লেনিনবাদ কাকে বলে?
মার্কসবাদ হল একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ, একটি গতিশীল তত্ত্ব। মার্কস ও এঙ্গেলস্-এর পরবর্তীকালে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মার্কসবাদকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে লেনিনের (Vladimir lyich Lenin) অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ মিলেমিশে গিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ রূপান্তরিত হয়। সমাজের বিকাশ সম্পর্কিত মার্কস ও এঙ্গেলসের মৌলিক সূত্রগুলিকে লেনিন ব্যাখ্যা ও বিকশিত করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি মার্কসবাদ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের মূলকথা’ (The Fundamentals of Marxist-Leninst Philosophy) গ্রন্থে বলা হয়েছে: “Lenin developed Marxism in the new historical conditions, in the epoch of capitalism’s development into its final imperialist stage, the epoch that was to see the emergence of the new, socialist society.” এক্ষেত্রে স্ট্যালিনের Foundation of Leninism শীর্ষক গ্রন্থের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। স্ট্যালিনের মতে, লেনিনবাদ মার্কসবাদকে পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং আরও বিকশিত করেছে, পুঁজিবাদ ও শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদকে পরিবর্ধিত করেছে। তাই লেনিনবাদকে সাম্রাজ্যবাদ এবং শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ বলা হয়। স্ট্যালিন বলেছেন: “Leninism is Marxism of the era of imperialism and proletarian.” মার্কসীয় বিশ্বদৃষ্টির উপর গভীর আস্থার ভিত্তিতে লেনিন মার্কসবাদকে অধিকতর বিকশিত করেছেন। মার্কসবাদের পূর্বাবর্তন ও অধিকতর বিকশিত রূপ হল লেনিনবাদ। লেনিনের জীবনদর্শন ও রচনাবলীর মধ্যে মার্কসীয় তত্ত্বের পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। সাম্রাজ্যবাদের যুগে মার্কসীয় তত্ত্বের তাৎপর্য লেনিনবাদের মধ্যে সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করেছে। লেনিনের বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে মার্কসীয় মতবাদের পরিপূরক হিসাবে কাজ করেছে। বর্তমানে তাই সাম্যবাদকে মার্কসাদ-লেনিনবাদ নামেও অভিহিত করা হয়। লেনিন মার্কসবাদকে সমকালীন রাশিয়ার অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে প্রয়োগ করেছেন। বস্তুত মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠায় লেনিনের অবদান অপরিসীম। মার্কসীয় মতবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে লেনিনের অবদান নিম্নলিখিতভাবে আলোচনা করা যায়।
(ক) তত্ত্ব ও বাস্তবের সমন্বয়: মার্কসীয় তত্ত্ব এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষেত্রে লেনিনের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। মার্কস ব্যস্ত ছিলেন তত্ত্ব নিয়ে, কিন্তু লেনিনের ব্যস্ততা তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে। লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি সুসংহত বৈপ্লবিক মতবাদ গঠন করেছেন। তিনি What Is To Be Done গ্রন্থে বলেছেন, ‘বৈপ্লবিক মতবাদ ছাড়া কোন বৈপ্লবিক আন্দোলন অসম্ভব’ (“Without a revolutionary theory there can be no revolutionary movement.”)। তিনি সাধারণ মানুষের সংগ্রামের কষ্টিপাথরে এই বৈপ্লবিক মতবাদকে যাচাই করার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর মতে, বৈপ্লবিক মতবাদের নির্ধারিত পথে সংগ্রাম পরিচালিত না হলে তা উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গভীর যোগাযোগের ভিত্তিতে মতবাদ গড়ে তুললে তা সর্বহারাদের আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। বস্তুত লেনিন বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে রাশিয়ায় মার্কসীয় তত্ত্বকে প্রয়োগ করেছিলেন।
(খ) সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে লেনিনের মতবাদ: স্যাবাইনের মতানুসারে, লেনিন সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিতে ধনতন্ত্রের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা মার্কসীয় দর্শনে লেনিনের শ্রেষ্ঠ অবদান। লেনিনের মতানুসারে ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের বিকাশে সর্বোচ্চ স্তরের নাম হল সাম্রাজ্যবাদ। মার্কসের সময় পুঁজিবাদের একচেটিয়া বিকাশ ঘটেনি। লেনিন পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এবং বলেছেন যে সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর। লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর বলে সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন: “…imperialism is the monopoly stage of capitalism.” এই সর্বোচ্চ স্তর বা শেষ পর্যায়ে কিভাবে পুঁজিবাদ ধ্বংস হবে লেনিনই তা প্রথম বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। লেনিন