মানবতাবাদকে আমরা আধুনিক সাহিত্যের বিশেষ বাণী বলি কোন যুক্তিতে? আর আধুনিক ও প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যেই বা তফাত দেখি কীসের?—‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধ অবলম্বনে এর উত্তর সন্ধান করো।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে মানুষের গুরুত্ব সর্বাধিক। মানুষের মর্যাদাদানে সাহিত্যিকদের সক্রিয়তা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। মানুষের সম্পর্কে মূল্যবোধ সেকাল এবং একাল একই সমান্তরাল রেখায় সঞ্চরণশীল নয়। আসলে যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধের পার্থক্য হয় একালের দৃষ্টিকোণ থেকে সেকালের। মানুষের মূল্য নির্ধারণ করা হয় না। মানুষ সম্পর্কে আমাদের মূল্যবোধ আধুনিক যুগে অনেক গভীর। প্রাবন্ধিক ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধটির মধ্যে এ যুগের মানুষ সম্পর্কে আমাদের মূল্যবোধের গভীরতা ও নিগূঢ়তার দিকটিকে উদারহণ সহযোগে ব্যাখ্যা করেছেন।
যুগ ও কালের মধ্যে এক একটি বিশ্বাসবোধ সক্রিয় থাকে। পুরানো দিনে মানুষ সম্পর্কে যে বিশ্বাসবোধ ছিল পরবর্তীকালে সেই বিশ্বাসবোধে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের দেশে একটা সময় শূদ্রের পক্ষে বেদপাঠ নিষিদ্ধ ছিল। বেদপাঠের অপরাধে শঙ্কুকের শিরচ্ছেদ করা হয়। একালে অবশ্যই এই মূল্যবোধে আমরা বিশ্বাসী নই। এটাকে বলা যেতে পারে রাজশক্তি তথা উচ্চবর্ণের নিম্নবর্ণের প্রতি অবিচার। বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক লিখেছেন যে, সাহিত্যের ভাববস্তুও যে নিতান্ত কম বদলেছে তা নয়। আমাদের দেশের দৃষ্টান্তই ধরা যাক। দেশে দুর্ভিক্ষ হচ্ছে, অকালে মানুষ মরছে, প্রজারঞ্জক রাজা শ্রীরামচন্দ্র বুঝেছেন তার কারণ শূদ্র বেদ পাঠ করেছে। অতএব শূদ্র শম্বুকের শিরচ্ছেদ হল। দুর্ভিক্ষের সঙ্গে শূদ্রের বেদপাঠের সম্পর্ক আজ আমরা মানি না, কারণ মানুষের মর্যাদা আজ অনেকটা স্পষ্ট। উত্তর বিহারের ভূমিকম্পের কারণ হিন্দুদের হরিজনদের প্রতি অবজ্ঞা, গান্ধিজি একথা বললেও আমরা কুণ্ঠিত হই। এরকম পাপে ওরকম দণ্ড অযৌক্তিক, তবু পুরনো দিনে হয়তো মানুষ তাই মানত। ধূমকেতু উঠলে রাষ্ট্রবিপ্লব হবে, এ কথা তারা মানত—এখন আমরাই কি মানি? একদিন শম্বুকের শিরচ্ছেদে সাহিত্যিক দেখেছেন রাজার সুবিচারের চমৎকার প্রমাণ। একশো বছর আগেও আমাদের বৃদ্ধ প্রপিতামহ নিশ্চয় এ চক্ষেই দেখতেন সে কাহিনি। কিন্তু আজ আমরা তাতে দেখেছি রাজশক্তির এবং উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের এটা একটা মূঢ় অবিচারের প্রমাণ।
