মার্কসবাদ কি—এক কথায় এর জবাব দেওয়া সহজ নয়। তবে লেনিন (V.I. Lenin)-কে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালাই হল মার্কসবাদ। লেনিন বলেছেন: “Marxism is the system of the views and teachings of Marx.” কার্ল মার্কসই মার্কসবাদের প্রধান রূপকার। অসামান্য বিনয়ী এঙ্গেলসও বার বার একথা বলেছেন। মার্কস একটি মৌলিক ব্যবহারিক দর্শন (Philosophy of Praxis) গড়ে তোলার জন্য সারা জীবন ধরে আত্মত্যাগ করেছেন। ইতিহাসে তা এক বিরল উদাহরণ। তবে এঙ্গেলসকে বাদ দিয়েও মার্কসবাদকে ভাবা যায় না। মার্কসের কর্মজীবনে এঙ্গেলস বৌদ্ধিক সহযোগিতা যেমন করেছেন, তেমনি আপদে-বিপদে সহায়-সুহৃদ হয়ে সতত উপস্থিত থেকেছেন।

মার্কসবাদের শব্দটির ব্যবহার: মিলিব্যাণ্ড (Ralph Miliband) তাঁর Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে কার্ল মার্কস-এর জীবদ্দশায় ‘মার্কসবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। মার্কস নিজে কখনই ‘মার্কসবাদ’ শব্দটি প্রয়োগ করেননি। মার্কস-এর মৃত্যু হয় ১৮৮৩ সালে। এর পরেও এঙ্গেলস দীর্ঘ বার বছর বেঁচেছিলেন। তিনি মার্কসবাদ কথাটির ব্যবহার শুরু করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসবাদ বলতে যে সুসংবদ্ধ চিন্তাধারাকে বোঝায় তা পাওয়া যায় মার্কসের মৃত্যুর পরে। মার্কসের ধ্যান-ধারণা, মতবাদসমূহকে প্রণালীবদ্ধ করে ব্যাপকতর বীশ্ব বীক্ষ্যা হিসাবে সুসম্বদ্ধ রূপ দিয়েছেন এবং ক্রমবদ্ধমান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রয়োজন পূরণের উপযোগী করেছেন কয়েকজন। এঁরা হলেন মার্কসের আজীবন বন্ধু ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস (Engels), জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা কার্ল কাউটস্কি (Karl Kautsky) এবং রুশ তাত্ত্বিক প্লেখানভ (Plekhanov)। এঙ্গেলসের লেখা ‘অ্যান্টি ডুরিং’ (Anti-Duhring) প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। মার্কস তখনও জীবিত। এঙ্গেলসের এই রচনাটিকে অনেক সময় মার্কসবাদের দৃঢ় নিষ্ঠার পরিচায়ক প্রথম রচনা হিসাবে গণ্য করা হয়। কার্ল মার্কসের বক্তব্যের প্রামাণ্য বা কর্তৃত্বমূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে ‘অ্যান্টি ডুরিং’-এ। প্লেখানভ প্রথম ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ (dialectical materialism) কথাটি ব্যবহার করেন। মার্কস এই কথাটি ব্যবহার করেননি। দৃঢ়নিষ্ঠ গোঁড়া মার্কসবাদকে প্রায়শই ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই পূর্বতন সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শের ভিত্তি রচনা করেছে।

পরবর্তীকালে লেনিন মার্কসবাদ কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। লেনিন প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর উত্তরসূরীরা ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ শব্দটির ব্যবহার শুরু করেন। মার্কসীয় তত্ত্বের সৃজনশীল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ এবং মার্কসবাদের প্রসারের ক্ষেত্রে লেনিনের অবদান ব্যক্ত করার জন্য ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।

