আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়– আবদুল হাকিম
ভূমিকা
মানুষ ভাবের বিনিময় করে ভাষার মাধ্যমে। এ ভাষার গুণেই পৃথিবীর সকল প্রাণী থেকে মানুষ স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। মানুষ তার হাসি আনন্দ দুঃখ বেদনা সবকিছুই প্রকাশ করে ভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষা ছাড়া তৃপ্তি মিটিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। মাতৃভাষার এ গুরুত্বের কথা ভেবেই পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার ভেতর দিয়েই শিশুর মনে স্বদেশপ্রেমের সূত্রপাত ঘটে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বিদেশি শাসকরা এ ভাষাকে যুগে যুগে পদানত করতে চেয়েছে। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এদেশের মানুষ। করেছে ভাষা আন্দোলন। অনেক রক্ত ঝরেছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে অকাতরে জীবন দিয়ে তার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের শিক্ষা শিল্প সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায় যার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলন। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত যে আন্দোলন হয়েছে তাকে ভাষা আন্দোলন বলা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল। সেখানে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গৃহীত হয় উর্দু এবং ইংরেজি। বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ মুসলিম লীগের নেতারা এর বিরোধিতা করেন। ফলে ২ মার্চ ঢাকায় ফজলুল হক মুসলিম হলে এক সভায় বাংলা ভাষার পক্ষে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ছাত্ররা শোভাযাত্রা নিয়ে রাজপথে নামে। শোভাযাত্রায় পুলিশ নির্বিচারে গুলি ও লাঠিচার্জ করলে অনেক ছাত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়। এর প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন এবং ১৫ মার্চ পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় আসেন। তিনি ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় ঘোষণা করলেন Urdu and only Urdu will be the State Language of Pakistan. এর প্রতিবাদে ২৬ মার্চ ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যুর পর ১৮ নভেম্বর ঢাকায় আসেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। এর আগের দিন ঢাকায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। ১৯৫০ সালে গণপরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে জিন্নাহকে অনুসরণ করে লিয়াকত আলী খান বললেন দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাসে ঢাকার রাজপথ গরম হয়ে ওঠে এবং ৩০ জানুয়ারি পালিত হয় ধর্মঘট। ১৯৫২ জনরোষের ভয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট জনসভা শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেয়। কিন্তু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামলে পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে শহিদ হন রফিক জব্বার সালাম বরকত এবং নাম না জানা আরও অনেকে। শহিদদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় মর্যাদায় পালন করা হয় শহিদ দিবস হিসেবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাঙালি জাতির জন্য এ এক বিরাট গৌরব। একদিকে সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারবে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের কথা বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার কথা অন্যদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের ভাষাগুলো মর্যাদা লাভের পথ খুঁজে পাবে। বলা যায় ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এক বিরাট ভূমিকা পালন করবে।
মাতৃভাষা ও বর্তমান বাংলাদেশ
বাংলাদেশ বরাবরই নিজের মাতৃভাষার রক্ষার প্রতি অপরের তুলনায় অধিক সচেতন এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যে ভাষাকে রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছিল শত শত তরুণ হাজারো প্রাণ ঝরে গিয়েছিল অকালে সেই ভাষার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ক্ষুদ্র এই দেশটির মাতৃভাষা বাংলা বাংলা ভাষাকে এই দেশ নিজের মায়ের মত করে ভালোবাসে। বলা হয়ে থাকে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে পরম যত্নে বাংলাদেশ বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা পৃথিবীর বুকে নিজের এক অন্যতম স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ প্রমাণ করে দিয়েছে এই ভাষার অবলম্বনকারী মানুষ নিজের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে রক্ষায় রক্ত ঝরাতেও পিছুপা হয়না।
মাতৃভাষার বিকৃতি ও অবজ্ঞা
বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী অপসংস্কৃতির ব্যাপক চর্চায় ছাড় পায়নি মাতৃভাষাও। এ কথা সত্য যে ভাষা হল মানুষের ভাব প্রকাশের একটি প্রাণবন্ত ও প্রগতিশীল মাধ্যম। পৃথিবীর প্রত্যেকটি ভাষার মধ্যে অন্য অনেক ভাষার প্রভাব সর্বদাই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তা বলে নিজের মাতৃভাষাকে বিকৃত করে অন্য ভাষা থেকে ধার করা শব্দবন্ধের সংযোজন কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বায়নের কালে মানুষ যতই বিশ্ব নাগরিক হতে চাইছে নিজের মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা ততই বেড়ে চলেছে। আমাদের মনে রাখা দরকার নিজের মাতৃভাষাকে ভালো না বাসলে কোন মানুষ পৃথিবীর অন্য কোন ভাষাকে আদর্শরূপে আয়ত্ত করতে পারে না। মাতৃভাষা কোন একটি জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে।তদপুরি সার্বিক সামাজিক চরিত্রকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও মাতৃভাষার অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই কোন সমাজে মাতৃভাষায় অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ভাষার বিকৃতি এবং অবজ্ঞা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ডেকে আনে, যা পরবর্তীতে একটি জনগোষ্ঠীর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মাতৃভাষা দিবসের আনন্দ উৎসব
