সাহিত্য হল দর্পণ বিশেষ। এখানে যেমন ব্যক্তির চিত্র ফুটে উঠে তেমনই সমাজের, মানববোধের চিত্র চিত্রিত হতে পারে। মধ্যযুগের সাহিত্যগুলি পড়লে তারমধ্যে তৎকালীন সমাজজীবনের ও মানবধর্মের চিত্র মেলে। ‘মঙ্গল কাব্য’- এ সমসাময়িক বাঙালী জীবনের বিভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্য’।

বাংলা দেশের বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে একটি সামাজিক প্রয়োজনেই সম্ভবত সৃষ্টি হয়েছিল মঙ্গলকাব্যগুলি। একদা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—’দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা’ বস্তুত এটা সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুকরণ। মানবসস্তান শ্রীরামচন্দ্র, সীতা, শ্রীকৃষ্ম কিংবা বাঙালীর হৃদয়মথিত শ্রীচৈতন্যদেব দেব মহিমায় উন্নীত। মানবের আকুল আহ্বানে সাড়া দেবার জন্য মর্তে তাদের আগমন। অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যে শিব-পার্বতী, হর-গৌরী, চণ্ডী, মনসার কাহিনি অচ্ছেদ্য ভাবে প্রকাশিত। বস্তুত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে কবি মুকুন্দরাম যে দেব দেবীর জীবন পট উদ্ঘাটন করেছেন তা যে কোন বাঙালীর নিত্যপরিচিত নিম্নবিত্ত মানব সংসারেরই প্রতিরূপ। বিবাহের পর পিতৃগৃহে যাবার জন্য যে আকুতি তা দেবী তথা কন্যা সতীর মধ্যেও লক্ষিত হয়েছে এবং মানবিক আবেদনকে ফুটিয়ে তুলেছে—

“অনুমতি দেহ হর    যাইব বাপের ঘর 

যজ্ঞ মহোৎসব দেখিবারে।।”

আধুনিক বাঙালী ঘরের বিবাহিতা কন্যার মনের সাধ, বাপেরবাড়িতে গিয়ে দুদণ্ড সাংসারিক জীবন থেকে রেহাই পাবে এবং নিশ্চিন্তে মায়ের হাতের রান্না খাবে। সতীর উক্তিতে তা প্রকাশ পায়—

“সুমঙ্গল সূত্র করে    আইনু তোমার ঘরে

পূর্ণ হৈল বৎসর পাঁচসাত

দূর কর বিসম্বাদ   পূরহ মনের সাধ

মায়ের রন্ধনে খাব ভাত।।”

এখানে শিব হলেন এক সামাজিক মানুষ, তাই শ্বশুর দক্ষ যজ্ঞে নিমন্ত্রণ না করায় সতীকে পিতৃগৃহে যেতে দেন নি, লোক নিন্দার ভয়ে। সতীকে যাবার অনুমতি না দিওয়া বাঙালি মেয়ের মতো সতী রোষ প্রকাশ করেছেন—

“সক্রোধ হইয়া বামা    চলিলা ভ্রুকুটি ভীমা

একাকিনী বাপের বসতি।”

এ চিত্রে কোনও দৈব মহিমা ব্যক্ত নয়, সম্পূর্ণ মানবসংসারের ঘরোয়া চিত্র এটি।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দেব-দেবী চরিত্র বিশ্লেষণে মানবধর্মিতা বিষয়ে ড. অরবিন্দ পোদ্দার বলেছেন—“মঙ্গলকাব্যের বাইরের ছাঁচটা পৌরাণিক কিন্তু তা অস্তর সম্পর্কে মানবিক । বিভিন্ন দেবদেবীর জন্ম, ঘর-সংসার, দ্বন্দ্ব, ও প্রাধান্য লাভের উপাখ্যান মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য—এটাই তার বাইরের রূপ।” সুতরাং মঙ্গলকাব্যের দেব দেবীর অন্তরালে মানবিকতা প্রতিষ্ঠিত করাই কবির মুখ্য বিষয়।

সামাজিক পটভূমিতে রচিত হয়েছিল মঙ্গলকাব্য। তৎকালীন সামাজিক পরিমণ্ডলে মুকুন্দরাম বাস্তবতাবোধকে রূপায়িত করেছেন। সমগ্র চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সমাজচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আখেটিক খণ্ডে কালকেতুর নগর পত্তন অংশে বুলান মণ্ডল কলিঙ্গের সব প্রজাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছে—তোমরা এখানে চাষ কর, সুদ দিতে হবে না। প্রতি হালে এক টাকা করে দেবে। ভয় পাবার কারণ নেই। এই সব উক্তির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটা আদর্শকে দেখতে পাই। আরও একটি সামাজিক বৈচিত্র্যের প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়—সেকালে বৃহৎ নগর ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ। এই জন্যই কালকেতু বিভিন্ন জাতি বর্ণ, বৃত্তি ও জীবিকার লোককে গুজরাটে বসবাসের সুবিধা করে দিয়েছিলেন গুজরাট নগরে নানা জাতির মধ্যে মুসলমানকেও সাদর সম্ভাষণে গ্রহণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে জাতি বৈষম্যের কোনও ব্যাপার ছিল না।

বলাবাহুল্য কালকেতুর কাহিনিতে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের সামাজিক জীবনের কথা প্রকাশ পায়–ব্যাধ জাতি বনে জঙ্গলে শিকার করে বেড়াত, মাংস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত ফুল্লরার বারমাস্যাতে আমরা সমাজ জীবনের নিদারুণ দুঃখ দারিদ্র্যের ছবি ফুটে উঠেছে দেখি।

“যেদিন যতেক পায়   সেদিন তাহাই খায়

দেড় অন্ন নাহি থাকে ঘরে

তিনখান শরাসন    বিনা আর নাহি ধন

বান্ধা দিতে পারে না উধারে।।”

নিরন্ন সহায়হীন পরিবারে এর চেয়ে আর বড় দুগর্তি আর কি হতে পারে? অসময়ে কিছু জিনিস বন্ধক দিয়ে যে সংসার চালাবে তারও উপায় নেই। তবু শ্বশুর শাশুড়ী, স্বামীর প্রতি কর্তব্য করে ফুল্লরা। তার ভাগ্যে অর্ধেক সময় অন্নই জোটে না—

“নিদয়া রসাজ্ঞা ধরে    ফুল্লরা রন্ধন করে 

আগে ধর্মকেতুর ভোজন।।

কবি মুকুন্দ ছিলেন কৃষক এবং গ্রামের মানুষ। তাই তাঁর কাব্যে গ্রাম্য সমাজব্যবস্থার সার্থক প্রতিফলন রূপায়িত হয়েছে। সমাজ এবং জীবন সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দ্বারা সাহিত্যর সঙ্গে সমাজবোধের সমন্বয় সাধন করেছেন। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পূর্ণাঙ্গ চিত্রাঙ্কণে কবিকঙ্কণের সমতুল্য কেউ নেই। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, বাস্তবতাবোধের আঙিনায় দাঁড়িয়ে কালের আর্থ-সামাজিক ভূমি ব্যবস্থার বিশ্লেষণে, উদার মানবিকতা এবং অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গির জন্য মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর সমগ্র কাব্যটির মধ্যে অদ্বিতীয় শিল্পীর সম্মান লাভ করেছেন।