মার্কসের মার্কসবাদ: কার্লমার্কসের রচনাসমূহের গভীরতা ও ব্যাপ্তি ব্যাপক। আবার মার্কসের আলোচনাগুলি অনেকাংশে জটিল প্রকৃতির। স্বভাবতই মার্কসের মার্কসবাদ সম্পর্কিত জটিলতা অনস্বীকার্য। আবার মার্কসের জীবনের গোড়ার দিককার রচনা এবং শেষের দিককার রচনাসমূহের মধ্যেও পার্থক্য করা হয়। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকের অভিমত অনুযায়ী যুবা বয়সের মার্কসের সঙ্গে পরিণত বয়সের মার্কসের বক্তব্যের মধ্যে অল্পবিস্তর ব্যবধান বর্তমান। অনেকের কাছে মার্কসের মার্কসবাদ হল ‘আর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণবাদ’ (economic determinism)। আবার অন্য আর একজন চিন্তাবিদের কাছে মার্কসবাদ হল মানবতাবাদী সমাজতন্ত্রবাদ। মার্কস নিজে বিশ্বাস করতেন যে, নতুন স্বরূপের এক সমাজতন্ত্রবাদকে তিনি বিকশিত করেছেন। এই সমাজতন্ত্রবাদ বিজ্ঞানসম্মত। কারণ সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিকাশের প্রকৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গেই এই সমাজতন্ত্রবাদ প্রাথমিকভাবে সম্পর্কিত। পুঁজিবাদের বিরূপ সমালোচনা এই সমাজতন্ত্রবাদের মূল কাজ নয়।

সমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব: এমিল বার্নস বলেছেন “মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ, মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব। এর নামকরণ করা হয়েছে কার্ল মার্কসের নামানুসারে।” মার্কসবাদ হল একটি সঠিক সমাজ-দর্শন, একটি সামগ্রিক চিন্তাধারা। মার্কসবাদ হল দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এটি একটি সামগ্রিক তত্ত্বচিন্তা। যে-কোন জ্ঞান শৃঙ্খলাতেই এর প্রয়োগ সম্ভব। একে আলাদা করে কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা অর্থনীতি বা ইতিহাস বা দর্শনের তত্ত্ব বলা যায় না। মনীষী মার্কস তাঁর পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও সুত্রাদিকে নিজের চিন্তা-চেতনা ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এবং এইভাবে একটি বিশ্ববীক্ষ্যার ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। এ হল মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষ্যা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষ্যা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বৈপ্লবিক তত্ত্ব হিসাবে পরিচিত। লেনিনের অভিমত অনুসারে এই মার্কসবাদ হল মহাশক্তিমান। কারণ এই মতাবাদ হল বিশ্বাসযোগ্য।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র: মার্কস ও এঙ্গেলস মানবসমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করেছেন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এঁদের মতানুসারে সামাজিক পরিবর্তন কোন আকস্মিক ব্যাপার নয়। সামাজিক পরিবর্তন বহিঃপ্রকৃতির পরিবর্তনের মত কয়েকটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে। মার্কস এই সত্যের ভিত্তিতে সমাজ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ গড়ে তুলেছেন। মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর এই মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। এমিল বার্নসের মতে, “মানুষ ও জড় পদার্থ—উভয়ের ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য নিয়মগুলিকে আশ্রয় করেই মার্কসীয় বা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি রূপায়িত হয়েছে।”

প্রলেতারিয়েতের মতাদর্শ: মার্কস বিশ্বাস করেছেন যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে মানবসমাজকে অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান সমাজকে পরিবর্তনের কাজেও ব্যবহার করা যায়। মার্কস-এর মতে দার্শনিকগণ এ যাবৎ পৃথিবীকে বিভিন্নভাবে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কথা হল এই পৃথিবীটাকে (সমাজব্যবস্থাকে) পাল্টে দেওয়া। তিনি বলেছেন: “Philosophers have so far only interpreted the world in many ways, the point, however, is to change it.” মার্কসবাদের মহান ঐতিহাসিক কীর্তি হল এই যে মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতনের অনিবার্যতা এবং নতুন সমাজব্যবস্থা বা শোষণ-পীড়ন থেকে মানবজাতির মুক্তির পথ অর্থাৎ সাম্যবাদের পথ উদ্ঘাটন করেছেন। এ দিক থেকে মার্কসবাদ হল সর্বহারা শ্রেণী বা প্রলেতারিয়েতের মতাদর্শ; তাদের মৌলিক স্বার্থের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।