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ায় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাতৃভাষা দিবস উৎসবের আয়োজন করে ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর। উৎসবটি পালিত হয় ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে।একুশ আমাদের অহংকার একুশ পৃথিবীর অলঙ্কার অমর একুশ অজয় হয়েছে–এরকম অজস্র কথা কবিতা গদ্য নৃত্যছন্দে জমজমাট আনন্দ উৎসবের মধ্যে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি উপলক্ষে দিনভর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আনন্দ শোভাযাত্রা আলোচনা নৃত্য সংগীত আবৃত্তি ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পালিত হয় এ উৎসব।
ভাষা আন্দোলনের আদি কথা
পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বমূহুর্তে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপ করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন (১১ শ্রাবণ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ)। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর সারা দেশে বিদ্যুৎবেগে পৌঁছে যায় এবং দেশবাসী প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অতঃপর পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন
২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি স্মরণীয় দিন।বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে যারা জীবন দিয়েছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ছুটে যায় শহিদ মিনারে। জাতিসংঘের মহাসচিব এ দিবসটি পালন উপলক্ষে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা প্রেরণ করেন। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবারই প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি উদযাপন করে। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দিনটি অব্যয় ও অক্ষয় হয়ে থাকবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটকে গোড়া থেকে বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দেরও আগে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি তখনো। সেই সময়ে ভারতবর্ষ থেকে সদ্য বিভক্ত হয়ে যাওয়া পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান রূপে পরিচিত ছিল আজকের গৌরবময় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের প্রধান তথা বৃহত্তর অংশের জনগোষ্ঠী মূলত উর্দু ভাষাভাষী হলেও পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলের মানুষদের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। মাতৃভাষার সাথে জড়িয়ে থাকে বহু প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য এবং আবেগ। কোন ভাষার বিস্তৃতির সাথে সেই ভাষাগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও আবেগেরও বিস্তৃতি ঘটে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে ফেটে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বাংলা ভাষার ওপর জোর জুলুম তীব্রতর হতে থাকে। এর প্রতিবাদে তীব্র হয় ভাষা আন্দোলনও।
১৯৫২ তে তা চরম আকার নেয়। ওই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত তরুণ ছাত্র ছাত্রীদের ওপর পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে কয়েকটি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়। এদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক জব্বার সালাম শফিউল বরকত সহ অনেকেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই মহান দিনটিকে স্মরণ করেই ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাতিসংঘ এই দিনে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
ইতিহাসে যতদূর জানা যায় তা হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন কানাডার ভেঙ্কুভারে বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তাদের সার্বিক উদ্যোগে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয় মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড নামে একটি সংগঠন। এরপর আরও নানা সুধীজনের সহযোগিতায় বিভিন্ন ওঠাপড়ার শেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেই অধিবেশনেই মোট ১৮৮টি দেশের সমর্থন সহযোগে প্রস্তাবটি পাশ হলে তার পরের বছর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশগুলিতে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এরপরে ২০১০ সালের একুশে অক্টোবর সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে জাতিপুঞ্জ স্বয়ং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়। এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল বাংলাদেশ। তার পরের বছর মে মাসে জাতিপুঞ্জের ১১৩ সদস্য বিশিষ্ট তথ্য বিষয়ক কমিটিতে উক্ত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠা পূর্ণতা লাভ করে।
মাতৃভাষা ও সাহিত্য
মাতৃভাষা এবং সাহিত্যচর্চা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই বক্তব্যটির প্রকৃত অর্থকে বুঝতে গেলে সর্বপ্রথম আমাদের সাহিত্যের স্বরূপ অনুধাবন করতে হবে। সাহিত্য হল আমাদের মনের ভেতরকার সেই সব কল্পনা যাকে আমরা ভাষার মাধ্যমে জীবন্ত রূপ দিতে চাই। এ বিশ্বে যা কিছু প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক তা কিছুই সুন্দর। মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজের মনের অন্দরমহলে সাহিত্যিক কল্পনার রূপ দান করে আপন মাতৃভাষায় চিন্তার মাধ্যমে। তাই কোন মানুষ যদি নিজের মাতৃভাষায় দুর্বল হয় তার পক্ষে সমৃদ্ধ সাহিত্যকে রূপ দান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন সাহিত্য গড়ে উঠলেও তা নিজের স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে সুন্দরকে পাশ কাটিয়ে হয়ে পড়ে দুর্বল। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই পৃথিবীতে বিশ্বমানের যত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে প্রত্যেকটির পিছনে লেখক বা লেখিকার মাতৃভাষার অবদান সবথেকে বেশি। কারণ নিজের মাতৃভাষায় যত স্নিগ্ধ বা নির্মল ভাবে চিন্তা করা যায় পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় অসীম জ্ঞান থাকলেও আবেগের অভাব হেতু চিন্তার সেই স্নিগ্ধতা বা গভীরতা কোনটাই আসেনা।
