মুদালিয়র কমিশন শিক্ষার লক্ষ্যের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই শিক্ষার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও অগ্রগতির কথা বলেছে। সর্বাঙ্গীণ বিকাশ তখনই হবে যখন আমরা শিক্ষার্থীকে সৎ ও দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী করে গড়ে তুলতে পারব। এজন্য চরিত্র গঠনের শিক্ষা বিশেষভাবে দেওয়া হবে। একজন সৎ, দৃঢ় চরিত্রের মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। যাতে তারা ভবিষ্যতে সমাজজীবনে নিজেকে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এবং সামাজিক জীবনে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। সমাজের বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করবে। নিজের মধ্যে যে সৃজনশীল প্রতিভার সম্ভাবনা আছে তার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে পারে। একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য নাগরিকতা প্রশিক্ষণ লাভ করবে। দেশের গণতান্ত্রিক সমাজচেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে সমাজের সকল মানুষ সমান এবং সকলের সমান অধিকার এই চিন্তায় নিজে যেমন উদ্বুদ্ধ হবে তেমনি অন্যদের উদ্বুদ্ধ হতে সাহায্য করবে। যা গণতান্ত্রিক চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বৈষম্যকে দূর করতে সাহায্য করবে। নৈতিকতার মনোভাব ও আদর্শকে জীবনে শিক্ষার্থীরা যাতে গ্রহণ করতে পারে তার বিশেষ ব্যবস্থা করার কথা পাঠক্রমে বলা হয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে দেশের উপযুক্ত নেতৃত্ব গ্রহণের যোগ্যতা সৃষ্টি করাই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। সৎ আঞ্চলিক নেতাগণ জনসাধারণের মনে নতুন দেশ গঠনের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে।
(১) চরিত্রবান মানুষ তিনিই, যিনি স্বার্থপরতা ত্যাগ করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে একত্রে বাঁচার আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।
(২) এরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক দিক থেকে সুস্থ এবং এদের মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক।
(৩) চরিত্রবান মানুষ গণতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী এবং উদার মনের অধিকারী হন।
(৪) চরিত্রবান মানুষ সামাজিক গুণের অধিকারী হন। সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সৌজন্যবোধ, সেবামূলক মনোভাব প্রভৃতি সামাজিক গুণ এদের মধ্যে প্রকট থাকে।
মুদালিয়র কমিশন সুপারিশ করেছিল যে, শিক্ষার্থীদের ওই সমস্ত গুণের অধিকারী করতে এবং শৃঙ্খলা পরায়ন চারিত্রিক বিকাশ ঘটাতে বিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর আয়োজন করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে। যেমন-
(১) NCC, NSS, স্কাউট প্রভৃতির ব্যবস্থা করা। বিদ্যালয় পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা।
(২) খেলাধুলা, শিক্ষামূলক ভ্রমণ, বিতর্ক সভা প্রভৃতি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী আয়োজন করা। এগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস জাগবে এবং নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
(৩) ফাস্ট এড শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা।
(৪) বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী, পাঠ্য বহির্ভূত বিভিন্ন কার্যের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বদানের সুযােগ করে দেওয়া।
(৫) নিজেদের দক্ষতা বিকাশ যাতে করতে পারে শিক্ষার্থীদের সেই সুবিধা প্রদান।
মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীদের যে বয়সে উপনীত হয় তা হল বয়ঃসন্ধিকাল (Adolescence)। বয়ঃসন্ধিকালের বিকাশ ও চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা পরিচালিত হবে। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের দেহ ও মনে এক অস্থিরতা, চঞ্চলতা, উদ্দামতা লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। দেশের সার্থক শিল্পায়নের জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন।
(১) কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হবে।
(২) দেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষির উপর নির্ভরশীল। এইজন্য কৃষি বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে শিক্ষার্থীদের কৃষিবিদ্যা, উদ্যান নির্মাণ, পশুপালন, কুটির শিল্প শিক্ষাদানের বিশেষ ব্যবস্থা করে উৎসাহিত করা হবে।
(৩) মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য আসবে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত সুযোগ সুবিধা দানের মাধ্যমে তাদের উৎসাহিত করা হবে।
(৪) শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় স্থাপন করে তাদের শিক্ষা দিয়ে সমাজে তাদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে।
(৫) শিক্ষা সমাপ্তির পূর্বে যারা বিদ্যালয় ত্যাগ করছে সেইসব বিদ্যালয়ের ছোট শিশুদের ১৪ বছর পর্যন্ত শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য নৈশকালীন বিদ্যালয় স্থাপন করে তাদের শিক্ষাদান করা হবে।
(৬) এই শিক্ষা হবে অবৈতনিক এবং স্থানীয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা তা পরিচালিত হবে।
(৭) যে অঞ্চলে পিতা-মাতাকে কাজের জন্য বাইরে থাকতে হয়। সেখানে দিবা আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের আহারের ব্যবস্থা করা হবে।
(৮) কারিগরি বিদ্যালয় গুলোতে বেশি সংখ্যায় বহুমুখী বিদ্যালয়ের সঙ্গে স্থাপন করতে হবে।
(৯) বিভিন্ন শিল্প শহরের কেন্দ্রীয় কারিগরি স্কুল স্থাপন করতে হবে।
(১০) মাধ্যমিক স্তরে, নিখিল ভারত কারিগরি শিক্ষা সংস্থার সাহায্য নিয়ে কারিগরি শিক্ষা পাঠক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
(১১) শহরের বড়ো বড়ো শিল্পাঞ্চলের পাশে কারিগরি শিক্ষালয় স্থাপন করতে হবে।
Leave a comment