েছে। তাকে মনে পড়ে কিনা।
রোমান্টিক আবেশ মুছে যায়। অতীত হারিয়ে যায়। সামনে এগিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাস বাস্তব-কঠিন বর্তমান। তৃতীয় স্তবকে বর্তমানের মধ্যেও এসেছে অতীত প্রসঙ্গ। ঠিক তার আগে দুটি বাক্যে বেণীমাধবকে মেয়েটি দুটি প্রশ্ন ছুঁড়েছে। তাকে মনে পড়ে কিনা। আর এই প্রেমের কথা যে তার প্রেমিকাকে বলেছে কিনা। আর একটা প্রশ্ন উঁকি ! দেয়, সুলেখাই বেণীমাধবের প্রেমিকা নয়তো? ‘সুলেখা নামের সঙ্গে সৌন্দর্যের ভাব বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সুলেখা সুন্দরী। সে কালো। আর ঠিক তার পরেই বর্তমানের পাশে অতীত এসে থমকে দাঁড়ায়।
‘আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে: অপূর্ব সে আলো।
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।
বেণীমাধব আর তার প্রেমিকাকে ব্রীজের ধারে লুকিয়ে দেখে মেয়েটির মনে অদ্ভুত ভাবান্তর ঘটেছিল। সেই ভাবান্তরের পরিচয় আমরা দেখি পঞ্চম চরণে—’দেখেছিলাম আলোর নীচে: অপূর্ব সে আলো। সপ্তম চরণেও হৃদয়ের সেই ভাবোচ্ছ্বাস শব্দের ধ্বনিমাধুর্যে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে—‘জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ।
অতীতের সব স্বপ্ন এবং আশা তৃতীয় স্তবকের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেছে। শেষ স্তবকে সেলাই দিদিমণির নিঃসঙ্গতা ও বেদনাই বড়ো হয়ে উঠেছে। তার জীবনের অঙ্গ যে সব ভুল হয়ে গেছে, কবিতার শেষ চরণেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়—’কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই ?’ প্রথম স্তবকে ‘আমি’র চোখে ছিল প্রথম প্রেমের মায়া-কাজল, শেষ স্তবকের ‘আমি’র চোখে আছে বিরহ যন্ত্রণা। প্রথম স্তবকে ছিল স্বপ্ন। শেষ স্তবকে আছে কান্না। স্তবকে-স্তবকে কিশোরী নারীর প্রেমের ব্যর্থতা শৈলীগতভাবে কবিতায় তাৎপর্য লাভ করেছে। অধ্যাপক বিপ্লব চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘প্রেমিক ভুলে গেছে প্রেমিকাকে। অন্য প্রেমিকার সঙ্গে তার মিলন সুখময় হোক এ প্রার্থনা জেগেছে প্রণয়বঞ্চিতার মনে। তবুও যে ভুলে যায় নি। স্মৃতিভারে একা পড়ে থাকে। প্রেমিক চলে গেলেও তার প্রেম অটুট রয়েছে। প্রথম প্রেমের উন্মেষকালে সে অঙ্কে ভুল করত। জীবনের হিসাবের ক্ষেত্রে সে সেই ভুল করেনি। তাই তার পরের কোনও চোরাপথের বাঁকে হারিয়ে গেলেও সে যায় না। মনের মধ্যে তার আগুন জ্বলতে দেয় না। সে আগুন ক্ষোভের, দুঃখের বা হতাশার হতে পারে। সে আগুনে পুড়ে সে নিজেকে নষ্ট করে ফেলতে পারত। কিন্তু তার প্রেম এতই গাঢ় ও গভীর যে আগুন জ্বলে না। শুধুমাত্র ব্যথাদীর্ণ কণ্ঠে আজীবন বিরহাতুর মেয়েটি প্রশ্ন জোড়ে, ‘কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই? (একালের কবিতা শৈলী সম্মান)
Leave a comment