উৎস: উদারনৈতিক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ তথা ঐতিহাসিক জে. এ. হবসন (J. A. Hobson) তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ – একটি সমীক্ষা’ (Imperialism: A Study) গ্রন্থে (১৯০২ খ্রি.) সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বক্তব্য: হবসন তার সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্বে বলেছেন, পুঁজিবাদের বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটির জন্যই সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে। অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে বণ্টন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব হবে না। হবসন বলেছেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা অধিক মুনাফা অর্জন করে মূলধন সঞ্চয় করে। ফলে মূলধনের পরিমাণ বাড়ে। এই বাড়তি মূলধন উপনিবেশের নতুন শিল্পে লগ্নির জন্য মূলধনিরা নিজের দেশের সরকারকে চাপ দেয়, আর তখনই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উপনিবেশ দখলের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করে।
মতের ব্যাখ্যা: [i] বাড়তি মূলধনের চাপের কারণে সাম্রাজ্য বা উপনিবেশ গড়ে ওঠে। মূলধনি শ্রেণি অতিরিক্ত মুনাফার লােভে পুঁজি অন্যত্র বিনিয়ােগের জন্য সচেষ্ট হয়। তারা নিজ রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা, নিতে বাধ্য করায়। [ii] উপনিবেশের কাঁচামাল ও বাজারের একচেটিয়া দখল নিয়ে মূলধনি শ্রেণি নিজেদের দেশে শিল্পের প্রসার ঘটাত এবং উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য অনুন্নত দেশগুলিতে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত। [iii] ধনবণ্টন নীতি মেনে মূলধনি শ্রেণির বাড়তি মূলধন দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করলে বা সমাজের উন্নয়নশীল কাজে মূলধনের বিনিয়ােগ ঘটালে সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টির জন্য বাড়তি চাপকে আটকানাে যাবে।
সমালােচনা:
-
ইউরােপে শিল্পবিপ্লবের পর শিল্প মালিকদের মূলধন স্ফীত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটায়—হবসনের এই মত সঠিক নয়। কারণ শিল্পবিপ্লবের আগের যুগেও সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব ছিল।
উদ্ভব: আধুনিক কালে উনবিংশ ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইটালির মতাে দেশগুলির আগ্রাসনমূলক বিদেশনীতির পরিণতি হিসেবে সাম্রাজ্যবাদের পুনরুখান ঘটে।
প্রবক্তা: লেনিন, হবসন প্রমুখ মার্কসীয় ভাবনার আলােকে সাম্রাজ্যবাদের যে তত্ত্ব পেশ করেছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প তত্ত্ব প্রচার করেন। সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প তত্ত্বের দুই মুখ্য প্রবক্তা হলেন ফ্রাঙ্ক (Frank) এবং ওয়ালারস্টাইন (Wallerstein)।
মূল বক্তব্য: এই বিকল্প তত্ত্ব অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদ হল আন্তর্জাতিক অসাম্য ও শােষণের এক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা। শিল্পবিপ্লবের ফলে বিশ্বে শিল্পোন্নত এবং অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য দেখা যায়। এই বৈষম্য ও শােষণমূলক ভূমিকা ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদকে সুদৃঢ় করেছে।
ব্যাখ্যা: [i] বিশ্বের শিল্পোন্নত অঞ্চলগুলি শিল্পে অনুন্নত অঞ্চলগুলিকে শােষণ করে চলেছে। [ii] এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমরিকার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, সস্তা শ্রম এবং রপ্তানি বাজার ইউরােপীয় দেশগুলিকে সাম্রাজ্য বিস্তারে আকৃষ্ট করে। [iii] সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প তত্ত্ব হিসেবে বেকার, আইনস্টাইন প্রমুখ উল্লিখিত Devil তত্ত্বে বলা হয়েছে বেসরকারি অস্ত্র উৎপাদকগণ অধিক মুনাফার লােভে যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবে সাহায্য করে থাকে। [iv] সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প তত্ত্ব হিসেবে বাস্তববাদী তত্ত্বে বলা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের মূল উৎস হল জাতীয় রাষ্ট্রগুলির আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা।
Leave a comment