মানুষ সম্পর্কে মানুষের ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করা গেছে। সেকালে মানুষের মর্যাদা ততটা প্রদান করা হয়নি যতটা একালে প্রদান করা হচ্ছে। অবশ্য একালেও যে সর্বক্ষেত্রে মানুষকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে—একথা বোধ হয় জোর দিয়ে বলা যায় না। যে মূল্যবোধে আমাদের পূর্বপুরুষরা বিশ্বাসী ছিলেন সে মূল্যবোধে আমরা পুরোপুরি বিশ্বাসী নই। বেদ পাঠের জন্য একালে কারো শিরচ্ছেদ কিংবা উত্তপ্ত শলাকা দিয়ে বিদ্ধ করবার ব্যবস্থা করলে সকলেই প্রতিবাদে ফেটে পড়বে। প্রবন্ধে মানুষের মূল অংশে লেখক তাই জানিয়েছেন যে, মানুষের মর্যাদা, এ কথাটা অনেকক্ষেত্রে প্রায় স্বতঃসিদ্ধ ; তবু তা একান্ত বা চরম সত্য হয়নি, সর্বক্ষেত্রে মানুষকে এখানে সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না—এখানে। সাতকোটি মানুষ অচ্ছুত রয়েছে। অচ্ছুত ছাড়াও প্রায় সব দেশেই এখনও চাষি মজুরের সমাজ আর ভদ্রলোকের সমাজ স্বতন্ত্র। মুটে, মজুর, চাকর পিয়াদার পনেরো টাকা মাইনে ও পিঁপড়ের আহারই যথেষ্ট আর মন্ত্রী উজীর এঁদের পনেরোশো টাকা আর হাতির খোরাক না হলে চলবে কেন ? এ কথার অর্থ হল, সব মানুষ মানুষ নয়, কেউ পিঁপড়ে জাতের মানুষ, কেউ হাতি জাতের মানুষ, তবু মোটের ওপর বেদপাঠক শূদ্রদের জন্য শিরচ্ছেদ বা তপ্ত শলাকার ব্যবস্থা করলে অনেকেই সমর্থন করবে না। কারণ—“হাজার হোক মানুষ মানুষ, এও আজ আমরা মানি।”
যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে চলেছে স্বাভাবিকভাবে। তাই পিতা প্রপিতামহদের মূল্যবোধ আর পুত্র-প্রপৌত্রদের মূল্যবোধের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত। সেকালে দেবদেবীতে ছিল অগাধ আস্থা ; একালে মানুষের ওপর সেই আস্থা অর্পণ করা হয়েছে। পূর্বেকার দেব দেবী এবং ধর্মাধর্মের বোধ একালের সাহিত্যে তাই গৌণ হয়েছে এবং মুখ্য হয়েছে মানুষ এবং মানুষ সম্পর্কিত মূল্যবোধ। তাই প্রবন্ধের মধ্যে সেকালের তুলনায় একালের পরিবর্তিত মূল্যবোধের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে—’আমাদের মূল্যবোধ পূর্ব-পুরুষদের মূল্যবোধ থেকে বেশ স্বতন্ত্র, পুরানো মূল্যবোধ বদলে গিয়েছে। এই পরিব একটু মৌলিক—এই মৌলিক পরিবর্তনের ফলে দেব-দেবী ও আগেকার ধর্মাধর্মের বোধ সাহিত্যে গৌণ হয়েছে—সাহিত্যে প্রধান হয়েছে মানুষ পৃথিবী আর জীবন, আধুনিক সাহিত্য মানুষের সাহিত্য – মানবসত্য নিয়েই আধুনিক সাহিত্য।
মূল্যবোধ মানুষের নিজস্ব ব্যাপার হলেও যুগের সঙ্গে তা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট। রামায়ণের যুগের যে মূল্যবোধ আর একালের মূল্যবোধ উভয়ের বিস্তর ব্যবধান। রামায়ণ মহাকাব্যের আদর্শ রামচন্দ্র পত্নীপ্রেমে যে নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তা অতুলনীয়। এরূপ একনিষ্ঠ প্রেম সে যুগে অতুলনীয়। সীতাকে বনবাসে দিতে হলেও দ্বিতীয় মহিষী গ্রহণ না করে স্বর্ণ সীতা দিয়ে তাকে অশ্বমেধ যজ্ঞ সমার্পণ করতে দেখা যায়। প্রজানুরঞ্জনের জন্য সীতাকে বনবাসে পাঠানোর বিষয়টি রামচন্দ্রের উপযুক্ত কাজ হয়েছে কিনা এ নিয়ে এখন প্রতিবাদী মানসিকতার ঝড় ওঠে। বিনা দোষে সীতাকে বনবাসে দেওয়ার ঘটনা তাকে নন্দিত না করে নিন্দিত