বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে রসের ব্যাখ্যায় পঞ্চরসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান দেওয়া হয়েছে ‘মধুর রস’কে। মধুর তথা উজ্জ্বল বা শৃঙ্গার রস চতুর্ধা বিভক্ত, তাতে পূর্বরাগের পরই মানের স্থান। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে ‘মান’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে-
‘সাধন ভক্তি হৈতে হয় রতির উদয়।
রতি গাঢ় হৈলে পরে প্রেম নাম কয়।।
প্রেম বৃদ্ধিক্রমে স্নেহ মান প্ৰণয়।’
মানের দুটি বিভাগ–উদাত্ত মান এবং ললিত মান উদাত্ত মানকে বলা হয় ঘৃতস্নেহজাত-এতে থাকে তদীয়তাময় ভাব, অর্থাৎ ‘আমি তোমার এই ভাব ললিত মানকে বলা হয় মধুস্নেহজাত মান—এতে থাকে মদীয়তাময় ভাব অর্থাৎ ‘তুমি আমার’।
“উজ্জ্বলচন্দ্রিকা’য় বলা হয়েছে—
‘স্নেহের উৎকর্যে হয় মাধুর্য নূতন।
তাথে অদাক্ষিণ্যে মান কহে বুধগণ।।
মানে যে সকল সঞ্চারিভাব লক্ষিত হয়, তাদের মধ্যে আছে নির্বেদ, শঙ্কা, অমর্থ বা ক্রোধ, চপলতা, গর্ব, অসূয়া, ভাবগোপন বা অহহিখা, গ্লানি ও চিন্তা মানের দুটি প্রধান শাখা সহেতু মান ও নির্হেতু মান। পদাবলী সাহিত্যে নায়িকার মান সহেতু। সহেতু মান উদাত্ত ও ললিতভেদে দ্বিবিধ। নায়িকাকে নায়ক ছলনা করার যে কারণ উপস্থিত হয়, তার জন্য নায়িকা অভিমানিনী হলেই সহেতু মান হয়। বৈষ্ণব পদাবলীতে যত মানের পদ রচিত হয়েছে তাদের অধিকাংশের মধ্যেই আছে—প্রিয়তমের দেহে ভোগচিহ্নদর্শন।
কারণ না থাকা সত্ত্বেও কিংবা কারণাভাস থাকলেও প্রেমের অতিরেক-হেতু নায়িকার মনে যে অভিমান জন্মে, তাকেই বলে নিহেতু মান। কৃষ্ণের ছলনায় যে সহেতু মানের উৎপত্তি, তা’ রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন করেননি। তিনি বলেন “আধ্যাত্মিক অর্থে ইহার কোনো বিশেষ গৌরব থাকিতে পারে, কিন্তু সাহিত্য হিসাবে শ্রীকৃষ্ণের এই কামুক ছলনা দ্বারা কৃষ্ণরাধার প্রেম কাব্যের সৌন্দর্যও খণ্ডিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” নিৰ্হেতু মান-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছুটা সহনশীলতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, “যতক্ষণ নায়কের প্রেমের প্রতি নায়িকার যথার্থ দাবি থাকে, ততক্ষণ মাঝে মাঝে ক্রীড়াচ্ছলে অথবা স্বল্প অপরাধের দণ্ডচ্ছলে পুরুষের প্রেমাবেগকে কিয়ৎকালের জন্য প্রতিহত করিলে সে অভিমানের একটা মাধুর্য দেখা যায়।”
পদাবলী সাহিত্যে সহেতুক মানের নিদর্শনই বেশি। তবে রাধিকার নির্হেতু মানও কম নয়। কৃষ্ণবক্ষঃস্থিত কৌস্তুভমণিতে স্বীয় প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে অন্য নায়িকাভ্রমে শ্রীমতী মানিনী হয়েছিলেন—এটি নিহেঁতু মানের দৃষ্টান্ত। অনুরূপভাবেই, রাধার লাবণ্যতরঙ্গে নিজের প্রতিরূপ দেখতে পেয়ে কৃষ্ণের অভিমান হল এ বিষয়ে রায়শেখরের একটি পদ—
‘বড় অপরূপ পেখলু হাম।
কি লাগিয়া-দৌঁহে কয়লমান।।’