২১-এর দীক্ষা
শুধু মাত্র উৎসবের মধ্যে একুশকে সীমাবদ্ধ রাখা মোটেই আমাদের কাম্য হতে পারে না। একুশ আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে তা আমাদের দীক্ষা হিসেবে নিতে হবে। একুশ হবে আমাদের কর্মচাঞ্চল্যের উদ্দীপনা। ২১ এর সত্যিকার ইতিহাস আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। বাংলাভাষার বিকাশ ঘটানোর জন্য আমাদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। যে লক্ষ্যে আমাদের দেশের মেধাবী ছাত্ররা জীবন দিয়ে গেছে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বাংলাদেশের গুরুত্ব
আজ আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমরাই প্রথম জাতি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রক্ত দিয়েছি অকাতরে জীবন দিয়েছি। মাতৃভাষার জন্য রক্ত এবং জীবন দেওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে আর নেই। সেই রক্ত বৃথা যায় নি। বিশ্ববাসী স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের মাতৃভাষাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভের সাথে সাথে বাংলাদেশের গুরুত্বও বৃদ্ধি পেল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। সেই সাথে বাংলা ভাষা হলো গৌরবের ভাষা।একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালির সংগ্রামের ও আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী অনুভব করতে সক্ষম হবে মাতৃভাষা একটি দেশের জাতিসত্তার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তাই যখনই তাদের মাতৃভাষার ওপর কোনো আঘাত আসবে তখনই তারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য। এর সাথে গুরুত্বের সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের নাম।
মাতৃভাষা দিবস প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ
মাতৃভাষা দিবসের সঠিক ইতিহাস বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিম্নরূপ-
১. মাতৃভাষা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত
আমাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে গবেষণা এবং পৃথিবীর সকল মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি l8মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গোটা বিশ্বের পাঁচ ছয় হাজার মাতৃভাষার কোনটিই যেন হারিয়ে না যায় এ কেন্দ্রে সেই ব্যবস্থা করা হবে। ব্যবস্থা থাকবে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার। ফলে এ কেন্দ্র একদিন বিশ্বের সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে সহায়ক হবে। এজন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে ভাষাতত্ত্ববিদ তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পন্ডিত বর্গ ও নৃতত্ত্ববিদদের এখানে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হবে।এর ফলে বাংলা ভাষার বিস্তৃতি ঘটবে বিশ্বের অনেক দেশে।
২. বিশ্বভাষা মেলা আয়োজন
সেসময়ে ঠিক করা হয়েছিল আগামী মহান একুশে উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজন করা হবে বিশ্বভাষা মেলা ও মহান সাহিত্যিকদের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। এছাড়া থাকবে ভাষা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান প্রামাণ্য চিত্র আবৃত্ত সংগীত পরিবেশন ইত্যাদি। মেলায় বাংলাদেশের একটি বড় স্টলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টল থাকবে।
৩. সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট তৈরির পরিকল্পনা
বাংলা ভাষার উৎপত্তি বিবর্তন ও পরিচয় বর্ণনা করে তৈরি একটি সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট অচিরেই বিশ্বের ১৮৮টি দেশে পাঠানো হবে। এছাড়াও জাতিসংঘের ৫টি ভাষা যথা— ইংরেজি ফারসি জার্মান স্প্যানিস ও আরবিতে সিডি ও ভিডিও ক্যাসেট তৈরি করা হবে।
জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে মাতৃভাষার প্রচলন
বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু জীবনের সবক্ষেত্রে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রচলন হয়নি। ব্যবসায় বাণিজ্যে অফিস আদালতে উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমরা যদি জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবা মর্যা আসন লাভ করতে চাই তাহলে উচ্চতর পর্যায়ের বইগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা জানি বাংলা পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ ভাষা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাষা। এ ভাষার গঠনপ্রণালি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক। কাজেই বিদেশি ভাষার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর প্রতি ভালোবাসা প্রদান করা আমাদের কর্তব্য। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাসহ জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা যে সম্ভব তার বাস্তব প্রমাণ আধুনিক বিশ্বের চীন জাপান ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ। কাজেই আমরা যদি জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হতে চাই তবে আমাদেরকে বিদেশি ভাষার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে প্রচলন করতে হবে।
উপসংহার