এই সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি এবং তার অবসান সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। ধনতন্ত্রের বিকাশের শেষ স্তরে একচেটিয়া মূলধনের প্রাধান্য দেখা যায়। তখন মূলধন রপ্তানি শুরু হয় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলির রাজনীতিক ও আর্থনীতিক জীবনের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করার চেষ্টা চালায়। এই সাম্রাজ্যবাদ ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদ থেকে পৃথক প্রকৃতির। পুঁজিবাদের বিকাশের এই সর্বোচ্চ স্তরে আর্থনীতিক সংকট ও বিশ্বযুদ্ধ এবং মেহনতী মানুষের বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক দেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রাম অনিবার্যভাবে দেখা দেবে। সাম্রাজ্যবাদের এই সংকটের সময় কোন কোন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠন সম্ভব। উদাহরণ হিসাবে পূর্বতন রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের কথা বলা হয়। লেনিন সাম্রাজ্যবাদী যুগে মার্কসবাদকে পরিপূর্ণ রূপে প্রয়োগ করেছেন এবং গতিশীল করেছেন। তিনি মার্কসবাদের সাহায্যে যাবতীয় দ্বন্দ্ব ও সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।
(গ) রাজনীতিক দল সম্পর্কে মত: লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে বিপ্লবী দল গঠন এবং তাকে বিপ্লব সংগঠনের হাতিয়ারে পরিণত করার কথা বলেছেন। মেহনতী মানুষের অগ্রণী বাহিনী হিসাবে রাজনীতিক দলের ভূমিকার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলস্ও বলেছেন। তবে লেনিন এক নতুন ঐতিহাসিক অধ্যায়ে এ ক্ষেত্রে মার্কসের ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি রাজনীতিক দলকে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী অংশ, সংগঠিত অংশ ও সর্বোচ্চ শ্রেণীবদ্ধ রূপ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। বস্তুত লেনিন বিপ্লব সংগঠনের জন্য একটি শক্তিশালী দলীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে দলীয় সংগঠন ছাড়া সর্বহারা শ্রেণীর আর কোন অস্ত্র নেই। তিনি বলেছেন, “যে দল সর্বাধিক অগ্রগামী মতবাদের দ্বারা পরিচালিত, একমাত্র সেই দল অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।” কমিউনিস্ট দলই হবে এই দলীয় সংগঠন। শ্রমিকশ্রেণীর সর্বাপেক্ষা সচেতন ও সক্রিয় অংশকে নিয়ে দল গঠিত হবে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিতার ভিত্তিতে এই দল কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার দ্বারা সুসংহত হবে। দল হল শ্রমিকশ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য অংশ, শ্রমিকশ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠিত রূপ এবং সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের হাতিয়ার। লেনিন প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের জায়গায় পার্টির একনায়কত্ব কায়েম করেছিলেন। দল বৈপ্লবিক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রবর্তী বাহিনীর ভূমিকা পালন করবে এবং বৈপ্লবিক কার্যকলাপ পরিচালনা করবে। তবে লেনিন শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবীদের আত্মসমালোচনার উপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
(ঘ) সর্বহারার একনায়কত্ব: লেনিন মার্কসীয় মতবাদের সর্বহারাদের একনায়কত্বের তত্ত্বকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। লেনিন সর্বহারার একনায়কত্বের ধারণাটিকে শ্রমিক বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল সর্বহারাদের একনায়কত্ব। তাই এই বিপ্লবের হাতিয়ার হল কমিউনিস্ট দল। লেনিনের মতে বিপ্লবের পর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিলোপ ঘটিয়ে যখন শ্রমিকশ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে তখনই সর্বহারাদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর মতে, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব হল গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ প্রকাশ এবং মেহনতী মানুষের মিত্রস্বরূপ। সর্বহারার একনায়কত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের স্বার্থে পরিচালিত হয়। এই একনায়কত্বে জনগণ সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হয়। জনসাধারণ সমাজতান্ত্রিক স্বার্থের বিরোধী সকল রকম পুঁজিবাদী প্রতি-বিপ্লবীকে ধ্বংস করার জন্য সংগঠিত হয়। সর্বহারা শ্রেণী বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্পূর্ণ বিনাশ, নিজেদের অর্জিত ক্ষমতা সুসংহত ও প্রতিষ্ঠিত করা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে। লেনিন বলেছেন: “The transition from Capitalism to Communism is certainly bound to yield… a variety of political forms, but the essence will inevitably be the same the dictatorship of the proletariat.” লেনিনের মতানুসারে