বৈষ্ণব সাহিত্যে মানের সঙ্গে আরও কিছু কিছু আনুষঙ্গিক বিষয় জড়িত থাকে। অভিসার থেকে তার শুরু। নায়কের সঙ্কেত অনুসারে নায়িকা অভিসারে যান। তারপর বাসকসজ্জা পর্যায়ে নায়িকা কাস্তের আশায় কুঞ্জ সাজিয়ে প্রতীক্ষমাণা থাকেন। কাস্তের বিলম্ব দেখে নায়িকা উৎকণ্ঠিতা হন। এর পর সন্ধেত- সত্ত্বেও যখন নায়কের দেখা পাওয়া যায় না, তখনই বঞ্চিতা নায়িকার বিপ্রলব্ধা পর্যায় প্রতিনায়িকার কুঞ্জে রাত্রিযাপন করে বিলাসচিহ্ন গায়ে মেখে নায়ক যখন নায়িকার কুঞ্জে যান, তখন নায়িকার খণ্ডিতা অবস্থা। নায়িকা কলহ করে নায়ককে কুঞ্জ থেকে তাড়িয়ে দেন। – এই অবস্থার নাম কলহান্তরিতা। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে নায়িকার বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনা করে যে অষ্টবিধা নায়িকার কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা ও কলহাস্তরিতা নায়িকা-বিষয়ক পদগুলিকে ‘মান’ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত বলেই গ্রহণ করা হয়, এমনকি ‘বাসকসজ্জিকা কেও এতে স্থান করা চলে। অতঃপর মানভঞ্জন এবং তার জন্যে নানাবিধ উপায় অবলম্বন।
মানের উৎকর্ষ ও বৈচিত্র্য:
পদাবলী সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ মানের পদগুলো। মানের উৎকর্ষ-বিষয়ে কবিশেখর কালিদাস রায়ের মন্তব্য অতিশয় প্রণিধানযোগ্য: “এইখানেই পদাবলীর রসসৃষ্টি চরমে উঠিয়াছে। মানই প্রধানত পদাবলীর মান রাখিয়াছে। কোনো দেশের সাহিত্যে অভিমানকে রসস্তস্বরূপ গ্রহণ করিয়া এমন চমৎকার কবিতা রচিত হয় নাই। আশ্চর্যের বিষয়, যে মান—ভারতীয় প্রেম কবিতার ‘প্রাণ’— সেই মানের একটা উপযুক্ত প্রতিশব্দ পর্যন্ত- ইংরাজি সাহিত্যে নাই। প্রণয়ের গাঢ়তার সঙ্গে মানের সম্পর্ক। বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রণয়ের গাঢ়তা ও গভীরতা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছিয়াছে—তাহার ফলে মান ইহাতে এতদূর পর্যন্ত প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। সংস্কৃত সাহিত্যে মান প্রণয়লীলার একটা গতানুগতিক অঙ্গমাত্র। পদাবলী সাহিত্যে ইহা গতানুগতিকতার সীমা লঙ্ঘন করিয়া পারমার্থিকতায় পৌঁছিয়াছে। লৌকিক প্রেমের কবিতা হিসাবেও ‘মান’ পদাবলীকে একটা অনন্যসাধারণ স্বাতন্ত্র গৌরব ও উচ্চতর মর্যাদা দান করিয়াছে।”
“পদাবলী সাহিত্যে মধুর রসের চরম প্রকাশ মিলনে নয়, বিরহে নয়—চরম প্রকাশ এই মানে। গভীরতম অনুরাগ ছাড়া মানে অধিকার হয় না। গভীরতম অনুরাগ না থাকিলে, প্রিয়তম চরণ ধরিয়া প্রিয়তমার মানভঞ্জন করে না। ঐশ্বর্যবোধ হইতে দূরে যাইতে যাইতে অনুরাগ যখন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে, তখনই অভিমান করা চলে। মানের আপাত ব্যবধানেই সর্ব ব্যবধানের বিলোপ ৷ এইখানেই শ্রীমতী একেবারে শ্যামময়ী হইয়া পড়েন— তাহার বেদ্যাস্তর স্পর্শ শূন্যতার ভাব জন্মে। এইভাবেই ব্রহ্মাম্বাদাভাস।”