আমরা একুশ শতকে পদার্পণ করেছি। আমাদের জাতীয় জীবনে গত শতক ছিল আশা আকাঙ্ক্ষা সংগ্রাম যুদ্ধে ভরা টালমাটাল দিন। ইতিহাস থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখেছি লাখ লাখ জীবনের বিনিময়ে। এদেশের মানুষ মাটির গন্ধ বড় বেশি ভালোবাসে। তাই তারা ভালোবাসে মাটির মাকে আর মায়ের মুখের ভাষাকে। বাংলা মায়ের সন্তানেরা বিশ্বের বুকে নতুন শতকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য আজ দৃঢ়প্রত্যয়ী। আর সেজন্য আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাতৃভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২
ভূমিকা
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ভাষা। এ ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণীর থেকে আলাদা করা হয়। কারণ পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতে নির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহার করতে পারে। মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য নিজের মাতৃভাষাকে ব্যবহার করে থাকে। মাতৃভাষা ছাড়া মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায় না। মনের তৃপ্তি আসে না মাতৃভাষায় কথা বলা ছাড়া। তাইতো পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু হয় মাতৃভাষা দিয়ে। মাতৃভাষায় কথা বলার মাধ্যমে শিশুর মনে স্বদেশপ্রেমের সূত্রপাত ঘটে। তাই এ ভাষার মাহাত্ম্য অনেক।
তবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে অনেকের রক্তের দামে যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষা দিবস। শুধু আমাদের নয় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে যা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে আরো গৌরবোজ্জ্বল করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি
ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান নামক দুইটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। যেখানে একটি ছিলো পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) অন্যটি ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানিরা শতকরা ৯৭% মুসলিম ও বাঙালিরা ৮০% মুসলিম নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। তবে তখন সমস্যা সৃষ্টি হয় মাতৃভাষা নিয়ে। পাকিস্তানের দুটি শাখা রাষ্ট্রের মাতৃভাষা ছিলো আলাদা। তখন একটি সার্বজনীন ভাষা উপস্থাপনের প্রয়োজন হয়। এর পরিপেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আালীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউর আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এতে বাংলার বুদ্ধিজীবী, ছাত্রসমাজ, সাংবাদিক, বিভিন্ন কর্মী প্রমুখ এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। তারা মাতৃভাষা উর্দুকে মেনে নিতে অস্বীকার করে।
১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসের ৬ ও ৭ তারিখ নবগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগের কর্মী সম্মেলনে বাংলা ভাষাতে পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম ২ রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ‘তমদ্দুন মজলিস ‘ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই দাবি উত্থাপিত করেন। ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামক সংগঠনের মাধ্যমে একটি সাংস্কৃতিক দল ভাষার ব্যাপারে সতর্ক হন। তারপর রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে উক্ত সংগঠন কর্তৃক একটি পুস্তক বাহির করা হয় যার নাম ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’।
এটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ স্বরূপ ছিলো। ইতিমধ্যে অনেকেই উক্ত সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার বাংলার উপর জোরপূর্বক উর্দুকে বাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়। পাকিস্তানের শতকরা মাত্র ৩.২৭ ভাগ লােকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। তবুও পাকিস্তানিরা অন্যায়ভাবে নিজেদের খেয়াল খুশি অনুযায়ী বাংলার মানুষের উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপানোর চেষ্টা করে। বুদ্ধিদীপ্তভাবে পাকিস্তানের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয়তালিকা থেকে এবং নৌ ও অন্যান্য বিভাগের নিয়ােগ পরীক্ষায় বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। তাছাড়াও পাকিস্তানের গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে অধিবেশন হয় যেখানে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও সরকারি ভাষা হিসাবে রাখার দাবি উপস্থাপন করেন। তিনি বুঝানোর চেষ্টা করেন যেহেতু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষা বাংলা সেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জানায় যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র সেহেতু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় আন্দোলন।
এই আন্দোলনে বাংলার সকল জনসাধারণ ক্রমান্বয়ে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। অবস্থা হাতের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কায় পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে ১৫ মার্চ আলোচনায় বসে ৮ দফা দাবির চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করে যেখানে ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কিছু শর্ত দেওয়া হয়। তবে পাকিস্তান সরকার এসব শর্ত বাস্তবায়ন করার পরিবর্তে ২১ শে মার্চ ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত এক জনসভায় জানায় বাংলা নয়, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এতে পূর্ব বাংলার মানুষ ক্ষেপে যায় এবং তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
