সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন জুরিস্ট মানহানির বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। স্যামণ্ড এর মতে, আইনগত সমর্থন ব্যতিরেকে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা ও মানহানিকর উক্তি প্রকাশ করাকে মানহানি বলে। আণ্ডার হিল বলেন যে, যথার্থ কারণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা ও মানহানিকর উক্তি প্রকাশের ফলে তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হলে মানহানি বলা হয়। তবে অপেক্ষাকৃত উন্নত ও অধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন উইনফিল্ড। কোন উক্তি প্রকাশের ফলে সমাজের যথার্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির দৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যদি হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় অথবা এরূপ প্রকাশের ফলে সমাজে অনেকে তাকে বর্জন করে বা পরিহার করে চলে, তবে তাকে উইনফিল্ডের মতে মানহানি বলে। ব্ল্যাকবার্ন ও জর্জ এর ভাষায়, সমাজের যথার্থ বিবেচকদের দৃষ্টিতে কারো সুনাম নষ্ট করে এমন মিথ্যা উক্তির প্রকাশনাই মানহানি।
আত্মপক্ষ সমর্থন (Defenses): আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য টর্টের সাধারণ ব্যতিক্রম যেমন সম্মতি, আইনগত ক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী ইত্যাদি ছাড়াও মানহানির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম আছে। এর মধ্যে সত্যতা, নিরপেক্ষ মন্তব্য ও অব্যাহতির অধিকার উল্লেখযোগ্য। মানহানি প্রতিষ্ঠিত করতে সবগুলি উপাদান প্রমাণ করতে হবে কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যে কোন একটির প্রমাণই যথেষ্ট।
সত্যতা (Justification): মানহানিকর উক্তি যদি সত্য প্রমাণিত হয় তবে বিবাদী অব্যাহতি পেতে পারে। তবে সত্য হলেও অহেতুক প্রচারণা আইন সমর্থন করে না। উক্তিটি সত্য হলে তা’ কি উদ্দেশ্যে বা কি অভিপ্রায়ে প্রচার করা হয়েছে তা জানা নিষ্প্রেয়োজন। বাদীকে প্রমাণ করতে হয় না যে, উক্তিটি মিথ্যা বরং উক্তিটি সত্য প্রমাণ করার দায়িত্ব বিবাদীর। উক্তিটি হুবহু সত্য হতে হবে এমন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তবে ঘটনার সাথে মোটামুটি মিল থাকলেই চলবে। তাই কারো এক বছরের জেল হলে, দেড় বছরের জেলের প্রচার মোটামুটি হিসেবে ধরা যায়, কিন্তু অতিরিক্ত বিচ্যুতি হলে সেটা টিকে না। একবারের স্থলে তিনবার কারাবাসের প্রচারণা নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত এবং ব্যর্থ হতে বাধ্য। উক্তি মিথ্যা প্রমাণিত হলে বিবাদীর সরল বিশ্বাসের অজুহাত অচল। ভ্রান্তি, শ্রুতিকথা, ইত্যাদির অজুহাতও অগ্রহণযোগ্য।
নিরপেক্ষ মন্তব্য (Fair Comment): জনস্বার্থ জড়িত বিষয়ে জনগণের নিরপেক্ষ ও যথার্থ মন্তব্য করার অধিকার স্বীকৃত আছে। এ সকল মন্তব্য কারো সুনাম ক্ষুণ্ণ করলে মানহানির দায় হতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। তবে নিরপেক্ষ মন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে নিম্নবর্ণিত উপাদানসমূহ আবশ্যকঃ
প্রথমতঃ এটা একটা মন্তব্য অর্থাৎ মতামত প্রকাশ ঘটনার বর্ণনা নয়।
দ্বিতীয়তঃ মন্তব্যটি নিরপেক্ষ হতে হবে অর্থাৎঃ
(ক) নির্ভুলভাবে ব্যক্ত করতে হবে,
(খ) মন্তব্যটি অবশ্য সৎ হতে হবে, এবং
(গ) কারো অসদাচরণ বা অসৎ অভিপ্রায় সম্পর্কে মত প্রকাশ, ঘটনার দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।
