পরিচয়: জিন্নার পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি এবং তাতে জওহরলাল ও প্যাটেলের সম্মতি থাকায় মাউন্টব্যাটেনের উপদেষ্টা ইসমে ভারতভাগের পরিকল্পনা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠান (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে)। পার্লামেন্টে প্রস্তাবটি ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’রূপে পাস হয় (যদিও রাজকীয় সম্মতি লাভ করে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই) যা ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ হিসেবে পরিচিত ছিল।

বিভিন্ন প্রস্তাব: মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবে বলা হয়ㅡ

  • [i] ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডােমিনিয়নের সৃষ্টি করা হবে। ডােমিনিয়ন দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়সমূহ পরিচালনা করবে।

  • [ii] মুসলমান প্রধান প্রদেশ—সিন্ধু, ব্রিটিশ অধিকৃত বালুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে পাকিস্তান গড়া হবে।

  • [iii] পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করে কোন্ অঞ্চলকে কোন্ ডােমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই গঠিত হবে।

  • [v] দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করবে এবং ইচ্ছা করলে তারা যে-কোনাে ডােমিনিয়নে যােগ দিতে পারবে।

  • [vii] যতদিন না সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন গভর্নর-জেনারেল ওই ডােমিনিয়নের শাসনে থাকবেন।

  • [viii] স্বাধীনতালাভের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কোনাে আইন ওই দুই ডােমিনিয়নে বলবৎ থাকবে না। প্রতি ডােমিনিয়নের নির্বাচিত আইনসভা নিজ নিজ দেশের জন্য আইন রচনা করবে।

[1] শীর্ষনেতৃবর্গের সঙ্গে আলােচনার সূত্রে: ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন প্রায় দেড় মাসের মধ্যে (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ থেকে ৬ মে মধ্যে) গান্ধিজি, জওহরলাল, বল্লভভাই প্যাটেল, জিন্না ও দেশীয় রাজাদের সঙ্গে প্রায় ১৩৩ বার বৈঠকে বসেন। ভারত বিভাজন আটকানাের বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও জিন্না তাঁর পাকিস্তান দাবিতে অনড় থাকেন। মাউন্টব্যাটেন উপলব্ধি করেন যে, ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন নির্ধারিত ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে এক বিকল্প পরিকল্পনা রচনা করা দরকার।

[2] বলকান পরিকল্পনা রচনার মাধ্যমে: বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে মাউন্টব্যাটেন বলকান পরিকল্পনা (Plan Balkan) অনুসরণ করেন। এই পরিকল্পনায় পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব রাখা হয় এবং বলা হয় যেসকল প্রদেশ সাংবিধানিক সভায় যােগ দেবে তাদেরও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু নেহরু ও জিন্না এই পরিকল্পনাকে গ্রহণ না করায় বলকান পরিকল্পনা তার কার্যকারিতা হারায়।

[3] প্ল্যান পার্টিশানের রূপায়ণের দ্বারা: মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাজন লক্ষ্যে প্ল্যান পার্টিশান নামক এক পরিকল্পনা পেশ করেন। নেহরু ও ভি. পি. মেননের (রায়বাহুদুর মেননের) সাহায্য নিয়ে তিনি এই পরিকল্পনা রচনা করেন। এই পরিকল্পনায় বলা হয় ভারত ও পাকিস্তান দু-পক্ষের ডােমিনিয়ন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।

[4] ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাসের মাধ্যমে: মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব মেনে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় স্বাধীনতা বিল রচনা করে। ব্রিটেনের আইনসভায় পাস হওয়ার (১৬ জুলাই) পর সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ বিলটিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন (১৮ জুলাই)। বিলটি আইনে পরিণত হলে বড়লাট মাউন্টব্যাটেন তা কার্যকর করে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ডােমানিয়নের প্রতিষ্ঠা ঘটান।

[5] কংগ্রেস ও লিগের সাহায্য নিয়ে: গান্ধিজি ও মৌলানা আজাদ দেশভাগের ঘাের বিরােধী হলেও নেহরু ও প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস কার্যকরী সমিতি শেষপর্যন্ত ভারত বিভাজনে সায় দিয়েছিল। মুসলিম লিগও মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব মেনে নিলে ভারত বিভাজন সম্ভব হয়।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার বিরােধীতা করেছিল ভারতের বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ।

  • জওহরলাল নেহরু এক নেতার ভাষনে আক্ষেপের সুরে বলেন আমি এই প্রস্তাব (ভারত বিভাজনে) হৃদয়ের কোনাে আনন্দের সঙ্গে তুলছি না। যদিও এ বিষয়ে আমার মনে কোনাে সংশয় নেই যে এটি হল শ্রেষ্ঠ বিকল্প।

  • মহাত্মা গান্ধি মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন—আমি স্পষ্ট রূপে দেখতে পাচ্ছি সমস্যা সমাধানের পক্ষে আমরা ভুলভাবে এগােচ্ছি।

  • সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল দেশভাগের এই পরিকল্পনাকে মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও বলেন—দেশভাগ ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ছিল না।

  • ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশভাগের নির্দেশ সম্বলিত এই পরিকল্পনার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন—গৃহযুদ্ধের থেকে দেশভাগ ভালাে।