প্রশ্নঃ মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলাে সংস্কৃতি- (জোনস) উক্তিটি আলােচনা কর।

অথবা, মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলাে সংস্কৃতি- (জোনস) উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষসাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণালি সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্যদিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।

জোনসের উক্তিটির বিশ্লেষণঃ জোনস মূলত পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানী। তিনি তার উল্লেখযােগ্য Basic Principles of Sociology গ্রন্থে বলেন, ‘মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলাে সংস্কৃতি।’ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে টিকে রয়েছে এবং সৃষ্ট জিনিস দিয়েই মানুষ তার অতি প্রয়ােজনীয় চাহিদা পূরণ করে থাকে। মূলত এই কারণেই মানুষকে সৃষ্টিশীল জাতি হিসেবে মূল্যায়ণ করা হয়ে থাকে। নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের সৃজনশীলতাকে সামনের দিকে নিয়ে যায়। মূলকথা হচ্ছে মানুষ প্রতিনিয়ত সৃজনশীলতাকে বরন করছে। যা তার নিজস্ব সৃজনশীলতাকে সব সময় সামনের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে যে জিনিসপত্রগুলাে ব্যবহার করে তা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রাথমিক পর্যায় ঐ সকল জিনিসপত্রের যে অবস্থা ছিল বর্তমানে তা আরাে উন্নত হয়েছে। কেননা মানুষ প্রতিনিয়ত সৃজনশীলতা দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ এবং উৎকর্ষতা চেয়েছে। নিম্নে বিভিন্ন তাত্ত্বিকগণের মতামতের ভিত্তিতে জোনসের উক্তিটির স্বার্থকতা নিরূপণের চেষ্টা চালানাে হলাে-

বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী জিসবার্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Fundamentals of Sociology’ (p-286) গ্রন্থে বলেন, “This complex whole of objects and ways of behaviour of material and immaterial interests and satisfactions, has been designated by early and modern anthropologists by the name of culture.” অর্থাৎ “এ সকল বস্তু এবং আচরণের ধারা, পার্থিব ও অপার্থিব স্বার্থ এবং সন্তোষ এসকল কিছুর জটিল সমগ্রতাকেই প্রাচীন ও আধুনিক নৃতত্ত্ববিদগণসংস্কৃতি নামে অভিহিত করেছেন।”

নৃ-বিজ্ঞানী ডিউই তার Democracy and Education (p-142) গ্রন্থে বলেন, “Culture means at least something cultivated something ripened, it is opposed to the raw and crude.” অর্থাৎ সংস্কৃতি বলতে বুঝায় একটা কিছু যার অনুশীলন করা হয়েছে, যা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এ হচ্ছে অপরিণত ও অমার্জিতের বিরােধী ।”

নৃ-বিজ্ঞানী ম্যালিনস্কি তার A Scientific theory of Culture (P-67) গ্রন্থে বলেন, “As the handiwork of man and is the medium through which he achieves his end.” অর্থাৎ “মানুষের তৈরি বস্তুও একটি উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্যসাধন করে।”

সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ম্যাকেঞ্জি তার ‘Outline of Social Philosophy’ (P 22) গ্রন্থে বলেন, “সংকীর্ণ অর্থে এ হলাে সমাজের জীবনে দীক্ষা লাভ করা, ব্যাপকতর অর্থে এ হলাে মানুষের আধ্যাত্মিক প্রকৃতিকে উন্নত করা, যার জন্য সমাজজীবন হলাে একটি উপায় মাত্র।”

সি সি নর্থ তার ‘ Social Problems and Social Planings’ (P-19) গ্রন্থে বলেন, “The instruments constituted by man to assist him in satisfying his wants.” অর্থাৎ “সংস্কৃতি মানুষের সৃষ্ট সেসব উপায় যেগুলাে তাকে তার অভাব মেটাতে সহায়তা করে।”

সমাজবিজ্ঞানী পি. এ. সরােকিন তার “Social and Cultural Dynamics” গ্রন্থে বলেন, “দুটি ব্যক্তির চেতন ও অচেতন ব্যবহারের যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া তার ফলে সৃষ্ট ও পরিবর্তিত যা কিছু তার সমগ্রতাই সংস্কৃতি।” তার মতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, কলা সবই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।

সংস্কৃতির সর্বাপেক্ষা গ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টেইলর। তিনি তার Primitive Culture’ (P-1) গ্রন্থে বলেন, Culture is that complex whole which includes knowledge, belief, art, morals, law, custom and any other capabilities acquired by man as a member of society.” অর্থাৎ সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজস্থ মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নীতি, নিয়ম, সংস্কার ও অন্যান্য যেকোনাে বিষয়ে দক্ষতার জটিল সমাবেশ। যা সে সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জন করে।

মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী, উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মৌল কাঠামাে যাকে Basic structure বলা হয়। আর এ মৌল কাঠামাের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সমাজের ওপরিকাঠামাে- যাকে Super structure বলা হয়। মার্কস Super Structure কে সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ মতবাদ অনুযায়ী রাষ্ট্র, ধর্ম, শিল্পকলা, আইন, মূল্যবােধ, দর্শন ও অন্যান্য সামাজিক আচার-প্রথা ও অনুষ্ঠান সবই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামােতে যখন পরিবর্তন আসে, সে পরিবর্তনের ধারা ওপরিকাঠামােতে গিয়ে পড়ে। সে মতে মৌল কাঠামাে বা অর্থনৈতিক কাঠামাের পরিপূরক সংস্কৃতি সাজে গড়ে ওঠে। এজন্য সামন্ত অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছিল সামন্ত সংস্কৃতি। আবার পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ধারা প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠেছে পুঁজিবাদী সংস্কৃতি।

পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, সামগ্রিক বিশ্লেষণে বলা যায় যে মানুষ শুধুমাত্র সৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। তাই সামগ্রিক জীবনযাত্রার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় মানুষ যা কিছু আবিষ্কার বা সৃষ্টি করেছে তার সম্মিলিত রূপই হলাে সংস্কৃতি। কেননা মানুষ জীবনে চলার পথে যখনই বাধার সম্মুখীন হয়েছে তখনই সৃষ্টির মাধ্যমে সে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। এবং মানব সভ্যতাকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে গেছেন। মূলত সামগ্রিক সৃষ্টির সমন্বয়ে আমাদের সংস্কৃতি। তাই সমাজবিজ্ঞানী জোন্স বলেন, ‘Culture is the sum total of mans creations.’ অর্থাৎ মানব সৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলাে সংস্কৃতি।