তৃতীয়তঃ যে বিষয়ের উপর মতামত প্রকাশ করা হয়েছে, তা অবশ্য জনস্বার্থ বিজড়িত হতে হবে।
বহুল স্বীকৃত মত অনুযায়ী একটি মন্তব্যকে তখনই নিরপেক্ষ বলা যায় যখন সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন কিছু ব্যক্তি তাকে নিরপেক্ষ মন্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে। নুরুদ্দিন বনাম হামিদুল হক চৌধুরী মামলায় বাংলাদেশের হাই কোর্ট এই অভিমত পোষণ করেন যে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে মন্তব্য সম্পূর্ণ নির্ভুল হবার প্রয়োজন নেই।
অব্যাহতির অধিকার (Privilege): কোন কোন ক্ষেত্রে মানহানিকর উক্তি করেও দায়ী হতে হয় না, কারণ আইনে বিশেষ অধিকার দেয়া হয়। এ ধরনের বিশেষ অধিকারকে ‘প্রিভিলেজ’ বলা হয় এবং যে ক্ষেত্রে এ সকল অব্যাহতি পাওয়া যায় তাকে অব্যাহতির ক্ষেত্র বলা হয় (Privileged occasion)। অব্যাহতির অধিকার দু’ধরনেরঃ চূড়ান্ত অব্যাহতি ও সীমিত অব্যাহতি।
চূড়ান্ত অব্যাহতি (Absolute privilege): যে সকল ক্ষেত্রে কোন প্রকার মানহানিকর উক্তির জন্য তা যতই মিথ্যা বা বিদ্বেষমূলক প্রকাশনা হোক না কেন, উক্তিকারীকে কোনক্রমেই মানহানির জন্য দায়ী করা যায় না তাকেই চূড়ান্ত অব্যাহতি বলা হয়। বিবাদী যদি চূড়ান্ত অব্যাহতির অধিকার প্রমাণ করতে পারে তবে মানহানির দায় হতে সে সম্পূর্ণ মুক্ত।
চূড়ান্ত অব্যাহতির ক্ষেত্রেঃ
(ক) বিচার কার্যে জজ, এ্যাডভোকেট, জুরী, সাক্ষীগণ কর্তৃক প্রদত্ত বক্তব্য।
(খ) সংবাদপত্রে বিচার কার্যের নিরপেক্ষ ও নির্ভুল প্রচার।
(গ) সংসদে অনুষ্ঠিত আলোচনা।
(ঘ) সংসদের অনুমতিতে প্রচারিত সংসদীয় কাগজপত্র।
(ঙ) রাষ্ট্রীয় কার্য নির্বাহের ক্ষেত্রে সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ। এবং
(চ) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক আদান প্রদান।
সীমিত অব্যাহতি (Qualified privilege): কতকগুলি ক্ষেত্রে বিবাদী অব্যাহতির অধিকার ভোগ করতে পারে যদিও চূড়ান্তভাবে নয়, সীমিতভাবে অর্থাৎ শর্তসাপেক্ষে। এই শর্ত হচ্ছে যদি প্রচারণা বিদ্বেষমূলক না হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিদ্বেষ মূলক প্রচারণা হলে অব্যাহতির অধিকার হতে বঞ্চিত হতে হয়।
সীমিত অব্যাহতির ক্ষেত্রসমূহঃ
(ক) কর্তব্য পালনে প্রকাশিত বক্তব্যঃ কর্তব্য -সামাজিক, নৈতিক বা আইনগত হতে পারে। কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্যান্য কর্মকর্তার তদন্ত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্য আইনগত কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে। বিদ্বেষমূলক না হলে এ বক্তব্যের জন্য মানহানির মামলা টিকে না। কোন ছেলের চরিত্র সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পিতামাতা যদি তাদের সন্তানদের সতর্ক করে, তবে তা নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে এবং বিদ্বেষমূলক না হলেও এ ক্ষেত্রেও অব্যাহতি পাওয়া যায়। গৃহভৃত্যের আচরণ সম্পর্কে অতিথিকে সতর্ক করা সামাজিক কর্তব্য এবং এ কর্তব্য পালনে প্রচারিত বক্তব্য বিদ্বেষমূলক না হওয়া আবশ্যক।
(খ) আত্মরক্ষার জন্য প্রদত্ত বিবৃতিঃ বিবাদী যদি তার আত্মরক্ষার জন্য কোন কিছু প্রকাশ করে যা বাদীর জন্য মানহানিকর হতে পারে, তবে সেক্ষেত্রেও বিবাদী সীমিত অব্যাহতির অধিকারী।
(গ) জনসভা বা অন্যান্য অনুষ্ঠানের নিরপেক্ষ ও নির্ভুল বিবৃতি।
(ঘ) আইনজীবী ও মক্কেলদের মধ্যে পেশাগত আলোচনা।
Leave a comment