পৈশাচী: পৈশাচী অপভ্রংশ অবহট্ঠ ভাষা থেকে তিনটি ভাষার সৃষ্টি হয়—
-
পূর্বী পাঞ্জাবি বা হিন্দকি,
-
পশ্চিমা পাঞ্জাবি বা লহন্দি এবং
-
সিন্ধি।
পূর্বী পাঞ্জাবি ভাষা পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত এবং গুরুমুখি লিপিতে লেখা হয়। শিখদের মূল ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহিব’ বা ‘আদিগ্রন্থ’ (১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ) এই ভাষাতেই লিখিত। এটি পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ভাষা।
মহারাষ্ট্রী: মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ ভাষা থেকে দুটি নব্যভারতীয় আর্য ভাষার জন্ম হয়— মারাঠি ও কোঙ্কণি। মহারাষ্ট্রে প্রচলিত সমৃদ্ধ ভাষা মারাঠি। দেবনাগরী লিপির সামান্য পরিবর্তিত রূপ বালবােধ লিপিতে এই ভাষা লেখা হয়। জ্ঞানদেবের গীতাভাষ্য ‘জ্ঞানেশ্বরী’ বা ‘ভাবার্থ-দীপিকা’ (১২৯১ খ্রিস্টাব্দে) এই ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ। গােয়া রাজ্যের ভাষা কোঙ্কণি, আগে মারাঠি ভাষার উপভাষা ছিল। বর্তমানে এটি একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র ভাষা, যা দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয়। মারাঠির অপর একটি উপভাষা বরারি।
অর্ধমাগধী: অর্ধমাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ শাখা থেকে সৃষ্ট হয়েছে তিনটি ভাষা—
-
অবধি বা আওধি,
-
বাঘেলি ও
-
ছত্তিশগড়ি।
এই তিনটি ভাষাকে পূর্বী হিন্দি বা কোশলি ভাষাগুচ্ছও বলা হয়। প্রাচীন অযােধ্যা অঞ্চলের ভাষা অবধি দ্বাদশ শতাব্দী থেকে সাহিত্য রচনার বাহন ছিল। সুফি লেখক মালিক মহম্মদ জায়সির ‘পদুমাবৎ’ (যােড়শ শতাব্দী) এবং তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ (যােড়শ শতাব্দী) অবধি ভাষায় রচিত।
শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ ভাষা থেকে সৃষ্ট ভাষাগুলি তিনটি শাখায় বিভক্ত-
-
পাহাড়ি শাখা,
-
মধ্যদেশীয় শাখা এবং
-
পশ্চিমা শাখা।
পাহাড়ি শাখা: হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত শৌরসেনী ভাষার শাখাই হল পাহাড়ি শাখা বা হিমালয় শাখা। এই শাখা থেকে সৃষ্ট প্রধান চারটি ভাষা হল-
-
নেপালি বা খসকুরা,
-
গাের্খালি,
-
কুমায়ুনি এবং
-
গাড়ায়ালি।
চম্বলি, জৌনসারি প্রভৃতি এই শ্রেণির গৌণ ভাষা। নেপালি ও গাের্খালি নেপাল রাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় প্রচলিত। সাহিত্যসমৃদ্ধ নেপালি ভাষার একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল প্রখ্যাত নেপালি কবি ভানুভক্ত অনূদিত নেপালি ‘রামায়ণ’ (১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ)। কুমায়ুনি এবং গাড়ােয়ালি— এ দুটি মূলত মৌখিক ভাষা।
মধ্যদেশীয় শাখা: শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহটঠের মধ্যদেশীয় শাখা থেকে উদ্ভূত হয়েছে পাঁচটি ভাষা-
-
কথ্য হিন্দুস্থানি,
-
ব্রজভাষা,
-
কনৌজি,
-
বুন্দেলি এবং
-
খড়িবােলি বঙ্গারু বা হরিয়ানি।