১৯৫১ সালে আবার সেই আন্দোলনের পুনর্জাগরণ ঘটে। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এক জনসভায় ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এই ঘোষণায় উপস্থিত ছাত্র জনতা, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্যরা ‘না না’ ধ্বনিতে তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩০ শে জানুয়ারি এক সভার আয়োজন করা হয় এবং সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলন শুরু করে জনসাধারণসহ বিভিন্ন কর্মজীবী মানুষেরা।
এই আন্দোলন ঠেকাতে পুরো ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা না মেনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য প্রতি জায়গায় দশ জন করে মিছিলে বের হয়। পুলিশ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। অনেককে সেদিন গ্রেফতার করা হয়। লাঠিচার্জ পর্যন্ত করে। এর প্রতিবাদে ছাত্রজনতারা ইট পাথর ছুড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশ জনতার সাথে না পেরে গুলি বর্ষণ করা শুরু করে। ফলে সেখানেই নিহত হন সালাম, রবিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে। তাঁদের স্মৃতির স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয় এবং ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারিভাবে শহিদ দিবস হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মর্মান্তিক ঘটনার কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তখন বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে ১৮৮ টি দেশ এতে সমর্থন জানায়। সেই প্রস্তাব পেশ করার মূল প্রস্তাবক ছিলো বাংলাদেশ এবং সৌদি আরব। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয় পেরিসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। বর্তমানে জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস গর্বোজ্জ্বলভাবে পালিত হয়ে আসছে।
মাতৃভাষার বিকৃতি ও অবজ্ঞা
মাতৃভাষা মানুষের আবেগ আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তবে বর্তমানে বিভিন্ন ভাষা চর্চার বদৌলতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। অবমাননা করা হচ্ছে বাংলা ভাষাকে। বিভিন্ন ভাষা শেখার তাগিদে মানুষ বাংলা ভাষার সাথে সংমিশ্রণ করছে অন্য দেশীয় ভাষা। এতে বাংলা ভাষার অবমাননা বেড়েই চলেছে। যারা মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে পারে না তারা কখনোই দেশকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নিজেদের ভুলগুলো সমাধান করে মাতৃভাষা বাংলাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চাসহ শিল্পচর্চা করা উচিত।
মাতৃভাষা দিবসের আনন্দ উৎসব
১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর ২০০০ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে খুব জমকালোভাবে আয়োজন করা হয় মাতৃভাষা দিবসের। এর পর থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আয়োজন করা হয় এই মাতৃভাষা দিবসের। শুধু আমাদের দেশে নয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর এই দিনটিতে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় ভাষা-শহীদদের স্মরণে। শহীদ মিনারে পুষ্প দিয়ে তাঁদের সম্মান জানানো হয়।
মাতৃভাষা ও সাহিত্য
মাতৃভাষার সাথে সাহিত্য কথাটা নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। সাহিত্য হলো আমাদের মনের ভেতরকার সেসব কল্পনা যা আমরা ভাষার মাধ্যমে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। সাহিত্যচর্চা হয়ে থাকে নিজের ভাষায়, মাতৃভাষায়। সাহিত্য আমাদের মনের কল্পনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সাহিত্যচর্চা তখনই সিদ্ধ হয়ে যখন সেই সাহিত্যচর্চা ও নিজের মায়ের ভাষায়। সম্পূর্ণ বোধগম্য না হলে যে সাহিত্য তার আসল রূপ দেখাতে ব্যর্থ।
জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমে মাতৃভাষার প্রচলন
বাংলা হলো পৃথিবীর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সপ্তম বৃহত্তর ভাষা। তাই বাংলা ভাষাটাকে যতটা হালকাভাবে দেখানো হয় আসলে কিন্তু তা নয়। বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনেক। বৈজ্ঞানিকভাবে বিভিন্ন ভাষাচর্চার মাধ্যমে আজকের বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ রূপ ধারণ করেছে। এদিকে বাংলাভাষা বাংলার রাষ্ট্রভাষা হওয়া সত্ত্বেও বড় বড় কার্যালয়ে বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে বাংলা ভাষায় যদি সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয় তবে বাংলার মান বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু এদেশের সকল মানুষের ভাষা বাংলা চাইলেই বিশ্বের উন্নয়নমূলক পুস্তকগুলো বাংলায় অনুবাদ করা যেতে পারে। নিজের ভাষায় লজ্জা নয় গর্ব থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে নিজ মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে সেই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে গেছেন। তাই আমাদের অন্য দেশীয় ভাষা থেকে আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলা ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থাসহ সকল কার্যক্রম করার উদ্যোগ নিতে হবে।
উপসংহার
বর্তমান সময়ে আমরা একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্র পেয়েছি। তবে আমাদের এই পরিপূর্ণ রাষ্ট্র পাওয়ার ইতিহাসটা মোটেই সহজ সরল ছিলো না। এমন একটি দেশ পাওয়ার ইতিহাসে আছে অনেক মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তদান। অনেক শোষণ, অত্যাচার, ত্যাগ করার পর আমরা আজকের বাংলাদেশ পেয়েছি। কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জনের থেকে তা রক্ষা করা কঠিন। তেমনই স্বাধীনতা অর্জন হলেও আমাদের উপর এখন স্বাধীনতা রক্ষা করার গুরু দায়িত্ব। আমাদের সকলের উচিত নিজের ভাষা মাতৃভাষা বাংলাকে সম্মান করা। মাতৃভাষায় কথা বলে নিজের ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় রাখা আমাদের কর্তব্য।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা
সূচনা:
মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষা মানব অস্তিত্বের প্রধান তিনটি অবলম্বন। মানুষের পরিচয়ের সেরা কষ্টিপাথর মাতৃভাষা, দেশের ভাষা, জাতির ভাষা। মাতৃভাষার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকারসমূহের মধ্যে অন্যতম। এ অধিকার নিজের মতাে করে কথা বলার অধিকার, স্বতঃস্ফূর্ত চেতনায় উদ্ভাসিত স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছিল বরকত, সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার এবং আরও অনেক নাম না জানা বাঙালি। তাদের সে রক্তে রঞ্জিত একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বজনীন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি:
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রয়েছে একটি গৌরবদীপ্ত ঐতিহাসিক পটভূমি । ১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ববাংলার জনগণ বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিল । বাঙালির সেই ঐতিহাসিক ভাষা শহীদ দিবস ২১-এ ফেব্রুয়ারি আজ সারাবিশ্বের ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৭-এর পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই বাঙালি জাতির চেতনায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের তরঙ্গ প্রবাহিত হয়েছিল । তদানীন্তন পাকিস্তান রাষ্ট্রের গােড়াপত্তন ঘটে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা, কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলা ভাষাকে পাশ কাটিয়ে গােপনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ওঠে। যদিও উর্দু ছিল মাত্র ৬ শতাংশ লােকের মাতৃভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাকিস্তানি শাসকদের এ অপপ্রচেষ্টা বাঙালিকে বিদ্রোহী করে তােলে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে একটি প্রস্তাব পাশ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জাগ্রত ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল প্রচণ্ড ক্ষোভের সাথে। তবে এ আন্দোলন জোরদার হয় ১৯৪৮ সালে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘােষণার পর থেকেই। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী যতই বাংলা ভাষার বিরােধিতা করতে থাকে ততই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। সমগ্র পূর্ববাংলা একই অঙ্গীকারে ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি ঘােষণা করেছিল, উর্দুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকে দিতে হবে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ দাবি না মেনে ঘােষণা করে উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এ অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফলে সরকার ও ছাত্রসমাজের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়। এরই জের হিসেবে বায়ান্নর ২১-এ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। অনেক প্রাণের তাজা রক্তে সেদিন রঞ্জিত হয় রাজপথ। এ নৃশংসতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তােলে, গর্জে ওঠে সারা বাংলা। আতঙ্কিত সরকার বাধ্য হয়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। সময়ের দাবিতে ভাষা আন্দোলন পরিণত হয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। একুশের চেতনাই বাঙালিকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শক্তি জুগিয়েছে। মাতৃভাষার জন্য। বাঙালির সেদিনের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। একুশ এখন আর কেবল বাঙালির ‘শহীদ দিবস’ নয়। একুশ এখন সারা বিশ্বের । বিশ্বের ১৮৮টি দেশে ভাষা শহীদদের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করা হয় এ দিনে বাঙালির ‘শহীদ দিবস’ এখন বিশ্ববাসীর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এককথায়, একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাজাত প্রয়াসের ফসল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি:
‘৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গণমানুষের দৃঢ় অঙ্গীকারই বিশ্বসভায় বাংলা ভাষাকে মর্যাদার আসন দিয়েছে সত্যিকার অর্থে মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি আমাদের হৃদয়ছোঁয়া আবেগই বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে সহায়তা করেছে। ২১-এ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করে কানাডায় বসবাসরত প্রবাসীদের সংগঠন “Mother Language Lovers of the world Society, এর পেছনে যে দু জন বাঙালির কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি তারা হলেন—আব্দুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম। তাঁরাই ১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারি ২১-এ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘােষণার জন্য জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। সাতটি ভাষার ১০ জন মানুষ এ আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেন। কফি আনান ইউনেস্কোর সাথে যােগাযােগ করার পরামর্শ জানালে ইউনেস্কোকে একটি আবেদনপত্র পাঠানাে হয়। কিন্তু ইউনেস্কোর শিক্ষা বিভাগের প্রোগ্রাম বিশেষজ্ঞ মিসেস আনা মারিয়া এর প্রত্যুত্তরে বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে কোনাে প্রস্তাব গ্রহণের অপারগতা জানান। তিনি বলেন, সরকারের মাধ্যমে আবেদন করা হলে ইউনেস্কো তা বিবেচনা করে দেখবে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৮টি দেশের সমর্থন নিয়ে ২১-এ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ স্বীকৃতি হচ্ছে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতি প্রদান। এরই আলােকে ২০০০ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালিত হলাে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালির ‘শহীদ দিবস’ এখন পালিত হয় ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশে এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে ।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য:
