মার্কসবাদের বিভিন্ন উৎস

কোন মতবাদ বা দর্শন স্বয়ংভূ হতে পারে না। সুনির্দিষ্ট একটি প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে যে-কোন চিন্তা বা দর্শনের সৃষ্টি হয়। মার্কসীয় দর্শনের সুনির্দিষ্ট পটভূমি বা উৎস রয়েছে। পূর্ববর্তী বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের সমাজতত্ত্ব, দর্শন ও অর্থশাস্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে মার্কস উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এই উপাদানগুলিকে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনুশীলন ও বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি মার্কসীয় দর্শনের ইমারত গড়ে তুলেছেন।

আমরা বর্তমানে যাকে মার্কসবাদ বলি তা হল সমাজ ও বিজ্ঞানের দীর্ঘ বিবর্তনের ফলশ্রুতি। মানুষের চেতনা, সংঘবদ্ধতা এবং মতাদর্শগত ধ্যান-ধারণার বিকাশের ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তার থেকেই মার্কবাদের সৃষ্টি হয়েছে। ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের মূলকথা’ The Fundamentals of Marxist Leninist Philosophy গ্রন্থে বলা হয়েছে: “The way for the emergence of Marxism was prepared by the whole social, economic, political and spiritual development of the man, especially by the development of the capitalist system, and contradictions inherent in that system, by the struggle between the proletariat and the bourgeoisie.”

লেনিনের মত: মার্কসবাদের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন লেখক নানা বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। তবে এক্ষেত্রে বিশিষ্ট মার্কসবাদী বিপ্লবী লেনিনের বক্তব্যই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য। মহামতি লেনিন তাঁর The Three Sources and Three Components of Marxism শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালার নাম মার্কসবাদ। জার্মান চিরায়ত দর্শন, ইংরেজী চিরায়ত অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসী সমাজতন্ত্র তথা সাধারণভাবে ফরাসী বিপ্লবী মতবাদ—মানবজাতির সবচেয়ে অগ্রসর তিনটি দেশে আবির্ভূত ঊনিশ শতকের এই তিনটি প্রধান ভাবাদর্শগত প্রবাহের ধারাবাহক ও প্রতিভাধর পূর্ণতাসাধক হলেন মার্কস।” লেনিন আরও বলেছেন : “ঊনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংরেজী অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসী সমাজতন্ত্র রূপে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারই হল মার্কসবাদ।” তাঁর নিজের কথায়: “His teachings arose as the direct and immediate continuation of the teachings of the greatest representatives of philosophy, political economy and socialism.”

মার্কসবাদের মৌলিক উৎস

বস্তুত, মার্কসীয় তত্ত্বের প্রধান প্রধান উপাদানগুলি সংগৃহীত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মানী, ব্রিটেন ও ফ্রান্স থেকে। মার্কস তাঁর ‘উদ্বৃত্ত মূল্য সংক্রান্ত ধারণা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে; শ্রেণী-সংগ্রাম, রাষ্ট্র ও বিপ্লব সংক্রান্ত ধারণা ফরাসী সমাজতন্ত্রবাদীদের কাছ থেকে এবং দ্বন্দ্ববাদ ও বস্তুবাদ সংক্রান্ত ধারণা লাভ করেছেন জার্মান ভাববাদী দার্শনিকদের কাছ থেকে। সুতরাং মার্কসবাদের তিনটি মূল উৎস হল ঊনবিংশ শতাব্দীর তিনটি আদর্শগত ধারা। এগুলি হল: 