মানবসমাজ ও সভ্যতার সত্যনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা: আগেকার কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের ধারাকে কার্ল মার্কস অনুসরণ করেননি। তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের (Historical Materialism) মাধ্যমে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। দ্বান্দ্বিকতা ও ভৌতবিজ্ঞানসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উপর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠিত। এই কারণে মার্কসবাদ হল বৈজ্ঞানিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত মানবসমাজের এক বিশ্বাসযোগ্য পর্যালোচনা। এই পর্যালোচনা ভাববাদের নিয়ন্ত্রণযুক্ত এবং বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। মার্কসবাদ হল মানুষের বৌদ্ধিক অগ্রগতির এক সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং মানবসমাজের ক্রমবিকাশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। সুতরাং মার্কসবাদ হল মানব সমাজ ও মানব জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত এক সত্যনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা।

প্রায়োগিক মতামত: মার্কসবাদ হল একটি প্রায়োগিক মতবাদ। মার্কস শোষিত সর্বহারা শ্রেণীর জীবনধারার মৌলিক পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্যে তার মতাদর্শটি উপস্থাপিত করেছেন। মার্কসবাদ পৃথিবীর উপর আর একটি নিছক তত্ত্বের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই তত্ত্বে এই পৃথিবীর সমাজব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয় যে, দর্শনের সঙ্গে তত্ত্বের এবং তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের যোগাযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। এর মধ্যেই যে-কোন রাজনীতিক তত্ত্বচিন্তার গুরুত্ব নিহিত থাকে। মার্কসবাদে এই যোগাযোগের বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। মার্কসবাদে তত্ত্ব ও প্রয়োগের বা চিন্তা ও কর্মের ওতপ্রোত সম্পর্কটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

দ্বান্দ্বিক নীতি: লেনিনের মতে ‘মার্কসবাদ সত্য তাই এ সর্বশক্তিমান’। এমিল বার্নস বলেছেন : “মার্কসবাদ স্বীকৃতি দাবি করে সত্য হিসাবে, কোন বিমূর্ত নৈতিক সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে নয়। যেহেতু তা সত্য, তাই আজকের পৃথিবীর সকল দুঃখ-অভিশাপের ত্রাস থেকে মানবতাকে মুক্তিদানের কাজে মার্কসবাদকে প্রয়োগ করা সম্ভব এবং কর্তব্য।” মার্কসবাদ বস্তুগত অস্তিত্বের উপর জোর দেয়। তাই মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক নীতিকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) বলা হয়। মার্কস বলেছেন সত্তাই চেতনাকে নির্ধারিত করে; চেতনা সত্তাকে নির্ধারিত করে না (Being determines consciousness, not the other way round.)। মার্কসের মতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুর মধ্যেই একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্তমান। এই দ্বান্দ্বিকতার অর্থ হল দুটি বিরোধী শক্তির মধ্যে অনবরত সংঘাত ও মিলনের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রতিটি বিষয়ের চরিত্র প্রকাশ পায়। মার্কসবাদ অস্তিত্ব সম্পর্কিত এই দ্বান্দ্বিক বিচারকে সার্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছে। মানুষ ও জড় পদার্থ নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য নিয়মগুলিকে ভিত্তি করে মার্কসীয় দর্শন বা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে।