যেকোনাে দেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে সে দেশের মাতৃভাষাতেই। তাই ভাষাই একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক। ইউনেস্কোর সম্মেলনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষা দিবস কেবল কোনাে দেশ বা জাতির গােষ্ঠী চেতনাকেই সম্মানিত করে না বরং বিশ্বের প্রতিটি জাতির ভাষার প্রতিই মর্যাদা প্রদর্শন করে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর তাৎপর্য হলাে সকল মাতৃভাষাকে বিকশিত হওয়ার সুযােগ দেওয়া, যথাযােগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনাে ভাষার প্রতি প্রভুত্ব আরােপের অপচেষ্টা না করা, ছােট-বড় সকল জাতির ভাষাকে সমমর্যাদা দান করা। একুশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে কেবল বাঙালির মাতৃভাষার প্রতিই নয়, বিশ্বমানবের আপন ভাষার মর্যাদার দিকটিও এতে শনাক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবস পালনের ফলে বিশ্ব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবােধ সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে। একুশের অনন্য চেতনা বিশ্ববাসীকে নিজ নিজ ভাষাকে ভালােবাসার প্রেরণা জোগাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় নৈকট্য বাড়ছে। বিশ্ববাসীর পদচারণায় আমাদের ভাষা হচ্ছে শক্তিশালী এবং ক্রমবিকাশমান । ভাষার প্রতি বাঙালির আত্মত্যাগ আর ভালােবাসা বিশ্ববাসীকে শিখিয়ে দিল আপন ভাষা, আপন সংস্কৃতিকে ভালােবাসার মন্ত্র। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর তাৎপর্য উপলব্ধি করে ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘আমি মুগ্ধ, আমি প্রীত, আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আমার প্রাণের কথা আমার ভাষায় জানাতে পারব বলে আমার হৃদয়-স্পন্দন বেড়েছে। সত্যিই গর্বিত আমি।’
উপসংহার:
‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিশ্ব দরবারে লাভ করেছে ব্যাপকতা, পেয়েছে বিশেষ মহত্ত্ব। আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে নতুন মহিমা, নতুন গরিমা, নতুন মর্যাদা। ভাষার এ বৈশ্বিক স্বীকৃতি আমাদের দুর্লভ অর্জন । ভাষার প্রশ্নে তাই আমরা আনন্দিত, গর্বিত, তবে আমরা মাতৃভাষাকে ভালােবাসা এবং সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বিশ্বের সকল মানুষের মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করব— এ চেতনায় অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেই এ মহান দিবসের সার্থকতা।
একুশে ফেব্রুয়ারি / শহীদ দিবস রচনা (ভিন্ন প্রতিলিপন)
একুশে ফেব্রুয়ারি / শহীদ দিবস রচনা সংকেত
- ভূমিকা
- মাতৃভাষা
- ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
- ১৯৫৪ সালের স্বীকৃতি
- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি
- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন
- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও গুরুত্ব
- মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থা
- মাতৃভাষা রক্ষায় আমাদের করণীয়
- উপসংহার
শহীদ দিবস রচনা
ভূমিকা :
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি”
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনের সকল চেতনার উৎস হচ্ছে এ দিনটি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন এটি। এদিনেই বাঙালির তাজা রক্ত রাজপথে ঝরেছিল। বাঙালির রক্তঝরা এ দিনটিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সম্মান জানিয়েছে ভাষাশহীদদের প্রতি।
মাতৃভাষা :
বিশ্বের প্রতিটি জাতির রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। আর এ নিজস্ব ভাষাই হচ্ছে মাতৃভাষা। যেমন— বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলা, ইংরেজদের ইংরেজি, আরবীয়দের আরবি ইত্যাদি। কবির ভাষায় ‘যে ভাষাতে প্রথম বােলে, ডাকনু মায়ে মা মা বলে’ সে ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি :
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা বালা হলেও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বালা উপেক্ষিত হতে থাকে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্র ব্রিটিশ আমল থেকেই চলছে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান যুবকর্মী সম্মেলনে প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের অফিস ও আইন-আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলাকে চালু করার দাবি জানানাে হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে পাকিস্তান সরকারের এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন মন্ত্রীর সাথে দেখা করে বালা ভাষার সমর্থনে প্রতিশ্রুতি আদায়ের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের গণপরিষদের এক অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষাতে অধিবেশনের কার্যক্রম রেকর্ড হওয়ায় এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার স্বীকৃতির জন্য দাবি জানান। কিন্তু এ দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় পূর্ব বাংলার শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তাল হতে থাকে। এমন সময়ে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে বলেন “Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan.” ২৪ মার্চ কার্জন হলে তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা ‘No, no, It can’t be.” বলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং ২৬ মার্চ ধর্মঘট পালন করে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করলে পূর্ব বাংলার গণমানসে প্রচন্ড ক্ষোভ দেখা দেয়। এরপরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের মূল সগ্রাম।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :
