অথবা, মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলির বর্ণনা দাও।
অথবা, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলির সম্বন্ধে কী জান? লিখ।
ভূমিকাঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রেসিডেন্ট শাসিত দেশ। শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের শাসন সংক্রান্ত সকল কর্তৃত্ব প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত। এছাড়া তিনি আইন প্রণয়ন ও বিচার সংক্রান্ত কাজেও প্রভাব বিস্তার করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্পর্কে Brogan বলেছেন, “He is the formal head of the notion, he is also the effective head of the executive.”
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলিঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি অসাধারণ সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি একাধারে নৃপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্মান ও আসনের অধিকারী। এ সম্পর্কে ক্লিনটন রসিটার বলেছেন, “The president is the central figure in the American system.” নিম্নে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা করা হল-
শাসন বিভাগীয় ক্ষমতাঃ মার্কিন সংবিধানের ২নং ধারায় বলা হয়েছে, “All executive powers shall be vested in a president.” নিম্নেশাসন বিভাগীয় ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচিত হল-
১. আইন প্রয়োগ সংক্রান্তঃ সংবিধানের নির্দেশ অনুযায়ী সঠিকভাবে আইন প্রয়ােগ করা রাষ্ট্রপতির প্রধান কর্তব্য। এ গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য তিনি শাসন বিভাগের কর্মচারী এবং বিভিন্ন এজেন্সিতে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের সাহায্য নিয়ে থাকেন। এছাড়া তিনি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ‘National Laws’ প্রয়ােগ করতে পারেন।
২. নিয়ােগ সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ মার্কিন রাষ্ট্রপতি সিনেটের অনুমােদন সাপেক্ষে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী নিয়ােগ ও পদচ্যুত করতে পারেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্ৰীয় আদালতের বিচারক, কূটনৈতিক দূত, কেবিনেটের সদস্য, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের নিয়ােগ করতে পারেন।
৩. সামরিক ক্ষমতাঃ দেশের সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে রাষ্ট্রপতি দেশরক্ষা, সৈন্যবাহিনী গঠন, বিদেশে সৈন্য প্রেরণ, অন্যদেশ আক্রমণ ইত্যাদি সামরিক দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধাবসানের ব্যাপারেও রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা রয়েছে।
৪. যুদ্ধকালীন বিশেষ ক্ষমতাঃ যুদ্ধকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি নিয়মতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তিনি পণ্য প্রেরণ, যুদ্ধ প্রণালী, অস্ত্রশস্ত্র প্রয়ােগ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে একক ক্ষমতার অধিকারী।
৫. বৈদেশিক ক্ষমতাঃ সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি ‘Executive agreement’ এর মাধ্যমে রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্যিক প্রতিধিদের নিয়ােগ, অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের গ্রহণ, বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে।
৬. পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের সম্পর্কঃ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিচক্ষণ দৃঢ়চেতা ও দক্ষ প্রশাসন রাষ্ট্রপতির আসীন হলে কংগ্রেসের সাথে রাষ্ট্রপতির মতানৈক্যের পরিবর্তে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে।
৭. জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষমতাঃ দেশের সংকটকালীন পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের ভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়।
৮. চুক্তি সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ মার্কিন রাষ্ট্রপতির প্রশাসনিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া মার্কিন রাষ্ট্রপতি বৈদেশিক চুক্তিও সম্পাদন করেন। তবে সংবিধান অনুসারে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমােদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাক্ষরিত কোন চুক্তি কার্যকরী হয় না।
৯. আইন বিষয়ক ক্ষমতাঃ সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত থাকা সত্তেও বিভিন্নভাবে কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজকে প্রভাবিত করেন। নিচে রাষ্ট্রপতির আইন বিষয়ক ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করা হল-