এই পাঁচটি ভাষা প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা হিন্দির পাঁচটি উপভাষা। কথ্য হিন্দুস্থানি ভাষা প্রচলিত দিল্লি-মিরাট অঞ্চলে। মধ্যযুগের সাহিত্যগুণসম্পন্ন ব্রজভাষা মথুরা, বৃন্দাবন, উজ্জয়িনী, আলিগড় এবং আগ্রা অঞলে প্রচলিত। মীরার ভজনগুলি এই ভাষাতেই লেখা। কনৌজি ছিল প্রাচীন কান্যকুজের ভাষা, বর্তমানে যা মথুরার পূর্বে উত্তর দোয়াব অঞ্চলে প্রচলিত। বুন্দেলি মধ্যভারতের বুন্দেলখণ্ডের ভাষা যা মধ্যভারতের অংশবিশেষে প্রচলিত। দক্ষিণ-পূর্ব পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় খড়িবােলি বঙ্গারু বা হরিয়ানি ভাষা প্রচলিত।
পশ্চিমা শাখা: শৌরসেনী অপভ্রংশ-অবহট্ঠের পশ্চিমা শাখা থেকে জন্ম নিয়েছে গুজরাটি ও রাজস্থানি ভাষা। গুজরাটের ভাষা গুজরাটিতে সাহিত্য রচনা শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে। বর্তমান ভারতের একটি সমৃদ্ধ ভাষা গুজরাটি যার লিপি দেবনাগরী লিপি থেকে সৃষ্ট। রাজস্থানি ভাষার (প্রায় লুপ্ত) উপভাষাগুলি হল পশ্চিমা রাজস্থানি বা মারােয়াড়ি, খান্দেশি, জয়পুরি, মেবারি, মালবি ইত্যাদি।
মাগধী অপভ্রংশ-অবহটঠ ভাষা থেকে সৃষ্ট ভাষাগুলি দুটি শাখায় বিভক্ত—
পশ্চিমা শাখা থেকে মৈথিলি, মগহি, ভােজপুরি এবং পূর্বী শাখা থেকে ওড়িয়া, বাংলা ও অসমিয়া ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। মৈথিলি প্রাচীন মিথিলা, রাজ্যের এবং বর্তমান বিহারের উত্তরাংশের ভাগলপুর, মজফফরপুর, দ্বারভাঙ্গা, পূর্ব চম্পারণ, সমস্তিপুর ইত্যাদি অঞ্চলের ভাষা। কবি বিদ্যাপতি ছিলেন মৈথিলি কবি। তাকে ‘মৈথিলি-কোকিল’ বলা হয়ে থাকে। মগহি প্রাচীন মগধ রাজ্যের এবং বর্তমানের মধ্য-দক্ষিণ বিহারের পাটনা, গয়া, মুঙ্গের ও হাজারিবাগ অঞ্চলের ভাষা। ভােজপুরি ভাষাটি পশ্চিম বিহারের পূর্ণিয়া, ভাগলপুর, কাটিহার, সাসারাম ও উত্তরপ্রদেশের কাশী, ভােজপুর, নাগপুর ও রােহতাস অঞ্চলে প্রচলিত। কবিরের লেখা দোহাগুলি (পঞ্চদশ শতাব্দী) ভােজপুরি ভাষাতেই লেখা।
দ্বাদশ শতকের তাম্রশাসনে যেহেতু ওড়িয়া ভাষার নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাই এর আগেই এই ভাষাটির সৃষ্টি হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। ওডিশা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গ, ছােটোনাগপুর অঞ্চল এবং মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুর কোনাে কোনাে অঞ্চলে এই ভাষা প্রচলিত। আনুমানিক দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার সৃষ্টি। এর আদি নিদর্শন চর্যাপদ। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রায় সর্বত্র এবং বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও আন্দামানের কোনাে কোনাে অঞ্চলে এই সাহিত্যগুণসম্পন্ন ভাষাটি প্রচলিত। যােড়শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষার কামরূপী উপভাষা থেকে অসমিয়া ভাষার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে অসম রাজ্যের সরকারি ভাষা অসমিয়া এক অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