  • (১) ইংরেজদের রাজনীতিক অর্থশাস্ত্র (British Political Economy), 

  • (২) ফরাসী সমাজতন্ত্র (French Socialism) এবং 

  • (৩) জার্মান দর্শন (German Philosophy)।

(১) ইংরেজদের রাজনীতিক অর্থশাস্ত্র

মার্কসবাদ অনুসারে “আর্থনীতিক ব্যবস্থাই হল বনিয়াদ, তার উপরেই রাজনীতিক উপরি-কাঠামো দণ্ডায়মান।” মার্কস তাই সবচেয়ে বেশী মনোযোগ দিয়েছেন আর্থনীতিক ব্যবস্থার অধ্যয়নে। তাঁর প্রধান রচনা ‘পুঁজি’-তে আধুনিক অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজের আর্থনীতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনা আছে। লেনিন বলেছেন: “মার্কসের পূর্বেকার চিরায়ত অর্থশাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিকশিত দেশে—ইংল্যাণ্ডে। আর্থনীতিক ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করে অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) ও ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo) মূল্যের শ্রমতত্ত্বের (labour theory of value) সূত্রপাত করেন। মার্কস তাঁদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি এ তত্ত্বকে আমূলরূপে, সুসিদ্ধ ও সুসঙ্গতরূপে বিকশিত করেন। তিনি দেখান যে, পণ্যের উৎপাদনে সামাজিকভাবে আবশ্যিক যে শ্রমসময় ব্যয় হয়েছে, তা দিয়েই তার মূল্য নির্ধারিত হয়।”

লেনিনের কথায়, “বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদেরা যেখানে দেখেছিলেন দ্রব্যের সঙ্গে দ্রব্যের সম্পর্ক, মার্কস সেখানে উদ্ঘাটিত করলেন মানুষে মানুষে সম্পর্ক। পণ্য বিনিময়ের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে বাজারের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদকের মধ্যে যোগাযোগ।….পুঁজির অর্থ এই যোগসূত্রের আরও বিকাশ : মানুষের শ্রমশক্তি পরিণত হচ্ছে পণ্যে।….শ্রমদিনের এক অংশ শ্রমিক খাটে তার পরিবারের ভরণপোষণের খরচা তোলার জন্যে (মজুরী), বাকী অংশটা সে খাটে বিনা মজুরীতে, সৃষ্টি করে পুঁজিপতির জন্য বাড়তি মূল্য….।”

আলেকজাণ্ডার গ্রে (Alexander Gray)-র মতানুসারে মার্কসের এই ‘উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বের’ (Theory of Surplus Value) উপর রিকার্ডো (Ricardo)-র প্রভাব বর্তমান। তা ছাড়া ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী রবার্ট ওয়েন (Robert Owen)-এর চরিত্রের উপর পরিবেশের প্রভাবতত্ত্ব এবং টমসন (Thomson) ও হগসকিন (Hodgskin)-এর ‘শ্রমিকই হল মূল্যের উৎস’–এর দ্বারাও মার্কস প্রভাবিত হয়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসের চিন্তাধারার উপর ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চেহারা-চরিত্র এবং অবশেষে পুঁজিবাদের পতনের বিষয়টি মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের মাধ্যমে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়েছে। মার্কস বিশেষ একটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অপরিহার্যতা ও অনিবার্যতার কথা বলেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এর অবশ্যম্ভাবী পতনের বিষয়েও আলোচনা করেছেন। তার ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই মার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি পর্যালোচনা করেছেন। আবার পুঁজিবাদী সমাজের চেহারা-চরিত্র ও পরিণতি পর্যালোচনার পরই মার্কস সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবির্ভাবের ঐতিহাসিক অনিবার্যতার কথা বলেছেন।

(২) ফরাসী সমাজতন্ত্র

ফরাসী সমাজতন্ত্র মার্কসবাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে গণ্য হয়। মার্কসের শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্বে (Theory of class-struggle) ফরাসী সমাজতন্ত্রবাদীদের প্রভাব অনস্বীকার্য। মার্কস নিজেই স্বীকার করেছেন: “বর্তমান সমাজে শ্রেণীর অস্তিত্ব এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার প্রাপ্য নয়। আমার অনেক আগেই বুর্জোয়া ঐতিহাসিকগণ শ্রেণী-দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ্‌গণ শ্রেণীসমূহের আর্থনীতিক গঠন ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন।” তবে মার্কস বলেছেন যে, “আমি যা নতুন করেছি তা প্রমাণ করা যে, 

  • (১) উৎপাদনের বিকাশের এক বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরের সঙ্গেই কেবল শ্রেণীর অস্তিত্ব যুক্ত; 

