প্রশ্নঃ মানব জাতির চরিত্র গঠনে মহানবী (স)-এর কৃতিত্ব আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ মহানবী (স) ছিলেন বিশ্ব মানবের মুক্তিদূত, জগতের জন্য রহমত। তার আদর্শের ছোঁয়ায় বর্বর আরব জাতি অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের বুকে গৌরবদৃপ্ত জাতিতে পরিণত হয়। মহানবী (স) ছিলেন শ্রেষ্ঠ জাতি, সংগঠক। আরব বিশ্বসহ সমগ্র মানব জাতির চরিত্র গঠনে মহানবী (স)-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। জগৎ বিলয় না হওয়া পর্যন্ত তার এ অমর কীর্তি পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। ঐতিহাসিক লেনপুল যথার্থই বলেছেন, “নিঃসন্দেহে মহানবী (স) ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক ও জাতি সংগঠক।”

মানব চরিত্র গঠনে মহানবী (স)-এর অবদানঃ মানব চরিত্র গঠনে মহানবী (স) যে বৈপ্লবিক কর্মসূচি সম্পাদন করেছিলেন তা নিম্নরূপ-

১. একত্ববাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধকরণঃ মহানবী (স) তাওহীদের সুমহান বাণী প্রচারের মাধ্যমে বর্বর আরব জাতিকে পৌত্তলিকতা বিমুখ করে সুসভ্য, সচ্চরিত্রবান, খােদাভীরু জাতিতে পরিণত করেন। তার একত্ববাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই আরব জাতি একটি সুসংগঠিত জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।

২. ভ্রাতৃত্ববােধ সৃষ্টিঃ “সকল মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই”- এ মূলমন্ত্রে আরব জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে মহানবী (স) প্রাণান্তকর প্রয়াস চালান। তিনি ইসলামের আদর্শ প্রচার করে সব মানুষকে এক পতাকাতলে সমবেত করে পরস্পর ভ্রাতৃত্ববােধের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। আরবের লােকদের মাঝে ভ্রাতৃত্ববােধ সৃষ্টির কারণে তাদের দীর্ঘ দিনের অন্তর্দ্বন্দ্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়।

৩. মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধকরণঃ মদ্যপান তৎকালীন আরব সমাজে আভিজাত্য ও বীরত্বের প্রতীক ছিল। নিজের আভিজাত্য ও বীরত্ব প্রকাশের জন্য তারা যত্রতত্র মদ্যপানে জড়াত। মদ্যপানের কারণে তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিভিন্ন প্রকার অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতাে, যা সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলত। মহানবী (স) মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে বর্বর আরব জাতির চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন করেন।

৪. নারীদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণঃ তদানীন্তন আরব সমাজে নারীদের নিছক সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম ও ভােগ্যপণ্য হিসেবে চিন্তা করা হতাে। নারীদের কোনাে সামাজিক অধিকার স্বীকত ছিল না। নারীদের পিতা ও স্বামীদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করাসহ তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানাে হতাে। মহানবী (স) তখন আরব সমাজে প্রচার করলেন, “তােমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।” তিনি নারীদের সামাজিক অধিকারের স্বীকৃতি দান করে পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের অধিকার নিশ্চিত করেন।

৫. মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাঃ সে যুগে জোর যার মুলুক তার এ নীতির অনুসরণ করা হতাে। এতে দুর্বলরা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হতাে। মানবতার দরদি নবী (স) তা উচ্ছেদ করে সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।

৬. সুদপ্রথা বিলুপ্তকরণঃ তৎকালে আরব সমাজে সুদপ্রথা ছিল একটি জমজমাট ব্যবসায়। মহাজনগণ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করত। ফলে সুদ পরিশােধ করতে গিয়ে অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে ভিখারী হয়ে যেত। এভাবে সুদের ব্যবসায়ের মাধ্যমে বহুমুখী নির্যাতন চালানো হতাে। মহানবী (স) সুদপ্রথা বিলুপ্ত করেন। ফলে আরব সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বিশৃংখলা বিদূরিত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

৭. কুরআনভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রবর্তনঃ হযরত (স) জাহেলী যুগের সকল অর্থব্যবস্থা পরিবর্তন করেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তিনি এমন অর্থনীতি প্রবর্তন করে যা ছিল মানবজাতির জন্য চিরকল্যাণকর।

৮. যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রচলনঃ অর্থনৈতিক দৈন্যদশা বিদূরিত করে মহানবী (স) সমাজে সার্বিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সৌধ বিনির্মাণের লক্ষ্যে যাকাত প্রথার প্রচলন করেন। এর মাধ্যমে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করেন। ফলে সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার পরিবর্তে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রচলন হয়। সমাজের গরিব শ্রেণির লােক অর্থনৈতিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পায়। মহানবী (স)-এর যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রচলনে আরব সমাজে প্রচলিত সুদী অর্থব্যবস্থার বিলােপ ঘটে।

৯. শােষণমুক্ত অর্থনীতিঃ মুহাম্মদ (স) আরব সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে শােষণমুক্ত সুষ্ঠু অর্থনীতি উপহার দিয়েছিলেন। যা আজও জগতে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

১০. কুসংস্কারের অবসানঃ তৎকালে আরব সমাজে বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। এগুলাে সমাজে বিভিন্ন প্রকার কলহের সূত্রপাত ঘটাত। ফলে দ্বন্দ্ব সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ত, মানুষের চরিত্রের অধঃপতন ঘটত। মহানবী (স) এসব কুসংস্কার বিদূরিত করে আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

১১. অশ্লীলতা ও অনাচারের মূলােৎপাটনঃ মহানবী (স) সমাজ থেকে যাবতীয় অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, অনাচার, পাপাচার, ব্যভিচার, মদ-জুয়া, সুদ-ঘুষ ইত্যাদির মূলােৎপাটন করে একটি পবিত্র সুন্দর কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।

১২. মানবতাবােধের উন্নয়ন সাধনঃ মহানবী (স) তৎকালীন আরবে যাবতীয় অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, সংঘাত কলহের অবসান ঘটান, মানুষে মানুষে মানবতাবােধের উন্নয়ন ঘটান। তিনি ঘােষণা দেন, সকল মানুষ সমান।

১৩. ন্যায়বিচারঃ মহানবী (স) ন্যায়বিচার তথা ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠন করেন। যাবতীয় অন্যায় অবিচারের মূলােৎপাটন করে সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৪. বাক ও বিবেকের স্বধীনতাঃ মহানবী (স) মদিনা রাষ্ট্রে বাক ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রয়ােজনবােধে একজন সাধারণ নাগরিকও সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত প্রশাসনিক কর্মকর্তার কার্যকলাপের সমালােচনা করতে পারতেন। ফলে সরকারি প্রশাসন সর্বপ্রকার স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত ছিল।

উপসংহারঃ মহানবী (স) কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচিগুলাে ছিল আরব সমাজ তথা সারা বিশ্বের মানব সম্প্রদায়ের চরিত্র গঠনের সর্বোত্তম পন্থা। জগতের সকল কীর্তিমান লােকদের নিকট তার গৃহীত নীতিমালা আজও ভাস্বর হয়ে আছে।