মামুদ গাওয়ান-এর প্রধানমন্ত্রিত্বে বাহমনী সাম্রাজ্য বিস্তৃতি ও শক্তির চরম শিখরে উপনীত হয়েছিল। অধ্যাপক শেরওয়ানীর ভাষায়: “The premiership of Khawaja-i-Jahan Mahmud Gawan saw the Bahamani state attain a height unequalled in the whole of its history.” প্রথম জীবনে ব্যবসায়ী গাওয়ান তাঁর প্রতিভাদীপ্ত কর্মধারার দ্বারা বাহমনী রাজ্যকে ভৌমিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিরতা এবং সাংস্কৃতিক উজ্জ্বলতা দ্বারা মহিমময় করে তুলেছিলেন। নাবালক সুলতান নিজাম শাহের কাজ তত্ত্বাবধান করার জন্য তিন সদস্যের যে প্রতিনিধিসভা গঠিত হয়, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন মামুদ গাওয়ান। অপর প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন রাজমাতা নার্গিস বেগম। নাবালক রাজার মৃত্যু পর্যন্ত, প্রায় দু-বছর এই চতুর ও বিচক্ষণ মহিলা দক্ষিণ ভারতীয় রাজনীতিতে কর্তৃত্ব করেন। এই সময়ে রাজনীতিতে মামুদ গাওয়ান-এর গুরুত্বও উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দে খাজা-ই-জাহান তুর্ক-এর মৃত্যু এবং রাজনীতির অঙ্গন থেকে নার্গিস বেগম-এর অবসর গ্রহণের ফলে মামুদ গাওয়ান ক্ষমতাবৃদ্ধির অপূর্ব সুযোগ পেয়ে যান। নবনিযুক্ত সুলতান তৃতীয় মহম্মদ মামুদ গাওয়ানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে ‘খাজা-ই-জাহান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই সময় থেকে আমৃত্যু, প্রায় উনিশ বছর, মামুদ গাওয়ান প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থেকে প্রকৃত অর্থেই দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দান করেছিলেন (১৪৬৪-৮৩ খ্রিঃ)।

মামুদ গাওয়ান অত্যন্ত দায়িত্ববোধ ও সেবার মানসিকতা দ্বারা দপ্তরের কাজ সম্পাদন করেন। প্রকৃত বীরের মতোই নিঃশঙ্কচিত্তে তিনি স্বয়ং যুদ্ধযাত্রা করেন এবং সাফল্যের সাথে রাজ্যের ভৌমিক সম্প্রসারণ ঘটান। তিনি কোঙ্কনের রাজাকে পরাজিত করেন এবং সঙ্গমেশ্বরের পরাজিত রাজাকে খালনা দুর্গ হস্তান্তর করতে বাধ্য করেন। সুলতান প্রথম আহম্মদ শাহের আমল থেকেই খলজি-শাসিত মালবরাজ্য সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। পূর্ব-স্বাক্ষরিত এক চুক্তি দ্বারা ঠিক হয়েছিল যে, বেরার বাহমনী সুলতানের অধীনে থাকবে। এখন মালব বেরার পুনদখলের চেষ্টা করলে মামুদ গাওয়ান তা প্রতিরোধ করেন। এজন্য তিনি মালবের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হন। গুজরাটের শাসকের সহায়তায় মামুদ গাওয়ান মালবের বিরুদ্ধে সফল হন। পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে মামুদ গাওয়ান-এর সামরিক অভিযান ও সাফল্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দাভোল, গোয়া, রাজমুন্ত্রী, কোন্দাভির-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল তিনি দখল করতে সমর্থ হন। এই সকল বন্দর জয় করার ফলে ইরাক, ইরান প্রভৃতি দেশের সাথে বাহমনী রাজ্যের বহির্বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। পরন্তু এই সকল স্থান হস্তচ্যুত হবার ফলে চিরশত্রু বিজয়নগর বড়ো আঘাত পায়। বিজয়নগরের বিরুদ্ধেও তাঁর সাফল্য কম গৌরবোজ্জ্বল ছিল না। বিজয়নগরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কাঞ্চি পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে মামুদ গাওয়ান নিজ সামরিক শক্তির প্রমাণ দেন। ‘কাঞ্চি’ বা ‘কাঞ্চিভরম’ শহরটি মুসলমান সৈন্যদের হাতে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়। এখান থেকে লুণ্ঠিত বিশাল ধনসম্পদে স্ফীত হয় বাহমনী রাজ্য। উড়িষ্যার বিরুদ্ধেও গাওয়ান অভিযানে নেতৃত্ব দেন এবং সেখান থেকে প্রচুর অর্থ ও হাতি উপঢৌকন হিসেবে সংগ্রহ করেন। এইভাবে বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে আরবসাগরের তীরভূমি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় বাহমনী রাজ্যের শাসন। সমুদ্র থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা মামুদ গাওয়ান-এর সাফল্যের দ্যুতি।

রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মাধ্যমে দৃঢ় প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজেও গাওয়ান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। কালক্রমে রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পেলেও প্রশাসনিক সংস্কার করা হয়নি— একথা গাওয়ান উপলব্ধি করেন। প্রাদেশিক গভর্নরদের শক্তি ও ক্ষমতাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনি একাধিক ব্যবস্থা নেন। ইতিপূর্বে রাজ্য চারটি তরফে বিভক্ত ছিল। গাওয়ান তরফ বা প্রদেশের সংখ্যা বাড়িয়ে আটটি করেন। প্রতিটি প্রদেশের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অংশকে সরাসরি সুলতানের শাসনাধীনে রাখেন। প্রদেশগুলির মধ্যে স্থাপিত দুর্গগুলির মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলির কিল্লাদারদের কাজের জন্য সরাসরি কেন্দ্রের কাছে দায়বদ্ধ রাখা হয়। এমনকি জায়গিরদাররাও তাঁদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বপালনের ব্যাপারে সুলতানের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। ভূমিসংস্কারের ক্ষেত্রে গাওয়ান যথেষ্ট বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। গাওয়ান রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করে ভোগদখলকারীর তালিকা প্রস্তুত করেন। এজন্য গাওয়ানকে ‘মুঘলযুগের প্রখ্যাত সংস্কারক টোডরমলের পূর্বসূরি ও পথপ্রদর্শক’ বলা চলে। ইতিমধ্যে দক্ষিণী মুসলমান ও বিদেশি মুসলমান (আফাকি বা খরাবি) অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই যে তীব্র হয়ে উঠেছিল, তা-ও দূরদর্শী মামুদ গাওয়ান-এর দৃষ্টি এড়ায়নি। এই বিরোধ প্রশমিত করে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য তিনি উভয়পক্ষের সমানসংখ্যক আমিরকে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনপদে নিযুক্ত করেন। নিজে একজন আফাফি হয়েও দক্ষিণী মুসলমানদের সম্মান ও ক্ষমতা দিয়ে গাওয়ান উদারতার পরিচয় দেন।

শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক রূপেও গাওয়ান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। শিক্ষাপ্রসারের উদ্দেশ্যে রাজধানী বিদরে তিনি একটি সুবিশাল মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। এখানে প্রায় এক হাজার ছাত্র ও শিক্ষক পঠনপাঠন করতেন। নিপুণ স্থাপত্যকর্ম হিসেবেও এই মাদ্রাসাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেশবিদেশের বহু পণ্ডিত এখানে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত থাকতেন। রুশ পর্যটক আথানাসিয়াস নিকিতন তৃতীয় মহম্মদ শাহের রাজত্বকালে দীর্ঘদিন (১৪৭০-‘৭৮ খ্রিঃ) বিদরে অবস্থান করেছিলেন। তিনি এই শহর ও জনগণের নানা দিক সম্পর্কে মনোজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। নিকিতন লিখেছেন যে, “বিদর শহরটি ছিল খুবই বিশাল, সুপরিকল্পিত, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসজ্জিত। সুলতান ও অভিজাতগণ অত্যন্ত বিলাসব্যসন ও জাঁকজমকের মধ্যে দিনাতিপাত করতেন। তবে সাধারণ মানুষের সাথে অভিজাতদের বৈষম্য ছিল লক্ষণীয়।” তিনি লিখেছেনঃ “গ্রামের মানুষ খুবই জীর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে। কিন্তু অভিজাতরা যেমন বিত্তবান তেমনি তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও রাজ্যের সর্বত্র।”

দক্ষ প্রশাসক গাওয়ান-এর শেষ পরিণতি ছিল খুবই দুঃখজনক। তিনি শেষ পর্যন্ত গোষ্ঠী রাজনীতির বলি হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাহমনী রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বিদেশি বা দক্ষিণীদের সাথে নবাগত বিদেশি বা আফাকিদের বিরোধ ছিল তীব্র। গাওয়ান উভয়পক্ষকেই সন্তুষ্ট করে দেশের স্বার্থে উভয়গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ সেবাগ্রহণের চেষ্টা করেছিলেন। তথাপি নবাগত বিদেশি হিসেবে তিনি দক্ষিণী মুসলমানদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। যুদ্ধের কারণে গাওয়ান অধিকাংশ সময় রাজধানীর বাইরে থাকতেন। এই সুযোগ নেন দক্ষিণীরা। গাওয়ান যখন পশ্চিমাঞ্চলের অভিযানে ব্যস্ত, সেই সময়ে বিরোধীরা তাঁর এক হাশি সহকারীকে হাত করেন। মত্ত অবস্থায় ওই হাশি ভুলবশত গাওয়ান-এর সরকারি মোহর একটি সাদা কাগজে দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তুলে দেন। বিরোধীরা এই কাগজে সুলতানের বিরুদ্ধে উড়িষ্যার শাসকের সাথে মামুদ গাওয়ান-এর এক ষড়যন্ত্রভিত্তিক জালপত্র রচনা করে সুলতানের কাছে পেশ করেন। এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা বোঝার ক্ষমতা সুলতান মহম্মদের ছিল না। একজন বিচক্ষণ ও নিবেদিতপ্রাণ সৈনিকের কর্মধারার সঠিক মূল্যায়ন না করেই তিনি ষড়যন্ত্রদের কথায় বিশ্বাস করেন এবং মামুদ গাওয়ান-এর প্রাণদণ্ড দেন। ষড়যন্ত্রকারীর মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে তিয়াত্তর বছরের নিবেদিতপ্রাণ এই দেশনায়ক বিনাপ্রতিবাদে প্রাণ বিসর্জন দেন (১৪৮৩ খ্রিঃ)।