  • (২) শ্রেণী-সংগ্রাম অপরিহার্যভাবেই সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে এগোয়; 

  • (৩) এই একনায়কত্ব শ্রেণীসমূহের বিলুপ্তি ঘটায় ও শ্রেণীহীন সমাজের সৃষ্টি করে।”

ক্যাবের প্রভাব: এঙ্গেলসের মতানুসারে অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিকগণ যে সমাজতান্ত্রিক নীতি বিশ্লেষণ করেন তারই যুক্তিনিষ্ঠ সম্প্রসারণ হল আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদ। ফ্রান্সের পুরাতন ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। এই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ফরাসী সমাজতন্ত্রবাদীদের দৃষ্টি ছিল কঠোর সমালোচনামূলক। ফরাসী সাম্যবাদী চিন্তাবিদ ক্যাবে (Etienne Cabet) কর্তৃক প্রচারিত সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ মার্কসকে প্রভাবিত করেছে। ক্যাবে সাম্যবাদী সমাজে সমস্ত অত্যাবশ্যক কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত করেছেন। মার্কস কিন্তু রাষ্ট্রের অবলুপ্তির কথা বলেছেন।

সী-সিমোঁ: সাঁ-সিমোঁ (St. Simon) কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের এক উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা। তিনি এক বিশেষ সমাজতান্ত্রিক সমাজের কল্পনা করেছেন। এই সমাজের লক্ষ্য হবে সকলের কল্যাণসাধন করা এবং সচেতন ও যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে প্রাচুর্য সৃষ্টি করা। এই সমাজে সাঁ-সিমোঁ মানুষের চাহিদা ও সামর্থ্যের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামর্থ্যের বিকাশ ও চাহিদা পূরণের জন্য সর্বাধিক সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেছেন। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুখী জীবন সম্ভব করে তোলার কথা বলেছেন। প্রত্যেকে নিজের সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে এবং কাজ অনুসারে প্রাপ্য পাবে। সমাজের সকল কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে সরকারের উপর। কিন্তু তিনি শ্রেণী-সংগ্রাম ও বিপ্লবের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। নাগরিকদের মধ্যে তিনি সম্প্রীতি সৃষ্টির পক্ষপাতী ছিলেন। যাবতীয় শোষণ ও অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে একটি শোষণহীন মানব সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপারে সমাজতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্কিত সাঁ সিমোঁর ধারণা মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করেছে।

তবে সাঁ-সিমোঁ তাঁর সমাজতান্ত্রিক সমাজের পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমাজ বিকাশের বস্তুগত ভিত্তিকে উপেক্ষা করেছেন। তিনি শাসক ও শাসিতের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলেছেন। কিন্তু তা বাস্তবে অসম্ভব। সাঁ-সিমোঁর সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার পদ্ধতি নিতান্তই অবাস্তব।

ফুরিয়ে: ঊনবিংশ শতাব্দীর আর একজন কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবিদ হলেন ফুরিয়ে (Feurier)। বুর্জোয়া সমাজের শোষণমূলক চেহারা-চরিত্রকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। দরিদ্র ও সংবেদনশীলদের স্বার্থের সমন্বয়ের কথা তিনি বলেছেন। তিনি বৈপ্লবিক রূপান্তরের পক্ষপাতী ছিলেন না। তার পরিবর্তে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সমন্বয় সাধনের কথা বলেছেন। তাঁর কল্পিত সমাজে ব্যক্তিগত ও পুঁজিপতিদের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন এবং সমাজতান্ত্রিক ধারণার বিকাশের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে। উৎপাদনী সংঘের সমন্বয়ের ভিত্তিতে এই সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠবে। তবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্কিত ফুরিয়ের চিন্তা-ভাবনাও কাল্পনিক ছিল।