মূলত তিনটি কারণে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রয়োজন: (১) ক্ষমতা তথা সম্পত্তিচ্যুত পুঁজিপতি ও জমিদার শ্রেণীর প্রতিরোধ চূর্ণ করা, (২) সকল শ্রমজীবী মানুষ যাতে শ্রমিকশ্রেণীর চারদিকে সমবেত হয় সেদিকে নজর রেখে নতুন সমাজ নের কাজ পরিচালনা করা এবং (৩) বিদেশী শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী গঠন করা। টম্পসন (O. Thompson): “The dictatorship of the proletariat means democracy for the people and dictatorship over the capitalists.” লেনিনের মতানুসারে সর্বহারার একনায়কত্ব হল বুর্জোয়াদের উপর শ্রমিকশ্রেণীর শাসন। এই শাসন আইনকানুনের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয় এবং বলপ্রয়োগের উপর প্রতিষ্ঠিত।
(ঙ) গণতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা: লেনিন মার্কসের ন্যায় পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে এই বুর্জোয়া গণতন্ত্র হল শোষকশ্রেণীর গণতন্ত্র। লেনিন তাঁর ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাজনীতিক সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে প্রকৃত গণতন্ত্র বলা যায় না। প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন হল পুঁজিবাদের অবসান এবং রাজনীতিক ও আর্থনীতিক সাম্যের উপর গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। লেনিনের মতানুসারে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের আওতায় গণতন্ত্র সার্থক হয়। প্রকৃত গণতন্ত্র শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামে সহায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধনতন্ত্রের উচ্ছেদের পরই কেবল প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। একমাত্র সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। এ প্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন: “Democracy for the first time becomes democracy for the poor, democracy for the people, and not democracy for the moneybags.”
(চ) বিপ্লব সম্পর্কে ধারণা: লেনিন বিপ্লবের সূত্রপাতের ব্যাপারে দেশ ও কাল সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণাকে বিকশিত ও বাস্তবমুখী করেছেন। তাঁর মতে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেখানে যত দুর্বল হবে ধনতন্ত্রের ভাঙ্গন সেখানে তত তরান্বিত হবে এবং সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হবে। ধনতন্ত্রের ভাঙ্গন প্রকট হলেই শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়। সর্বপ্রথম শিল্পোন্নত দেশেই বিপ্লব সংগঠিত হবে, লেনিন মার্কসীয় দর্শনের এই তত্ত্বকে পরিবর্তিত রূপ দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে কেবল শিল্পোন্নত দেশেই সর্বহারার বিপ্লব প্রথম হবে তা বলা যায় না। যেখানে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলা সব থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেখানেই বিপ্লব ঘটবে। তা ছাড়া প্রচলিত ধারণা হল শিল্পে অনগ্রসর দেশে প্রথমে হবে বুর্জোয়া বিপ্লব। বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়ারা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে বিকশিত করবে। তারপরই সর্বহারা বিপ্লব সংঘটিত হবে। অর্থাৎ বুর্জোয়া বিপ্লব ও সর্বহারার বিপ্লবের মধ্যে ব্যবধান বর্তমান। লেনিনের অভিমত অনুসারে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সর্বহারার বিপ্লব অভিন্ন শৃঙ্খলে আবদ্ধ। জারতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র এবং ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লেনিন সর্বহারা শ্রেণীর সুস্পষ্ট প্রাধান্যের কথা বলেছেন। লেনিনের বিপ্লবী নেতৃত্বে শিল্পে অনগ্রসর রাশিয়ায় বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
(ছ) বিপ্লবের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা: লেনিন মার্কসের ন্যায় সর্বহারার একনায়কত্বের জন্য বিপ্লবের অপরিহার্যতার কথা বলেছেন। কিন্তু বিপ্লবের পদ্ধতি সম্পর্কে লেনিনের ধারণা কিছুটা আলাদা। মার্কসের মতানুসারে, বিপ্লব সর্বদাই যে হিংসাত্মক হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু লেনিনের অভিমত হল সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লব অবশ্যই হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করবে। তাঁর মতানুসারে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে শোষক শ্রেণী সহিংস বলপ্রয়োগের পথ গ্রহণ করবে। তার ফলে শ্রমিক শ্রেণীকেও বিপ্লবে বলপ্রয়োগ করতে হয়। তবে বিপ্লব হিংসা বা ধ্বংসের তাণ্ডব নয়, সৃষ্টির মহোৎসব। মেহনতী জনগণ বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন সমাজ গঠনের স্বার্থে সক্রিয় ও সৃজনশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। লেনিন বলেছেন: “Revolutions are the festivals of the oppressed and the exploited.”
