এই শিক্ষা বলতে বোঝায় সেই শিক্ষাকে যার মাধ্যমে বিবেক, মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা, পারস্পরিক সহযােগিতা প্রভৃতি গুণের বিকাশ ঘটে। এইভাবে গড়ে ওঠে মূল্যবোধ। UNESCO-র আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশনের রিপাের্টে Learning to be human নামে প্রকাশিত হয় যেখানে কমিশনের মত ছিল শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু এককালীন জ্ঞান অর্জন নয় বরং ক্রমান্বয়ে কীভাবে জীবনব্যাপী জ্ঞান অর্জন করা যায় তার অন্বেষণই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘The World of Education Today & Tomorrow’ -তে শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়।

মানুষ হয়ে ওঠার ভিত্তি

মানুষ হয়ে ওঠার ভিত্তি হল বিবেক, মনুষ্যত্ব, পারস্পরিক সহযােগিতা, সমানুভূতি, নৈতিকতা প্রভৃতি গুণের বিকাশ ঘটা। শিক্ষার্থীদের এমন পরিবেশের মুখােমুখি করতে হবে যাতে তারা দায়িত্বসম্পন্ন, উৎপাদনশীল নাগরিকে পরিণত হতে পারে। এই রূপে শিক্ষার্থীরা মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা পাওয়ার মাধ্যমে স্মৃতিশক্তি, যুক্তি, নান্দনিকতাবােধ, অন্যের সঙ্গে সুযােগাযােগ, কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারবে।

শিক্ষা, শিখন ও বিদ্যালয়ের ভূমিকা

ডেলর কমিশন প্রস্তাবিত জীবনব্যাপী শিক্ষার চারটি স্তম্ভ পরস্পর সম্পর্কিত, বিচ্ছিন্ন নয়। শিক্ষার মতাে মানবসম্পদ উন্নয়নের জটিল কর্মসূচি ব্যক্তিসত্তার কোনাে একটি বিশেষ দিকের জন্য নির্দিষ্ট নয়, প্রতিটি কর্মসূচি সার্বিকভাবে ক্রিয়াশীল হয়। বিদ্যালয়ের পাঠক্রমিক ও সহপাঠক্রমিক কর্মসূচি শিক্ষার উদ্দেশ্যকে সফল করে। মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা প্রসঙ্গে শিক্ষা, শিখন ও বিদ্যালয়ের ভূমিকা সম্পর্কে নিম্নে আলােচিত হল─

(১) সাধারণ শিক্ষা ও সীমিত বিষয়ে জ্ঞানের সমন্বয়: সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সীমিত কিছু বিষয়ের উপর গভীর জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষা আমাদের জীবনব্যাপী অভিযোজনের সাহায্য করে, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তােলে।

(২) জ্ঞানের মৌলিক উপাদানের বিকাশ : স্মৃতি, মনঃসংযােগ ও ক্ষমতার অনুশীলনের ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় মানসিক প্রক্রিয়াসমূহ সাবলীলভাবে কাজ করবে। মনঃসংযােগের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ধ্যান, যােগ ইত্যাদি শিখনে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং এর দ্বারা শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হবে।

(৩) দৈহিক বিকাশ : বিবেকানন্দ বলেছিলেন, সুস্থ দেহই সুস্থ এবং সুন্দর মনের বাসস্থান। বিদ্যালয়ের নিত্যনৈমিত্তিক কার্যকলাপের সঙ্গে বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি সুস্থ দেহ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

(৪) মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশ : বিভিন্ন বিষয় পাঠের মধ্য দিয়ে বিশেষত সাহিত্যধর্মী পাঠের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয় সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে সহায়তা করে। সঠিক প্রাক্ষোভিক বিকাশের ক্ষেত্রে শুধু পাঠক্রম নয়, শিক্ষকদের যথাযথ আচরণ ও বিদ্যালয়ের পরিবেশ শিক্ষার্থীকে সমৃদ্ধ করে।

(৫) সামাজিক বিকাশ : বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, নিয়মকানুন, আদবকায়দা সম্বন্ধে সচেতন হয়। বিভিন্ন সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশার সুবাদে সামাজিক সমন্বয় ঘটানাের সুযােগ পায়।

(৬) সঙ্গতিবিধানে সহায়তা : প্রকৃত মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সঙ্গতিবিধান করা। পরিবেশকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিক্ষার্থীকে জীবনের পাঠ দেয় বিদ্যালয়।

(৭) মূল্যবোধের বিকাশ ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার বিকাশ : শিক্ষার অন্যতম কাজ ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও সঞ্চালন। বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ঘটাতে সাহায্য করে। তারই সঙ্গে পরস্পরকে এগিয়ে নিয়ে চলে।

এ ছাড়াও মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মধ্যে গণতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ ঘটাতে, আন্তর্জাতিক বােধের বিকাশ ঘটাতে এবং জাতীয় বিকাশের মানসিকতা গড়তে সাহায্য করে। সর্বোপরি জ্ঞানার্জনের স্পৃহা জাগ্রত করতে, জ্ঞান পূর্ণ মানবিক সম্পদ বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে বিদ্যালয়।