মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে মুদালিয়র কমিশন তার প্রতিবেদনে মন্তব্য করে, “আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা লক্ষ্যহীনতার শিকার।” লক্ষ্যহীনতা শব্দটিকে কমিশন তীব্র হতাশার প্রতীকরূপে ব্যবহার করেছে। বাস্তবিকই প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল সংকীর্ণ। কোনো প্রকারে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে একটি চাকুরি লাভ করা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষায় প্রবেশ করাই ছিল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য; আর অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল বেশ কিছু শিক্ষিত দেশি কেরানি গড়ে তােলা। তাই মুদালিয়র কমিশনের সদস্যগণ স্বাধীনোত্তর ভারতের স্বাধীন নাগরিকের জীবন সংগ্রামে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাকে নতুনরূপে গড়ে তোলেন। ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা কথা বিবেচনা করে সামাজিক দায়িত্ব পালনে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা এবং সুনাগরিক হিসেবে তার সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটানোর জন্য কমিশন যেসকল লক্ষ্য নির্ধারণ করে, তা হল—
(১) স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাস্তর গঠন: মুদালিয়র কমিশনের মতে, মাধ্যমিক শিক্ষাকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষা স্তর রূপে তুলে ধরা হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
(২) গণতান্ত্রিক সুনাগরিক সৃষ্টি : কমিশনের মতে, মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য হল দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ আদর্শ গণতান্ত্রিক নাগরিক সৃষ্টি করা। তাই পাঠক্রম রচনার সময় এ বিষয়ে সজাগ থাকা প্রয়ােজন।
(৩) শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি সত্তার বিকাশ সাধন : শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব গঠন (Personality) ও চরিত্রবান মানুষ তৈরি করাই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
(৪) জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি : মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল দেশের জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করা। তাই কমিশন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে জীবিকা উপার্জনের উপযােগী শিক্ষাদান করার পক্ষপাতী ছিল; যাতে তারা এক সমৃদ্ধিশালী ভারত গঠনে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে।
(৫) নেতৃত্বদানের ক্ষমতা বিকাশ : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামোকে অক্ষুন্ন রাখতে হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব গ্রহণের যোগ্যতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কমিশনের মতে, সৎ, পরিশ্রমী, নির্ভীক, উদার ও স্বনির্ভর আঞ্চলিক নেতারাই জনসাধারণের মনে দেশ গঠন সম্পর্কে আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সমস্ত দুঃখ কষ্ট, আনন্দ বা ত্যাগ স্বীকারের মধ্যে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিবেশ করেছে কমিশন। এই উদ্দেশ্যে কমিশন ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত পাঠগ্রহণের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষার দুটি বিশেষ লক্ষ নির্ধারণ করেছিল। যেমন—
- এই শিক্ষা গণতান্ত্রিক নাগরিকতার বিকাশে সাহায্য করবে। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের বিকাশ, বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জন ইত্যাদি হবে শিক্ষার লক্ষ্য,
- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাস্তরে প্রবেশের প্রস্তুতি নিতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে। এ ছাড়া যারা কর্মজগতে প্রবেশে ইচ্ছুক, তাদেরও দিশা দেখাবে এই মাধ্যমিক স্তর ভিত্তিক শিক্ষা।
(৬) বয়ঃসন্ধিকালের চাহিদা পূরণ : মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য শুধুমাত্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। বয়ঃসন্ধিকালের চাহিদা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বয়ঃসন্ধিকালের চাহিদা ও বিকাশের ধারা মাথায় রেখে মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য প্রসঙ্গে কমিশন নিম্নলিখিত সুপারিশ গুলি করে—
- বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ পূর্ণতা পেতে থাকে। তারা সবসময় সক্রিয় থাকতে চায়। তাদের সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সক্রিয়তা মূলক কর্মসূচী ব্যবস্থা করতে হবে।
- বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে মেয়েদের সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। তাদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ বিকশিত করার জন্য বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যাবলি, যৌন কার্যাবলী, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক কার্যাবলী ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থীদের সামাজিক, সহযোগিতা, আচার-আচরণ, শৃঙ্খলাবোধ প্রভৃতি মানবিক গুণাবলির বিকাশ সম্ভব হবে।
- এই বয়সে ছেলেমেয়েরা নানা প্রক্ষোভ ও আবেগের সম্মুখীন হয়। প্রক্ষোভ ও আবেগকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ব্যাহত হবে। তাই মাধ্যমিক স্তরে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।
- কিশাের-কিশােরী আত্মনির্ভরশীল হতে চায় এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করে। মাধ্যমিক স্তরে তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষার আয়োজন করা প্রয়োজন।
- বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের যৌন কৌতূহল প্রশমনের জন্য মাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন কৃষ্টিমূলক, সাংস্কৃতিক কার্যাবলির ব্যবস্থা করতে হবে।
(৭) গণসংস্কৃতি পুনরুজ্জীবন : সংস্কৃতি সমৃদ্ধির পরিচয়, তাই শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে ভারতীয় গণসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটানোর মাধ্যমিক শিক্ষার অপর এক বিশেষ লক্ষ্য, যার দ্বারা দেশ সমৃদ্ধিশালী হতে পারে।
(৮) সাংস্কৃতিক বিকাশে সহায়তা : মাধ্যমিক শিক্ষার আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির দিকে উৎসাহ তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে এগুলি খুবই প্রয়োজনীয়। এগুলো বাদ দিয়ে জাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তােলা সম্ভব নয়।
(৯) মানবিক গুণাবলির বিকাশ : সৃজনশীলতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, উৎসাহ, কর্মপ্রেরণা প্রভৃতি মানবিক গুণের বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনপথ মসৃণ করা মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে কমিশন মনে করে।
(১০) কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠন : শিক্ষা মানুষকে পরিমার্জিত করে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার একটি বিশেষ লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে তারা কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে অংশ নিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান শিক্ষার প্রস্তাব।
(১১) ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব গঠন : এমনভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদার ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হতে পারে।
(১২) অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দান : মাধ্যমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণলক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাদানে সাহায্য করা, যাতে তারা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে।
(১৩) প্রক্ষোভ মূলক সমন্বয়সাধন : চারিত্রিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত প্রাক্ষোভিক নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি। তাই মাধ্যমিক স্তরে এমন বিষয় বা কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রক্ষোভগুলি প্রকাশিত ও বিকশিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ পায়।
(১৪) উপযুক্ত বিদ্যালয় পরিবেশ সৃষ্টি : বিদ্যালয়ের শিখন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং শিক্ষার্থীরাও যাতে বিদ্যালয়ের গতিশীল জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে— শিক্ষার্থীদের সেই ধরনের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
এ ছাড়া— সৌন্দর্যায়ন সৃষ্টি, চিন্তন ক্ষমতার বিকাশ, বিশ্ব নাগরিকত্ব গঠন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রভৃতি বিষয় গুলো মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য বলে কমিশন মনে করে। স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য দৈহিক, মানসিক, সামাজিক বুদ্ধি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ্য নাগরিক গড়ে তোলাই মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য।
Leave a comment