(জ) বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রসঙ্গে লেনিনের অবদান: মার্কস ও এঙ্গেলস্-এর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল সূত্রটিকে লেনিন বাস্তবে প্রয়োগ করেন। তা ছাড়া এই বিপ্লবকে কিভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত করা যায় তাও তিনি ব্যাখ্যা করেন। শেপতুলিন (A. P. Sheptulin) তাঁর Marxist Leninist Philosophy গ্রন্থে বলেছেন: “Lenin developed the Marxist teaching on the character and motive forces of the bourgeois democratic revolution and its connection with the socialist revolution, enriching the teaching with important conclusions.” বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রলেতারিয়েতের হাতে থাকবে।
(ঝ) রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা: লেনিন মার্কসের মতই বলেছেন যে, রাষ্ট্র কোন চিরন্তন প্রতিষ্ঠান নয়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে মীমাংসার অতীত সংঘাতের ফলেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে একশ্রেণী অন্য শ্রেণীকে শোষণ করতে থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্র শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার বই কিছু নয়। এই রাষ্ট্র মুষ্টিমেয় বিত্তবানের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষকে শোষণ করে। বিপ্লবের পর সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। অবশেষে সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে নিজে থেকেই পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে।
মার্কস ও এঙ্গেলস্ রাজনীতিক ক্ষমতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেননি। সাম্যবাদে উত্তরণের আগে রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রসঙ্গেও এঁরা বিস্তারিতভাবে কিছু বলেননি। লেনিন তাঁর State and Revolution গ্রন্থে এ অপূর্ণতা দূর করেছেন। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কিত মার্কস-এঙ্গেলস-এর ব্যাখ্যা তিনি স্বীকার করার পর আরও এগিয়ে গিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, ‘বুর্জোয়া রাষ্ট্র হল বুর্জোয়াদের একনায়কতন্ত্র।’ বুর্জোয়া রাষ্ট্রে যথার্থ গণতন্ত্র থাকতে পারে না। লেনিন বলেছেন: “So long as the state exists, there is not freedom. When there will be freedom, there will be no state.” ইবেনস্টেইন (Ebenstein) তাঁর Great Political Thinkers বইতে বলেছেন: “Lenin ….. was keenly interested in the anatomy of the state.”
(ঞ) কৃষকদের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা: লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে কৃষকশ্রেণীর বৈপ্লবিক ভূমিকা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কৃষকশ্রেণীকে লেনিন শ্রমিকশ্রেণীর মজুতবাহিনী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতানুসারে, বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কৃষির সঙ্গে শিল্পের সংযোগ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এই সমস্ত ক্ষেত্রে কৃষকশ্রেণীর সক্রিয় সহযোগিতা বিশেষভাবে দরকার। জার-শাসিত রাশিয়ার বিপ্লব পরিচালনা করতে গিয়ে লেনিন প্রলেতারিয়েতের মিত্র হিসাবে কৃষক শ্রেণীকে বিপ্লবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। শেপতুলিন মন্তব্য করেছেন: “He also established that the peasantry was an ally of proletariat.”