করে। সেকালের মূল্যবোধ রামচন্দ্রকে হয়তো অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি কিন্তু একালে তাকে সমালোচিত হতেই হয়। যেহেতু একালে মানুষ সম্পর্কে মূল্যবোধ গভীর ও নিগূঢ় রূপ প্রাপ্ত হয়েছে। তাই রামচন্দ্র রূঢ়ভাবে সমালোচিত। ব্যক্তিত্বের মূল্য একালে সেকালের তুলনায় অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই ব্যক্তিগত প্রেম ভালোবাসা সমধিক রূপে প্রতিভাত। বিষয়টির ওপর দৃষ্টিপাত করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক রামায়ণের রামচন্দ্রের এই একনিষ্ঠ পত্নীপ্রেমের প্রসঙ্গের অবতরণা করেছেন এবং সংশয় প্রকাশ করেছেন—“মানুষরা উপযুক্ত কাজ করেছিলেন কি শ্রীরামচন্দ্র? নিজের প্রেম সীতার প্রেম এসব কি রাজার রাজত্ব বা রাজকর্তব্যের থেকে তুচ্ছ? অন্তরের ভালোবাসাকে বাইরের সমাজের অযৌক্তিক দাবির কাছে বলি দেওয়াই কি সত্যধর্ম?”
এ যুগ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের যুগ। স্বাভাবিকভাবেই তাই মানুষের মূল্যবোধের নিগূঢ়তা ও গভীরতার দিক লক্ষ্য করা গেছে। ব্যক্তি অধিকার আমরা মানি বলেই ভালোবাসার অধিকারকে একালে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বুঝেছি ব্যক্তির মর্যাদা প্রদান তথা ব্যক্তি স্বরূপের দাবিটা একালের সবচেয়ে বড়ো সত্য। সেই কারণে রামচন্দ্রের প্রজারঞ্জনের দিকে আমাদের আস্থা নেই, কারণ আমরা ব্যক্তির অধিকারকে আজ মানি, রাজত্বের থেকে ভালোবাসা কম নয় বলে জানি, তাই ডিউক অব উইন্ডসরের রমণীর জন্য সিংহাসন ত্যাগকে নিতান্ত তুচ্ছ মনে করা যায় না। আজ ব্যক্তি স্বাতস্থ্যের যুগে ব্যক্তির অধিকার আমাদের কাছে শ্রদ্ধার বস্তু হয়ে উঠেছে। ব্যক্তির মর্যাদা, ব্যক্তি স্বরূপের দাবি একটা বড়ো সত্য—ব্যক্তির আত্মবিলোপ চরম কিছু নয়। পুরনো সাহিত্যের তুলনায় আজ এদিকে আমাদের আধুনিক সাহিত্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিগত প্রেম ভালোবাসার মূল্য বেশি, এ মূল পরিবর্তন কেবল একই আদর্শের ঊনিশ-বিশে ওঠানামা মাত্র নয়। এতবড়ো পরিণাম গত এই পরিবর্তন যে একেও মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং মৌলিক পরিবর্তন বলে গণ্য করতেই হবে।
সাহিত্যের নদী নিত্য বহমান। বারে বারে সে বাঁক নিচ্ছে। পরিবর্তনটা তাই সাহিত্যে যেন অনিবার্য। মানুষ সম্পর্কে মূল্যবোধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। সেকালের মূল্যবোধ এবং একালের মূল্যবোধ অনেকটা স্বতন্ত্রধারার। মানুষ সম্পর্কে আধুনিক কালের মানুষের মূল্যবোধ গভীর এবং নিগূঢ় হচ্ছে সে সম্পর্কে আমরা নিঃসন্দেহ। ‘বাংলা সাহিত্য ও মানব স্বীকৃতি প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘আধুনিক সাহিত্য’ প্রবন্ধে বস্তুনিষ্ঠ প্রাবন্ধিক গোপাল হালদার দৃষ্টান্ত সহযোগে প্রমাণ করেছেন যে, “মানুষের সম্বন্ধে আমাদের মূল্যবোধ ক্রমশ আধুনিক যুগে গভীর ও নিগূঢ় হচ্ছে….।”
Leave a comment