মাতৃভাষা প্রীতি ও প্রতিষ্ঠার সত্যমে বাঙালি জাতির ইতিহাস সারা বিশ্বে গৌরবদীপ্ত এক বিরল ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সমগ্র দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন জোরদার করা হয়। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার মিটিং, মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানে প্রত্যয়ী ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। সাথে সাথে পুলিশ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারসহ আরও অনেকে শহীদ হয়। এ হত্যাযজ্ঞ ও দমননীতির ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
১৯৫৪ সালের স্বীকৃতি :
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর সারা দেশে বিদ্যুদ্বেগে পৌছে যায় এবং দেশবাসী প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাথে সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে পূর্ব বাংলার ভাষার দাবি মেনে নেয়ার জন্য অনবরত চাপ দিতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি :
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আভর্জাতিক মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে সর্বপ্রথম সচেষ্ট হন কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। এ দুজন আরও কয়েকজন মাতৃভাষাপ্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তােলেন ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামক সংস্থা। ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি এ সংস্থার পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘােষণার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন পাঠানাে হয়। কিন্তু বেসরকারি সংস্থা হওয়ায় তা অগ্রাহ্য করা হয়। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আবেদন করেন। অবশেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাবটি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ৩১তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বিশ্বের ২৮টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষর করে। বাঙালি জাতির জন্য একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্তি এক অভাবনীয় অর্জন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন:
আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথে যারা নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে তাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়েই আমরা পেয়েছি মধুর বাছা ভাষা। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা শ্রদ্ধাভরে তাঁদের স্মরণ করি। এদিন শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তাঁদের প্রতি সম্মান জানাই। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এ দিনটি পালন করা হয়। বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ অত্যন্ত আনন্দের সাথে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও গুরুত্ব :
মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাস পৃথিবীতে আর নেই। আমাদের বীর সন্তানদের আত্মত্যাগের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভাষার এ মর্যাদা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি আজ বীরের মতাে মাথা উঁচু করে আছে। আমাদের ভাষাপ্রীতি অন্যান্য দেশের মানুষের মধ্যেও তা জাগিয়ে তুলেছে। আমাদের দেখে তারাও তাদের মাতৃভাষাকে ভালােবাসতে শিখবে।
মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থা :
বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার। এ ভাষার প্রতিটা বর্ণেই ভেসে উঠে বায়ান্নর শহীদদের জমাট রক্তের চিহ্ন। এই ভাষার প্রতিটা বর্ণে আছে শতশত মায়েরা কান্না, অসংখ্যা যুবকের মরা লাশের গন্ধ। কিন্তু আমাদের এক শ্রেণির দ্বারা এই মধুর ভাষা আজ চরম লাঞ্ছিত। বিদেশি ভাষার অনুপ্রবেশ এই ভাষার মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করছে প্রতিনিয়ত। বাংলাভাষায় ভিনদেশী ভাষার সংমিশ্রণে একদিকে যেমন হয় বাংলামায়ের প্রতি অবমাননা, তেমনি ভাষার জন্য জীবননাৎসর্গকারী বাংলা মায়ের সন্তানদের প্রতিও হয় অবিচার। বর্তমানে বাঙালির মুখে ভিনদেশী ভাষার প্রতিযােগিতা দেখে শহীদ যুবকদের করুণ কণ্ঠ ভেসে উঠে বাংলাদেশে। এই কণ্ঠগুলােই একদিন দিয়েছিল বক্ষভেদী স্লোগান। রাজপথে বয়ে দিয়েছিল তাজা রক্তের স্রোত। কিন্তু আজকে ভিনদেশী ভাষার প্রতি আমাদের অধিক আগ্রহ আর চর্চাসক্তি দেখে লজ্জিত হয় ভাষা শহীদদের আত্মা।
মাতৃভাষা রক্ষায় আমাদের করণীয় :
ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করা আমরাই বিশ্বে প্রথম জাতি। তাই এই ভাষার সম্মান রক্ষায় ভিনদেশী ভাষার সীমাতীত ব্যবহার পরিত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। আমাদের শিশু ও আগামী প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস শিক্ষা দিতে হবে। তাদের গড়ে তুলতে হবে নব চেতনায়। তাদের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে মাতৃভাষার প্রতি ভালােবাসা, আগ্রহ ও আসক্তি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। কথায় কথায় বাংলা ভাষার সাথে বিদেশি ভাষার মিশ্রণ পরিত্যাগ করতে হবে।
উপসংহার :
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বাঙালির জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। এর ফলে আমাদের বীর সন্তানদের আত্মত্যাগ যেমন আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে, তেমনি আমাদের জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও উন্নতি ত্বরান্বিত হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে। তাই বাংলার সন্তানরা একুশ শতকে মাথা উচু করে দাঁড়াতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। একুশের এ চেতনাকে ধারণ করে আমাদের যে কোনাে অসাধ্য সাধন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
Leave a comment