‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কতটা কিভাবে রয়েছে তা উদাহরণসহ আলোচনা করো।
নিজের জীবনাদর্শ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাদেবী বর্মা একসময় বলেছিলেন, “আমি কিছুতে বিশ্বাস করি বা না করি, কিন্তু মানুষে তো বিশ্বাস করি। আমি কোনো কর্মকাণ্ডে বিশ্বাস করি না। … আমি মুক্তিকে নয়, এই ধূলিকেই বেশি করে চাই।” মহাদেবীর এই জীবনবাণীতে যেন প্রত্যক্ষভাবেই রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্মের সুর প্রতিধ্বনিত। তাঁর সমগ্র কবিতাতেও পাঠক অনায়াসে খুঁজে পাবেন রবীন্দ্রনাথের ভাবজগং। কি প্রকাশভঙ্গিতে বা চিত্রকল্পনির্মাণে, কি কবিমানসের বৈশিষ্ট্যে বা সামগ্রিক জীবনভাবনায়, মহাদেবী যেন সম্পূর্ণভাবেই রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রাণিত ও দীক্ষিত। আসলে হিন্দি সাহিত্যের ছায়াবাদ যুগ বহুলাংশে রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিক চেতনার দ্বারা প্রভাবিত ও উজ্জীবিত। এই রবীন্দ্রপ্রভাব আবার সর্বাধিক নিরালা ও মহাদেবীর কাব্যে। কিন্তু মহাদেবী তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচেতনা ও কাব্যভাবনায় যেভাবে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ, ভক্তিতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব ও জীবনদেবতার কাছে আত্মসমর্পণকে গ্রহণ করেছেন, সেটি অন্যত্র সুলভ নয়।
মনে রাখতে হবে “দীপশিখা’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ। ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটি মহাদেবী বর্মার ‘দীপশিখা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ৫ সংখ্যক কবিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুংকার, সমস্ত দেশ জুড়ে মন্বন্তরের হাতছানি, প্রকট অর্থনৈতিক মন্দা, সেইসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক হানাহানি এক ঘোর দুর্বিপাককে যেন বহন করে নিয়ে এসেছে সেই সময়কালে। এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কালে দাঁড়িয়ে কবি মহাদেবী বর্মা এক অচঞ্চল প্রত্যয়ে মানুষের কল্যাণ ও জয়গাথা গেয়েছেন এই কবিতায়।
বিংশ শতাব্দীর সেই দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ যুগপরিবেশ ধূলিঝঞ্ঝার রূপকে প্রকাশিত হয়েছে মহাদেবীর আলোচ্য কবিতায়। কবিতার সূচনাতেই মহাদেবী লিখেছেন, পৃথিবীর অন্ধকার কারাগার ভেঙে আজ উন্মত্ত হয়ে ধেয়ে এসেছে ধূলিঝড়। মহাদেবী বিশ্বাস করেন, সেই ঝঞ্ঝালগ্ন লাস্যময় তড়িৎকে আর ঢেকে রাখতে পারবে না। কালো মেঘের ঘনঘটা। এই বিক্ষুব্ধ সময়ে নক্ষত্ররাও যেন ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে, বিভ্রান্ত বাতাস আর পথ খুঁজে পাচ্ছে না, আকাশের কোলে অশুভ উল্কা ছড়িয়ে দিয়ে ধ্বংস যেন নেমে আসছে মত্ত হয়ে। এই ভয়ংকর উপদ্রুত সময়ে কবি কিন্তু ভীত-ত্রস্ত হয়ে মুখ লুকোননি কোনো নৈরাশ্যের অন্ধকূপে। মানবতার লাঞ্ছনা দেখে হতাশার বেদনায় তিনি সমস্ত আশার প্রদীপকেও নিভিয়ে ফেলেননি মন