১. কংগ্রেসে বাণী প্রেরণের ক্ষমতাঃ সংবিধানের ২নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি দেশের সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিত লিখিত বাণী প্রেরণ বা মৌখিকভাবে তথ্য পাঠিয়ে কংগ্রেসকে আইন প্রণয়নে সাহায্য করতে পারেন।
২. বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের ক্ষমতাঃ জরুরি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়ােজনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বা ‘Extra ordinary session’ আহ্বান করতে পারেন।
৩. ভেটো প্রয়ােগের ক্ষমতাঃ কংগ্রেসের পাসকৃত বিল রাষ্ট্রপতির কাছে এলে (ক) রাষ্ট্রপতি বিলে স্বাক্ষর দিতে পারেন, (খ) Veto দিতে পারেন এবং (গ) আটকে রাখতে পারেন ‘Pocket veto’ এর মাধ্যমে।
৪. দলীয় ব্যবস্থার সুবিধাঃ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন।
৫. শাসন বিভাগীয় আদেশ জারির ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস প্রণীত আইনের ফাঁকগুলাে পূরণ করার জন্য ‘Executive order’ বা ‘Ordinance’ জারি করতে পারেন।
বিচার বিভাগীয় ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি নিজের ইচ্ছায় বিচার বিষয়ক ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন। তিনিই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিযুক্ত করেন কিন্তু তিনি তাদেরকে পদচ্যুত করতে পারেন। তিনি অপরাধীদের দণ্ডাদেশ স্থগিত করতে পারেন এবং এ ব্যাপারে অন্য কারও সম্মতির প্রয়ােজন হয় না। তার বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা বর্ণনা করা হল-
১. তিনি দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে পারেন।
২. তিনি দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ড হ্রাস করতে পারেন।
৩, তিনি দণ্ডিত ব্যক্তিকে ক্ষমাও করতে পারেন।
৪. তিনি ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত অপরাধীকেও ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন।
অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতাঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতাও ভােগ করে থাকেন। রাষ্ট্রপতির সাথে কংগ্রেসের সম্পর্ক অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে খুব নিবিড়। রাষ্ট্রের বাজেট নীতিনির্ধারণে কোন সঠিক এজেন্সি না থাকায় কংগ্রেসকে রাষ্ট্রপতির উপর নির্ভর করতে হয়। রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের নিকট জাতীয় আয়-ব্যয় সংক্রান্ত সকল তথ্য এবং পরবর্তী আর্থিক বছরের জন্য আয়-ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব প্রেরণ করেন এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্বেই বাজেট কংগ্রেসে পেশ করা হয়। মূলত Budget Bureau এর সহায়তায় বাজেট ও হিসাব রক্ষা আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন বিভাগের আনুমানিক ব্যয়ের বরাদ্দ হ্রাস, বৃদ্ধি বা সংশােধন করতে পারেন।
অন্যান্য ক্ষমতাঃ এছাড়া রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন জনমত গঠন, চাকরির সুযােগ সুবিধা প্রদান এবং পৃষ্ঠপােষকতা করতে পারেন। রাষ্ট্রপতির অন্যান্য ভূমিকা নিতে বর্ণনা করা হল-
১. দলনেতা হিসেবেঃ কংগ্রেসের উভয় কক্ষে রাষ্ট্রপতির দলে প্রাধান্য থাকলেও দলনেতা হিসেবে রাষ্ট্রপতি কংগ্রে আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে নিজের অনুকূলে নিয়ন্ত্রণ বা হ্রাস করতে পারেন।
২. দলীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুঃ দলীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাষ্ট্রপতি দলীয় সদস্যদের শাস্তিদান বা পুরস্কৃত করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন।
৩. বিশ্ব নেতা হিসেবে ভূমিকাঃ অর্থনৈতিক সাহায্য ও সন্ধি, সামরিক জোট গঠন, রাজনৈতিক অগ্রগতি, পারমাণবিক শক্তির বিকাশ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ। এ কারণেই বিশ্বনেতা হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
৪. জাতীয় নেতা হিসেবে ভূমিকাঃ জাতির স্বার্থে মূর্ত প্রতীক, জাতির প্রতিভূ হিসেবে জাতির নিরাপত্তা ও সংহতি রক্ষায় রাষ্ট্রপতি দেশ ও জাতিকে সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন।
উপসংহারঃ উপযুক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বস্তুত একজন দক্ষ, যােগ্য ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হলে এবং সমকালীন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হবেন এবং যথেষ্ট মর্যাদা ভােগ করবেন তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং এককথায় বলা যায় যে, বর্তমান বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ন্যায় এত অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন পদমর্যাদা আর কেউ ভােগ করে না।
Leave a comment