মার্কসবাদ নিয়ত বিকশিত হচ্ছে: মার্কসবাদ হল একটি জীবন্ত বিপ্লবী শিক্ষা। এই শিক্ষা নিয়ত বিকশিত ও উন্নত হচ্ছে। নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করছে। প্রকৃতি ও সমাজের বিকাশ সম্পর্কিত নিয়মের বিজ্ঞান হিসাবে বা বিশ্বের বিপ্লবী রূপান্তরের বিজ্ঞান হিসাবে মার্কসবাদ থেমে থাকতে পারে না। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর মৃত্যুর পর লেনিন মার্কসবাদকে নতুন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে প্রয়োগ ও অগ্রসর করার মহান দায়িত্ব পালন করেন। মার্কসের মৃত্যুর পর শতবর্ষ অতিক্রান্ত। এখনও মার্কসবাদ নিয়ে বিতর্ক ও বিচার চলছে। কারণ মার্কসীয় দর্শন-চিন্তার নিয়মিত বিকাশ ঘটেছে। প্রত্যেক যুগে লেনিন বা মাও, রোজা লুক্সেমবর্গ বা কার্ল করশ, স্তালিন বা ট্রটস্কি, লুকাচ বা গ্রামূসি প্রভৃতি বিভিন্ন বিপ্লবী তাত্ত্বিক টীকা-ভাষ্য সংযোজনের মাধ্যমে মার্কসবাদের ক্রমবিকাশ অব্যাহত রেখেছেন। শুধুমাত্র মার্কস ও এঙ্গেলস-এর ভাবনা চিন্তা ও রচনার মধ্যেই মার্কসবাদ সীমাবদ্ধ নয়। মার্কস-এঙ্গেলস-এর উত্তরসূরীদের সৃজনশীল রচনা ও চিন্তা-চেতনা মার্কসবাদকে অধিকতর বিকশিত করেছে। উত্তরসূরীদের ব্যাখ্যা, ভাষ্য ও মতামত মার্কসীয় তত্ত্বকে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে ; এক নতুন মাত্রা সংযুক্ত করেছে। সুতরাং এ সবও মার্কসবাদের অন্তর্ভুক্ত।

মার্কসীয় তত্ত্ব কোন যান্ত্রিক মতবাদ নয়: বিশ্বের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে বিভিন্নভাবে মার্কসীয় তত্ত্বকে প্রয়োগ করা হয়েছে। তারফলে মার্কসবাদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিন্যাসের সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় মার্কসবাদের প্রকৃত অর্থ প্রসঙ্গে মানুষের মনে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া নিকট অতীতে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক সরকারসমূহের তথা কমিউনিস্ট দলের পতন ঘটেছে। সর্বোপরি পৃথিবীর প্রথম ও বৃহত্তম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট সরকার ও দলের পতন ঘটেছে। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদী শক্তির দাপট শুরু হয়েছে। এই রকম এক অবস্থায় অনেকে মনে করতে শুরু করেছেন যে বর্তমানে মার্কসবাদ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ ধারণা যথার্থ নয়। মার্কসবাদকে একটি যান্ত্রিক তত্ত্ব হিসাবে প্রতিপন্ন করা ঠিক নয়। যান্ত্রিকভাবে এই তত্ত্বের প্রয়োগও সম্ভব নয়। মার্কস এ রকম কথা কখনও বলেননি। মার্কসবাদ হল মানবসমাজের ক্রমবিকাশের মৌলিক নীতি বা বিধির এক বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা। ঐতিহাসিক অবস্থার উপর এর প্রয়োগ নির্ভরশীল। সমকালীন ঐতিহাসিক অবস্থাকে অবজ্ঞা করে মার্কসীয় তত্ত্বের যান্ত্রিক প্রয়োগ নিতান্তই অবাস্তব ও অর্থহীন। এমিল বার্নস (Emil Burns)-এর অভিমত অনুসারে কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অধিকতর অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়। এবং এর ফলে মার্কসবাদও অধিকতর সমৃদ্ধ হয়। একটি তত্ত্ব হিসাবে মার্কসবাদের উপর কোন সীমারেখা আরোপ করা হয়নি। মার্কসবাদ হল অবিরাম বিকাশমান একটি গতিশীল তত্ত্ব। মার্কসবাদ বলতে অনড় অচল কোন মতাদর্শকে বোঝায় না। মার্কসীয় তত্ত্বের মধ্যে যুক্তিহীন কোন অন্ধবিশ্বাসের স্থান নেই। মার্কসবাদ কেবল একটি তত্ত্বমাত্র নয়; এ হল সামাজিক কার্যপ্রক্রিয়ার পথ-নির্দেশক এক অভিজ্ঞান।