নব্যভারতীয় আর্য ভাষার পূর্বী শাখা থেকে যখন ওড়িয়া, বাংলা ও অসমিয়া ভাষার জন্ম হয়, তখন এই তিনটি ভাষার মধ্যে তেমন পার্থক্য ছিল না। খানিকটা একই ভাষার উপভাষা রূপে এই তিন ভাষা কাজ করেছিল। তাই ওড়িয়া, বাংলা ও অসমিয়া ভাষার মধ্যে সম্পর্ক ও সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ওড়িয়া ভাষা ওড়িয়া লিপিতে এবং বাংলা ও অসমিয়া ভাষা বাংলা লিপিতে বা বঙ্গলিপিতে লেখা হয়। দ্বাদশ শতকের তাম্রশাসনে যেহেতু ওড়িয়া ভাষার নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাই এর আগেই এই ভাষাটির সৃষ্টি বলে অনুমান করা যায়। ওড়িশা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গ, ছােটোনাগপুর অঞ্চল এবং মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুর কোনাে কোনাে অঞ্চলে এই ভাষা প্রচলিত।
সাহিত্যসমৃদ্ধ ভাষা ওড়িয়া ভারতবর্ষের একটি প্রধান জাতীয় ভাষা। আনুমানিক দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার সৃষ্টি। এর আদি নিদর্শন চর্যাপদ। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রায় সর্বত্র এবং বিহার-ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও আন্দামানের কোনাে কোনাে অঞ্চলে এই সাহিত্যগুণসম্পন্ন ভাষাটি প্রচলিত। যােড়শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষার কামরূপী উপভাষা থেকে অসমিয়া ভাষার সৃষ্টি। বর্তমানে অসম রাজ্যের সরকারি ভাষা অসমিয়া এক অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
অস্ট্রিক ভাষাবংশ এবং অস্ট্রিক ভাষাভাষীদের সাধারণ পরিচয় দাও। অস্ট্রিক ভাষাবংশের অস্ট্রোনেশীয় (Austronesian) ভাষা শাখাটির পরিচয় দাও।
ভারতে প্রচলিত অস্ট্রিক ভাষার উপশাখাটির নাম কী? এই উপশাখাটির বিস্তৃত পরিচয় দাও।
দ্রাবিড় ভাষাবংশের বিস্তৃত আলােচনা করাে।
ভারতে প্রচলিত সাহিত্যগুণসম্পন্ন দ্রাবিড় ভাষাগুলির মধ্যে তামিল ও মালয়ালমের পরিচয় দাও।
‘কন্নড়’ ও ‘তেলুগু’ ভাষার পরিচয় দাও।
ভােট-চিনা ভাষাবংশের বিস্তৃত আলােচনা করাে।
ভারতে প্রচলিত ভােট-চিনা ভাষাবংশজাত ভাষাগুলি সম্বন্ধে আলােচনা করাে।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিস্তৃত পরিচয় দাও।
বৈদিক ভাষা থেকে কীভাবে সংস্কৃত ভাষার জন্ম হয়েছে তা আলােচনা করে এই ভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের নাম এবং সময়কাল লেখাে।
মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার সময়কাল উল্লেখ করে এই পর্বটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার বিস্তৃতিকাল লেখাে। এর আদি স্তরের পরিচয় দাও।
মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার মধ্য ও অন্ত্য স্তরের পরিচয় দাও।
‘সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার জননী’—এই মত গ্রহণযােগ্য কি না তা যুক্তিসহ আলােচনা করাে।
বাংলা ভাষার ইতিহাসে যুগের বিন্যাস দেখিয়ে প্রত্যেক যুগের সময়সীমা নির্দেশ করাে।
ভারতীয় আর্য ভাষা বলতে কী বােঝ? এই ভাষার ক্রমবিকাশের স্তর কটি ও কী কী? প্রতিটি স্তরের সময়সীমা নির্দেশ করাে।
উদাহরণসহ মধ্যযুগের বাংলা ভাষার চারটি ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করাে। এই ভাষার দুটি গ্রন্থের নাম লেখাে।
ভারত চার ভাষাবংশের দেশ—এই চার ভাষাবংশের পরিচয় দাও।
হিন্দুস্থানি ভাষা অর্থাৎ হিন্দি ও উর্দু ভাষা কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা লেখাে।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বাংলা ভাষা উদ্ভবের ধারাটি উদাহরণসহ আলােচনা করাে।
Leave a comment