(ট) জাতি সমস্যা সম্পর্কে ধারণা: লেনিন মার্কস ও এঙ্গেলসের চিন্তাধারার ভিত্তিতে জাতীয় আন্দোলন এবং নির্যাতিত মেহনতী মানুষের মুক্তি আন্দোলনের বৈপ্লবিক গতি-প্রকৃতি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে লেনিন রণনীতি ও রণকৌশল। জাতিগত সমস্যার উপরও আলোকপাত করেছেন। লেনিন জাতিসমস্যাকে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের সাধারণ সমস্যার অংশ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। লেনিনের মতানুসারে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে জাতি সমস্যা ও ঔপনিবেশিক সমস্যা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাঁর মতে জাতিগত ও ঔপনিবেশিক সমস্যা আন্তর্জাতিক সর্বহারার বিপ্লবের সঙ্গে সংযুক্ত। সাম্রাজ্যবাদের অধ্যায়ে লেনিন ঔপনিবেশিক সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।
(ঠ) পেশাদার বিপ্লবী গোষ্ঠী গঠন: লেনিনের আর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি পেশাদার বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে তোলা। অভিজ্ঞ লেনিন বিপ্লব সম্পর্কিত সংগঠনকে দু’ভাগে বিভক্ত করেন। একটি হল শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন। একে বলা হয় ট্রেড ইউনিয়ন। অন্যটি পেশাদার বিপ্লবীদের নিয়ে সংগঠিত। এই সংগঠনটি ছোট ও সুসংহত। এই বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে লড়াই করার ক্ষমতা, সাহস ও ধৈর্য্য বর্তমান। লেনিন পেশাদার বিপ্লবীদের পুলিশের মত শিক্ষিত, সাহসী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন।
(ড) বস্তু ও চেতনা: মার্কসবাদে লেনিনের আর একটি বড় অবদান হল যে, লেনিন বস্তু চেতনা ও দ্বান্দ্বিকতা সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণাকে অধিকতর বিকশিত করেছেন। মার্কসের মতানুসারে মানুষের চেতনা হল বস্তু জগতের প্রতিফলন। লেনিন আর একটু এগিয়ে বললেন চেতনা বস্তুজগতের প্রতিফলন ছাড়াও এর নিজস্ব একটা সৃজনশীল শক্তি আছে। তাঁর মতে, “Man’s consciousness not only reflects the objective world, but creates it.”
দ্বান্দ্বিকতা: লেনিনের মতানুসারে দ্বান্দ্বিকতা কেবল অতীতের বিভিন্ন পর্যায়ের পুনরাবৃত্তি নয়। ক্রমশ উন্নততর পর্যায়ে দিকে দ্বান্দ্বিকতা অগ্রসর হয়। এই অগ্রসরমানতা উল্লম্ফনের মত। শেপতুলিন বলেছেন: “Lenin revealed the essence of the dialectical understanding of development as a repetition of the past stages, but on a higher basis, as a leap-like revolutionary changing of reality caused by inner contradiction, by the clash between different and opposite forces and tendencies.”
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ: লেনিন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে বিকশিত করেছেন। মার্কস-এঙ্গেলসকে অনুসরণ করে তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে শুধু একটি বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে প্রতিপন্ন করেননি; জ্ঞানের তত্ত্ব, চিন্তা করার পদ্ধতি এবং বাস্তবকে রূপান্তরিত করার উপায় হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। শেপতুলিন বলেছেন: “Following Marx and Engels, Lenin developed dialectical materialism not only as a world outlook, but also as a theory of knowledge, a method of thinking and a practical transformation of reality.” এইভাবে লেনিন দ্বন্দ্বিক বস্তুবাদকে বিস্তৃততর এবং তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছেন।
উপসংহার: বস্তুতপক্ষে, মার্কসের মন্ত্রশিষ্য লেনিন ছিলেন একজন তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী নেতা। তিনি মার্কসীয় দর্শনের মূল সূত্রগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলিকে যুগোপযোগী করেছেন। তিনি মার্কসবাদকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন। রাশিয়াতে মহান নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে লেনিন-প্রদর্শিত পথেই মার্কসবাদ বাস্তবায়িত হয়েছে। মার্কসবাদের প্রয়োগ-সমস্যা এবং বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান সম্পর্কে লেনিন অর্থবহ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করেছেন।
Leave a comment