টমাস ম্যুর: টমাস ম্যুর (Thomas Moore) এর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হল ইউটোপিয়া (Utopia) এই গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং সংখ্যাগুরু মানুষের দ্বারা উৎপাদিত শ্রম-সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে যতদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীভূত থাকবে, ততদিন সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য, সুখ এবং মানুষের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ অসম্ভব। ম্যুর এর প্রতিকারের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। প্রতিকারের বিভিন্ন উপায়ের কথা তিনি কল্পনা করেছেন। তিনি ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ সাধনের কথা বলেছেন। তিনি এক বিশেষ সমাজের কল্পনা করেছেন। এই সমাজ শাসিত হবে যৌথ শ্রম, যৌথ মালিকানা এবং গণতান্ত্রিক নীতি অনুসারে।

ওয়েন: রবার্ট ওয়েন (Robert Owen, 1771-1858)-ও হলেন একজন কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিক। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে নতুন সমাজ গড়ে তোলার পথে বড় বাধা হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সমষ্টিগত শ্রম ও মালিকানার উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ওয়েন বিপ্লব ও শ্রেণী-সংগ্রামকে সমর্থন করেননি। তিনি সংস্কারের উপর জোর দিয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে অসঙ্গতির প্রধান কারণ হিসাবে তিনি মানুষের ভুল-ভ্রান্তি ও অজ্ঞতার কথা বলেছেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত ও প্রসারিত করতে পারলে মানুষকে নতুন সমাজ গঠনের কাজে পরিচালনা করা যাবে।

ওয়েন নিজে একজন কারখানা মালিক ছিলেন। তিনি ঘোষণা করেন: ‘A social question de – manded a social answer’। তিনি একটি আদর্শ কারখানা গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। তাঁর আদর্শ কারখানাটির নাম ছিল ‘New Lanark’। কারখানার শ্রমিকদের স্বার্থে তিনি সাম্যবাদী ব্যবস্থা চালু করেন। শিল্পক্ষেত্রে তিনি মালিক শ্রেণীর শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে তিনি অবাধ প্রতিযোগিতার বিরোধিতা করেছেন। কারখানার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে স্বীকার করেছেন। শ্রমিক কল্যাণের জন্য তিনি কতকগুলি সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এ সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শ্রমিকদের আবাসন নির্মাণ, দৈনিক কাজের সময় দশ ঘণ্টায় বেঁধে দেওয়া, ভোজনালয়ের ব্যবস্থা, দশ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধকরণ, শ্রমিকদের জরিমানা বাতিলকরণ প্রভৃতি। শিল্পবিপ্লবোত্তর ইংল্যান্ডে ওয়েনপন্থী আন্দোলনের প্রভাবে শ্রমিকপন্থী বেশ কিছু ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

রবার্ট ওয়েনের সাম্যবাদী চিন্তার প্রভাব ইংল্যান্ডের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবিত করে। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ফ্রান্সের শাঁ সিম (St. Simon), লুই ব্ল্যাঙ্ক (Louis Blanc), চার্লস ফুরিয়ে (Charles Fourier), প্রুধো (Prondhon), রুশো (Rousseau) প্রমুখ। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের সাম্যবাদের মধ্যে কার্যকারণভিত্তিক সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। এঁদের সাম্যবাদী চিন্তাধারা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এই কারণে এঁদের ‘কাল্পনিক সাম্যবাদী’ (Utopian Socialist) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে এঁদের ধ্যান-ধারণা থেকেও কার্ল মার্কস ও অন্যসব সাম্যবাদীরা চিত্তার সূত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে পেয়েছেন।

কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের তাৎপর্য

টমাস ম্যুর, সাঁ-সিমোঁ, ফুরিয়ে, ওয়েন প্রমুখ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের আমলে পুঁজিবাদের অবস্থা ছিল অপরিণত। পুঁজিবাদের চেহারা-চরিত্রের পরিপূর্ণ প্রকাশ তখনও ঘটেনি। শ্রেণী-সম্পর্কের পরিস্থিতিও ছিল। অপরিণত। কারণ তখনও প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী সংঘাত সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়নি। এই রকম এক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদের কিছু সহজাত সমস্যার সমাধানের স্বার্থে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের পক্ষপাতী কিছু চিন্তাবিদ এক কাল্পনিক সমাজব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরেন। পুঁজিবাদী সমাজ সঞ্জাত সামাজিক অন্যায়ের অপসারণের উদ্দেশ্যে তাঁর যুক্তির উপর জোর দেন। মার্কস-এঙ্গেলস কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের অবদানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে উপেক্ষা করেননি। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে মার্কস-এঙ্গেলস কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের তাৎপর্য পর্যালোচনা করেছেন। ঐতিহাসিক পটভূমিতে তাঁরা কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকার মূল্যায়ন করেছেন। পুঁজিবাদী সমাজের শ্রেণী-বিরোধ সম্পর্কে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা অবহিত ছিলেন। তাঁরা পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক উপাদান এবং আনুষঙ্গিক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তাঁরা সমকালীন সমাজের ত্রুটিপূর্ণ নীতিগুলির বিরূপ সমালোচনা করেছেন। মেহনতী মানুষের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমালোচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই সমাজতন্ত্রীরা সর্বহারা শ্রেণীর সংগঠিত ভূমিকার পরিবর্তে নিজেদের কথিত সমাজব্যবস্থার উপর আস্থা প্রকাশ করেছেন। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার বদলে তাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগের উপর জোর দিয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজের সমস্যাদির সমাধানের ব্যাপারে তাঁরা যে উপায়-পদ্ধতি নির্দেশ করেছেন তা নিতান্তই কাল্পনিক। তাঁরা বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সংস্কারের পথে উদ্দেশ্য সাধনের কথা বলেছেন। তাঁরা সমকালীন সমাজের সকলের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থকেও তাঁরা অবহেলা করেননি। তাই তাঁরা সুবিধাভাগী শাসকশ্রেণী-সহ পুঁজিবাদী সমাজের সকলের কাছে আবেদন করেছেন। এঁরা নিজেদের সমাজের শ্রেণী-বিরোধের ঊর্ধ্বে বলে বিবেচনা করতেন। তবে সমকালীন পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের চিন্তা-ভাবনাকে অবহেলা করা যায় না। লেনিন-এর অভিমত অনুসারে এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রা বহু ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তা ও আলোচনা করেছেন। এই আলোচনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য পরবর্তী কালে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

(৩) জার্মান দর্শন

হেগেলের প্রভাব: জার্মান দর্শন হল মার্কসবাদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস। চিরায়ত জার্মান দর্শনের দ্বারা মার্কস বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। দ্বন্দ্ববাদ‌ সম্পর্কে মার্কসের ধারণা হেগেল থেকে নেওয়া। হেগেলের মত মার্কস বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বের সকল পরিবর্তন দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতিতে ঘটে। লেনিন বলেছেন : “বিকাশের সবচেয়ে সর্বাঙ্গীণ, সবচেয়ে বিষয়সমৃদ্ধ এবং সবচেয়ে সুগভীর মতবাদ হিসাবে হেগেলীয় দ্বান্দ্বিক তত্ত্বকে মার্কস ও এঙ্গেলস ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করতেন।” মার্কসের মতানুসারে বাহ্যিক জগতের মানুষের চিন্তার গতির সাধারণ বিধির বিজ্ঞানকে দ্বন্দ্ববাদ বলে। হেগেলীয় দর্শনের এই বৈপ্লবিক দিকটি মার্কস ও এঙ্গেলস গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁরা দ্বন্দ্ববাদকে হেগেলের ভাববাদী জগৎ থেকে পুরোপুরি মুক্ত করেছেন এবং প্রকৃতির বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় দ্বন্দ্ববাদকে প্রয়োগ করেছেন।