থেকে। বরং তিনি এই দুঃসময়েই তুলে নিতে চেয়েছেন কন্ঠে দীপক রাগিনীর উদ্দীপনার গাঢ় সুর। কবি বলেছেন, এই সময়েই চতুর্দিকে নিভে যাওয়া আশার প্রদীপগুলিকে তিনি জ্বালিয়ে তুলবেন। যে অন্ধকার আজ ঘিরে নেমেছে চারপাশে, তারই মাঝখানে তিনি জাগিয়ে তুলবেন দীপক রাগিনীর উদ্দীপনমন্ত্র। এই সর্বব্যাপ্ত ধ্বংসের মধ্যেই কবি তাঁর মমতাময় আঙুলের আড়ালে বাঁচিয়ে রাখবেন জীবনের সুকুমার স্বপ্নগুলিকে। আজ প্রদীপের মৃদু শিখা দিয়েই কবি বেঁধে রাখতে চান দুর্যোগকালের ছন্দলয়। তিনি প্রতিটি স্বরকে সাজিয়ে তুলতে চান দীপাবলীর আলোকমালার মতো।
মহাদেবীর আলোচ্য কবিতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন উপদ্রুত সময়কে তিনি যেমন মুক্তির বার্তা হিসাবে দেখেছেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনিভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে অস্থির উপদ্রুত সময়ের সম্ভাবনা উপলব্ধি করে সেই দুর্যোগকে মহাকালের ইঙ্গিত হিসাবেই বরণ করেছিলেন নির্ভয় চিত্তে। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ পর্বের কবিতায় এই মনোভাবের পরিচয় আছে। যেমন ‘বলাকা’-র ‘সর্বনেশে’ কবিতায় কবি সর্বনাশা ঝড় এবং বেদনার কালকে প্রসন্নভাবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন মহাকালের অট্টহাসিরূপে –
“এবার যে ঐ এল সর্বনেশে গো।
বেদনায় যে বান ডেকেছে / রোদনে যায় ভেসে গো।
রক্তমেঘে ঝিলিক মারে, / বজ্র বাজে গহন-পারে,
কোন্ পাগল ঐ বারে বারে / উঠছে অট্ট হেসে গো!”
এই ভয় না করে কবি মানুষকে রক্তবসনে বধূসাজে এই ঝঞ্ঝাকালকে বরণ করে নিতে আহ্বান করেছেন। ‘সর্বনেশে’ ছাড়াও বলাকার ‘আহ্বান’, ‘পাড়ি’, ‘ঝড়ের খেয়া’ ইত্যাদি কবিতাতেও দুর্যোগের কালকে সাগ্রহে ভয়হীন চিত্তে পরিবর্তন তথা মুক্তির পথ হিসাবেই বরণ করার কথা উচ্চারিত হয়েছে। কেননা ক্রান্তিকালে এই দুঃসহসাধনাই যথার্থ মুক্তির পথ। ‘ঝড়ের খেয়া’ কবিতায় আছে সেই দুর্যোগকালের ভয়ংকরতার বর্ণনা ও সে পথে অভিসারের অকুতোভয় সংকল্প –
“বহ্নিবন্যাতরঙ্গের বেগ,
বিষশ্বাসঝটিকার মেঘ,
ভূতল-গগন- / মূর্ছিত-বিহুল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন –
ওরই মাঝে পথ চিরে চিরে
নূতন সমুদ্রতীরে / তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি …”
মহাদেবীর ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতার শেষাংশে এক নাবিকের প্রসঙ্গ এসেছে। দুর্যোগের কালে কবি মহাদেবী তার জীবনদেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন যে, তিনি যেন তরী বেয়ে এসে তাঁকে তীরে দেখেও পরিত্যাগ করে ফেলে না যান। তিনি যেন তাঁর প্রবল হুংকারে কবিকে তাঁর ঝঞ্ঝার দোলায় দোলায়িত তরীতে ডেকে নেন। কবি এই জোয়ারের তুমুল খরস্রোতেই জীবনের তরণী ভাসাতে চান। এই তরী ও নাবিকের প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ায় রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতার কথা। ‘সোনার তরী’ কবিতাতেও রহস্যময় নাবিককে ডেকে কবি তাঁকে তরণীতে স্থান দেবার জন্য মিনতি জানিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তরী তাঁকে গ্রহণ না করেই উত্তাল স্রোত বেয়ে অজানার দিকে পাড়ি দিয়েছে। সোনার তরী’ কবিতার তত্ত্বপ্রসঙ্গ বা রূপকার্থের সঙ্গে অবশ্য মহাদেবীর কবিতার কোনো সাদৃশ্য নেই। তবে মহাদেবী নাবিকের কাছে যখন প্রার্থনা করেন –“অব তরী পতয়ার লা কর / তুম দিখা মত পার দেনা,/ আজ গর্জন যে মুঝে বস / একবার পুকার লেনা!” তখন তার সঙ্গে ‘সোনার তরী’ কবিতার উচ্চারণের চিত্রকল্পগত সাদৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ স্রোত বেয়ে ভেসে চলা সোনার তরীর নাবিককে বলেন—“এতকাল নদীকূলে / যাহা লয়ে ছিনু ভুলে / সকলই দিলাম তুলে / থরে বিথরে – / এখন আমারে লহো করুণা করে।” বোঝাই যায়, ‘সোনার তরী’ কবিতাটির প্রভাবই মহাদেবীর কবিপ্রতিভাকে প্রাণিত করেছে। তফাৎ এই ‘সোনার তরী’ কবিতায় কবি নাবিকের দ্বারা নীরব প্রত্যাখ্যানের বেদনায় কুলেই অশ্রুপাত করেছেন, আর মহাদেবীর বিশ্বাস তাঁর নাবিক এই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ তরঙ্গস্রোতে ভাসমান তরণীতে মহাদেবীকেও নিশ্চিত সঙ্গী করে নেবেন।
এছাড়া সমগ্র কবিতাটিতে যে দ্বীপ বা দীপাবলীর প্রতীক বারবার উচ্চারিত, সেক্ষেত্রেও ছায়ার মতো রয়ে গেছে রবীন্দ্রপ্রভাব। আসলে জীবনকে প্রজ্জ্বলিত দীপের সঙ্গে উপমিত করা মহাদেবীর কবিতার একটি প্রিয় বিষয়। ড. সত্রাজিৎ গোস্বামী ‘হিন্দি কবিতাকাশের দশ নক্ষত্র’ গ্রন্থে মহাদেবীর ‘দীপশিখা’ কাব্য প্রসঙ্গে লিখেছেন—“মহদেবী দীপশিখাকে এ কাব্যে ব্যবহার করেছেন অবিচলিত আস্থার প্রতীক হিসাবে। তাঁর মতে, ভারতসংস্কৃতিতে আত্মচৈতন্যকে প্রদীপশিখার মতো উজ্জ্বল আলোকময় করে তোলার আহ্বানমন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’ মন্ত্র ভারতের ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, শিল্প ও জীবনচেতনায় নিরন্তর গুঞ্জরিত।” আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তীর্ণ করো, আত্মাকে দীপে পরিণত করো — ইত্যাদি বাণী ঔপনিষদিক যুগ থেকেই উচ্চারিত। উপদ্রুত সময়ে কালগত অন্ধকারে নৈরাশ্যপীড়িত প্রাণগুলিকে দীপাবলীর আলোকমালার মতো প্রজ্জ্বলিত করে তোলার যে সংকল্প মহাদেবীর কবিতায় ধ্বনিত, তা সেই শাশ্বত ভারতেরই বাণী। আর একথা বলা বাহুল্য যে, এই ঔপনিষদিক বাণীর দ্বারাই উজ্জীবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। শাশ্বত ভারতের এই বাণী, বুদ্ধের বিশ্বব্যাপী করুণা ও মানবতা, এই দীপের অনুষঙ্গ সবই রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় বিষয়। স্বভাবতই মহাদেবীর কবিতায় এই জীবনকে প্রদীপের আলোকমালায় রূপান্তরিত করার ভাবনাটিতেও তাই আমরা রবীন্দ্রনাথেরই ভাবপ্রতিফলন খুঁজে পাই। তবে, মহাদেবী কৃত্রিমভাবে রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ বা অনুকরণ করেননি। তিনি আসলে যথার্থভাবে রবীন্দ্রদীক্ষিত। রবীন্দ্রনাথকে তিনি সার্থকভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ তাঁর কবিতার মৌলিকতাকে কখনও বিনষ্ট করতে পারেনি।
Leave a comment