মানের বৈচিত্র্য অসাধারণ এবং মান প্রসঙ্গে সখীদের ভূমিকাও বিশেষভাবেই লক্ষণীয়; পদকর্তারাও অনেকেই সখীরূপে রাধার দেহারতি করেছেন।
অভিসারিকা রাধা কুঞ্জ সাজিয়ে বসে রইলেন, কিন্তু কৃষ্ণ এলেন না। রাধার মান হল, তিনি কৃষ্ণের প্রতি রুষ্ট হয়ে যাবতীয় কৃষ্ণবর্ণ পদার্থের ওপর বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলেন তিনি নীল বসন ত্যাগ করলেন, চিবুকের কৃষ্ণতিল চিহ্নটি চন্দন দিয়ে ঢেকে রাখলেন, কালো তমালের গায়ে চুন মাখালেন, দর্পণে নিজের কৃষ্ণবেশ প্রতিবিম্বিত হয় বলে দর্পণ ভেঙ্গে ফেললেন। বড় দুঃখ করেই তিনি বলেন—
আন্ধল প্রেম পহিল নহি জানলু
সো বহুবল্লভ কান।
আদর-সাধে বাদ করি তা সঞে
অহর্নিশি জ্বলত পরাণ।।
কিন্তু এই মান করে থাকলে তো কৃষ্ণকে ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই সখী বলছেন—
‘সুন্দরি ইথে কি মনোরথ পুর।
যাচিত রতন তেজি পুন মাঈন সো মিলন অতি দূর।।’
যে সখী আগেই রাধাকে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হতে নিষেধ করেছিল, এবার তার পালা—
শুনইতে কানু মুরলির মাধুরী শ্রবণ নিরারলু তোর
হেরইতে রূপ নয়ন-যুগ ঝাপলু তবে মোহে রাখিল ভোর।।
সুন্দরি, তৈখনে কহলম তোয়।
ভরমহি তা সত্রে প্রেম বাঢ়ায়বি জনম ‘গোঙায়বি রোয়।’
সখীর সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান করার ফল এখন জীবন-ভোর কান্না কিন্তু সখীরা সবাই তো একরকম নয়; আর এক সখী পরমর্শ দিচ্ছে—
“অপরাধ জানি গারি দশ দেয়বি পীরিতি ভাঙ্গবে কাহে লাগি।
পীরিতি ভাঙ্গিতে যো উপদেশল তাকর মুখে দেই আগি।।”
অপরাধ করে থাকলে তাকে দশবার গাল দিবি, পীরিতি ভাঙতে তোমাকে কে বল্লো। যে তোমাকে পীরিতি ভাঙতে উপদেশ দিয়েছিল, তার মুখে আগুন।
অনেক করেও যখন কিছুতেই রাধার মন নরম হল না তখন সখীর ইঙ্গিতে কানুও সখীর সঙ্গে রাই-কুঞ্জে চলে এলেন এবং
‘হেরি বিধুমুখী বিমুখী ভেল।
কানুরে সো সখী ইঙ্গিত কেল।।
চরণকমলে পড়ল কান।
সখীর বচনে তেজল মান।।’
‘দেহিপদপল্লবমুদারম্’-এর ফর্মুলাটা জয়দেব তৈরি করেছিলেন, এখানে কাজে লাগল। এবার—
‘সুবাসিত বারি ঝারি ভরি তৈখনে
আনল রসবতী রাই
দুখানি চরণ পাখালিয়ে সুন্দরী
আপন কেশেতে মোছাই ।।’
সমস্ত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চেয়ে শ্রীমতী রাধিকা বলেন—
‘তুআ পায়ে সোপলু পরাণ।’
দু’পক্ষেই মিটমাট হয়ে গেল, মানভঞ্জন হল এবং এরই সঙ্গে মানের পালাও ইতি—
‘দুই মুখ-দরশনে দুই ভেল ভোর।
দুহঁক নয়নে বহে আনন্দ-লোর।।’
মান-বিষয়ে জনৈক সমালোচক খুবই সার্থক মন্তব্য করেছেন “মানের পদে ফুটে উঠেছে- ভক্তের অসীম আকৃতির একটি প্রতিচ্ছবি। সর্ব সমর্পণ করেও পরম ভক্ত যখন সেই সচ্চিদানন্দ রসঘন বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণের কৃপা পায় না, তখন তার অভিমান জন্মে। প্রেমের প্রগাঢ়তা এতে বেশি বলেই মান পর্যায় এতো রসঘন সকল প্রকার ভেদবুদ্ধি এখানে লুপ্ত।”
Leave a comment