ফয়েরবাখের প্রভাব: মার্কসীয় দর্শন কেবল দ্বন্দ্বমূলক নয় বস্তুবাদীও বটে। লেনিন বলেছেন: “অষ্টাদশ শতাব্দীর বস্তুবাদেই মার্কস থেমে যাননি, দর্শনকে তিনি অগ্রসর করে গেছেন। এ দর্শনকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন জার্মান চিরায়ত দর্শনের সম্পদ দিয়ে, বিশেষ করে হেগেলীয় তন্ত্র দিয়ে, যা আবার পৌঁছেছে ফয়েরবাখের বস্তুবাদে।” বস্তুবাদী আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কস ও এঙ্গেলস প্রায়ই দার্শনিক ফয়েরবাখের (Ludvig Feuerbach) উল্লেখ করেছেন। তবে মার্কস ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদ এক নয়। ফয়েরবাখ ছিলেন নৃতাত্ত্বিক বস্তুবাদের সমর্থক। তিনি হেগেলের ভাববাদকে গ্রহণ করেননি। কিন্তু ফয়েরবাখের বস্তুবাদ সর্বাঙ্গীণ এবং সুসঙ্গত প্রতিপন্ন হয়নি। ফয়েরবাখের এই সীমাবদ্ধতা মার্কসের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। স্তালিন বলেছেনঃ “বস্তুত মার্কস ও এঙ্গেলস ফয়েরবাখের বস্তুবাদের অন্তর্নিহিত সারাংশটুকু গ্রহণ করেছেন ও তা বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক সিদ্ধান্তে বিকশিত করেছেন এবং তার আনুষঙ্গিক ভাববাদী এবং ধর্ম ও নীতি সম্পর্কিত জঞ্জালকে বর্জন করেছেন।” মার্কস ও এঙ্গেলস দ্বন্দ্ববাদকে বস্তুজগতের বিশ্লেষণে প্রয়োগ করেছেন। তাই তাঁদের দর্শন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। মার্কস বস্তুবাদী দর্শনের ধারণাকে অধিকতর ব্যাপকভাবে এবং উন্নততর পর্যায়ে মানবসমাজের বিশ্লেষণে প্রয়োগ করেছেন। মানবসমাজের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী দর্শনের এই প্রয়োগকে সংক্ষেপে বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। লেনিন বলেছেন : “বৈজ্ঞানিক চিন্তার সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকীর্তি হল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।”

মার্কসবাদ বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত: মার্কসীয় দর্শনের উপাদানসমূহ বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত। অনেকে তাই মার্কবাদের মৌলিকত্ব স্বীকার করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। তবে এই দ্বিধা নেহাতই অমূলক। এক্ষেত্রে আলেকজাণ্ডার গ্রে (Alexander Gray)-র মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর The Socialist Tradition গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “It is doubtless true that the component parts of Marxian thought can be traced to a multitude of sources. He collected his bricks from many masons, yeards, but he used them to construct a building which was very much according to his own design.” মার্কস তাঁর পূর্বসূরীদের চিন্তা-চেতনা থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু সংগৃহীত উপাদানগুলিকে তিনি পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এবং মার্কসীয় দর্শন গড়ে তুলেছেন। লেনিন (V. I. Lenin) বলেছেন: “His teachings arose as a direct and immediate continuation of the greater representatives of philosophy, political economy and socialism.

উপসংহার: মার্কসবাদ হল একটি সামগ্রিক চিন্তাভাবনা—নির্দিষ্ট কোন একটি জ্ঞান-শৃঙ্খলা নয়। তাই লেনিন যথার্থই বলেছেন যে মার্কসীয় দর্শনের পটভূমি হিসাবে নানা ধরনের মানবশাস্ত্রের (humanities) প্রভাব বর্তমান। লেনিন যে তিনটি মূল উৎসের উল্লেখ করেছেন, সেগুলি ছাড়াও ইতিহাস, শিল্পকলা, সাহিত্য, গণিত ও বিভিন্ন প্রকৃতি-বিজ্ঞানের অবদান মার্কসীয় চিন্তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যাইহোক্ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কসবাদের উৎস বলতে মার্কসীয় দর্শনের একেবারে প্রাথমিক সোপানগুলিকেই বোঝান হয়। চূড়ান্তভাবে মার্কসবাদ যে উন্নততর সোপানে উপনীত হয়েছে তার সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে প্রাথমিক সোপানগুলি নগণ্য প্রতিপন্ন হয়।